সত্য সুন্দরকে বরণের উৎসব

লিপি বড়ুয়া | বুধবার , ১৬ অক্টোবর, ২০২৪ at ৬:৩৩ পূর্বাহ্ণ

প্রবারণা শব্দের অর্থআশার তৃপ্তি, অভিলাষ পূরণ, ধ্যান বা শিক্ষা সমাপ্তি বোঝায়। অন্যদিকে আত্মশুদ্ধি বা আত্মসমালোচনাও বলে। আজকের দিনে ভিক্ষুরা হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে চারিত্রিক শুদ্ধির জন্য একে অন্যকে করজোড়ে বলেন, ‘বন্ধু, যদি আমার কোনো রূপ দোষত্রুটি দেখো বা কারো থেকে শুনে থাকো এবং এ কারণে যদি আমার ওপর সন্দেহ হয়ে থাকে, তাহলে আমাকে বলো, আমি তার প্রতিকার করব। বিনয় পিটকের পরিভাষায় একে বলে ‘প্রবারণা’। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব প্রবারণা পূর্ণিমা।

প্রবারণা শব্দটি পালি সাহিত্যে ব্যাপক অর্থে প্রযোজ্য। এটির অন্য অর্থ প্রকৃষ্টরূপে বরণ করা, অভীষ্ট দান, বারণ বা নিবারণ করা বোঝায়। অতএব প্রবারণা বলতে অসত্য, অন্যায়, অপরাধমূলক কর্ম বর্জন করে সত্য, ন্যায় এবং কুশল কর্মকে বরণ নির্দেশ করে। প্রবারণা পারস্পরিক মিলন উৎসবও বটে। পূর্বকৃত সব ত্রুটিবিচ্যুতি ক্ষমা করে পারস্পরিক মিলন ঘটে প্রাবারণার মাধ্যমে।

এই পূর্ণিমায় তিন মাসব্যাপী তথাগত বুদ্ধ তাবতিংশ স্বর্গে মাতৃদেবীকে অভিধর্ম দেশনার পর সাংকাশ্য নগরে অবতরণ করেন। এ দিনে ভিক্ষুদেরকে তা হিত, সুখ, কল্যাণ ও প্রসারে দিকে দিকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেন এবং এই পূর্ণিমা তিথিতেই ত্রৈমাসিক বর্ষাবাসের পরিসমাপ্তি হয়।

প্রবারণা পূর্ণিমা বিশ্বের থেরবাদী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব। প্রবারণা হলো আত্মশুদ্ধি ও অশুভকে বর্জন করে সত্য ও সুন্দরকে বরণের অনুষ্ঠান। আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে শ্রাবণী পূর্ণিমা হয়ে মধুপূর্ণিমা বা ভাদ্র পূর্ণিমা অতঃপর আজকের এই আশ্বিনী পূর্ণিমা বা প্রবারণা পূর্ণিমা হলো ভিক্ষু সংঘের বর্ষাব্রত অধিষ্ঠানের ব্যাপ্তিকাল। এবং এই ত্রৈমাসিক বর্ষাবাসে গৃহীরাও শীল, সমাধি প্রজ্ঞার মাধ্যমে আত্মপরিশুদ্ধির ব্রত গ্রহণ করেন। তথাগত সম্যক সমবুদ্ধের নির্দেশ হলো এই তিন মাস ভিক্ষুও ভিক্ষুণী সংঘ নিরবচ্ছিন্নভাবে ধ্যানভাবনায় রত থাকবে এবং ধ্যান সাধনার মাধ্যমে নিজ নিজ চিত্তের উৎকর্ষ বিধান করবে। এই বর্ষাব্রত অধিষ্ঠানের বিধান একটি অনন্য অসাধারণ মাঙ্গলিক প্রয়াস। কারণ ধর্ম শ্রবণ, ধারণ ও অনুশীলন এই তিনটি অপরিহার্য দিক ত্রৈমাসিক বর্ষাব্রতে নিহিত রয়েছে। প্রবারণা পূর্ণিমাতে থেরবাদী বৌদ্ধ বিশ্বের ভিক্ষু ু ভিক্ষুণীসংঘের বর্ষাব্রত অধিষ্ঠানের সমাপ্তিকরণ। প্রবারণা পূর্ণিমায় আকাশ প্রদীপ অর্থাৎ ফানুস উত্তোলন করা হয়। এই ফানুস উত্তোলনের একটি ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে। তথাগত সম্যক সমবুদ্ধ যখন গৃহী ছিলেন সে সময় কুমার সিদ্ধার্থ গৃহত্যাগের পর তাঁর মস্তক থেকে চুল কর্তন করে আকাশমার্গে ছুঁড়ে দিয়ে সংকল্প করেছিলেন যদি আমি ভবিষ্যতে বুদ্ধ হই তবে এই কেশ উর্ধ্বদিকে যাবে এবং যদি তা না হয় তবে এই কেশরাশি নিম্নদিকে পতিত হবে। সেই পুণ্যক্ষণে তাঁর কেশরাশি উপর দিকে আকাশমার্গে স্থান পেয়েছিল। এবং তিনি ছয় বছর কঠোর সাধনার মাধ্যমে হয়ে উঠেছেন জগতপূজ্য তথাগত সম্যক সমুদ্ধ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা গভীর শ্রদ্ধায় সেইদিনের পুণ্যলগ্নকে স্মরণ করে আকাশ প্রদীপ বা ফানুস উত্তোলন করে থাকেন এই প্রবারণা পূর্ণিমায়।

মহাকারুণিক বুদ্ধ মাত্র এক সপ্তাহ মায়ের দুধ পান করেছিলেন। মাতৃসেবা এবং মাকে ধর্ম জ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি বলে বুদ্ধ তাবতিংস স্বর্গে মাকে ধর্ম উপদেশ দেবার জন্য সেখানে তিন মাস বর্ষাবাস যাপন করে মাকে অভিধর্ম দেশনার মাধ্যমে স্রোতাপত্তি মার্গফলে প্রতিষ্ঠিত করে মাতৃ ঋণ শোধ ও কর্তব্য পালন করে জগতে এক অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। যা আমাদের সকলের জন্য অনুকরণীয়। সেই রীতিকে অনুসরণ করে বৌদ্ধরা প্রবারণা দিবস থেকে তিনদিন পর্যন্ত মা, বাবা, গুরু আচরিয়দের নানাবিধ দানীয় সামগ্রী দ্বারা পূজা বন্দনা ও সম্মান করে থাকেন। আমরা যারা সাধারণ মানুষ আমাদের পক্ষে ঐ রকম ধর্মদান করা সম্ভব না হলেও আমরা মাতাপিতার সেবা যত্ন দ্বারা তাদের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে পারি।

খুবইতাৎপর্যয় এই প্রবারণা পূর্ণিমার দিনটিতে বিশ্বের থেরবাদী সকল বৌদ্ধরা বিহারে গিয়ে শীল গ্রহণ, ধ্যান সাধনা, বুদ্ধ পূজা, আলোকসজ্জা, ফানুস উত্তোলনের মাধ্যমে মহাসারম্বরে পালন করে থাকে।

সন্ধ্যার সময় কীর্তন সহকারে অত্যন্ত উৎসবমুখর পরিবেশে ওড়ানো হয় আকাশ প্রদীপ বা ফানুস বাতি। সময় জাতিধর্ম নির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষ সমবেত হয়ে উৎসবে মেতে ওঠে। এটি একটি অসামপ্রদায়িক সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়। এ উৎসব একদিকে বৌদ্ধ ভিক্ষুসংঘের মধ্যে পারস্পরিক মৈত্রী, সৌহার্দ্য, সমপ্রীতি ও শৃঙ্খলা বৃদ্ধি করে অপরদিকে জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সবার মধ্যে বন্ধুত্ব ও অসামপ্রদায়িক ভাবধারা সুদৃঢ় করে। এ উৎসবের সঙ্গে খ্রিস্ট ধর্মের বড় দিনের উৎসব, সনাতন ধর্মের দুর্গোৎসব এবং অন্যান্য ধর্মের উৎসবের সঙ্গে তুলনা করা যায়। এ উৎসবের ধর্মীয় দিকের পাশাপাশি সামাজিক দিকটিও নিঃসন্দেহে গুরুত্ববহ। সব বাদবিসংবাদ ভুলে গিয়ে শাশ্বত সত্যকে গ্রহণ করে পারস্পরিক সহাবস্থানই প্রবারণার মূল আদর্শ। এ আদর্শকে ধারণ ও অনুশীলনের মাধ্যমে একটি পরিচ্ছন্ন সমাজ গড়ে উঠবে।

লেখক: কবি ও গল্পকার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচাঁদা তুলতে এসে স্থানীয়দের হাতে যুবক আটক
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবারণা পূর্ণিমা আজ