মন দর্শনশাস্ত্রের একটি অন্যতম কেন্দ্রীয় ধারণা। মন সাধারণত বুদ্ধি ও বিবেকবোধের এক সমষ্টিগত রূপকে বোঝায়, যা চিন্তা, অনুভূতি, আবেগ, ইচ্ছা ও কল্পনার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। মন কী এবং কীভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে অনেক রকম তত্ত্ব প্রচলিত আছে। এসব তত্ত্ব নিয়ে চিন্তা–ভাবনা মানবজাতির আদিকাল থেকে। জড়বাদী দার্শনিকরা মনে করেন, মানুষের মনের প্রবৃত্তির কোনো কিছুই শরীর থেকে ভিন্ন নয়। বরং মানুষের মস্তিষ্ক থেকে উদ্ভূত শারীরবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মন গড়ে উঠে। প্রকৃতপ্রস্তাবে মনের সঠিক সংজ্ঞা সম্ভব নয়। তবে বলা যেতে পারে, মন হলো এমন কিছু, যা নিজের অবস্থা ও কাজকর্ম সম্পর্কে সচেতন। পবিত্র কোরআনের ভাষ্যমতে, মানুষের এই মন তিন ধরনের। প্রথম হলো নফসে মুতমায়িন্না প্রশান্ত মন, দ্বিতীয় হলো নফসে লাওয়ামা কৃত অপরাধে অনুতপ্ত মন আর তৃতীয়টি হলো নফসে আম্মারা প্রেতাত্মা বা দুষ্টু মন। এই তিন ধরনের মনের মধ্যে স্রষ্টার কাছে সর্বোৎকৃষ্ট মন হলো প্রশান্ত মন।
প্রশান্ত মনের পরিচয়ঃ প্রশান্ত মন হলো, স্রষ্টার কথা শুনলে যে মন তৃপ্তি পায়। স্রষ্টা ছাড়া আর কিছুতেই মিষ্টতা অনুভব হয় না, সব কিছু শুধু তিতো লাগে। এমন মন হলো প্রশান্ত বা পরিতৃপ্ত। কোরআনের ত্রিশতম পারায় সূরা ফজরে এই নফসে মুতমায়িন্না সম্পর্কে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে (ভাবার্থ) কেয়ামতের দিন প্রশান্ত মনকে বলা হবে, ওহে স্রষ্টার–নামে উৎসর্গিত মন! তুমি তো পৃথিবীতে প্রকৃত প্রেমীর সাথে নিবিড় সম্পর্ক রাখতে। এখন তাঁরই একান্ত সান্নিধ্যে এসো। তিনি তোমার প্রতি সন্তুষ্ট আর তুমিও সন্তুষ্ট তার প্রতি। আর দেরি কেন, যাও! যাচাইকৃত অনুগতদের দলভুক্ত হও আর সদলবলে বেহেশতে প্রবেশ করো। (সূরা ফজর : ২৭–৩০)তাই পৃথিবীতে যারা স্রষ্টাপ্রিয়দের সহচর্য লাভ করে প্রকৃত প্রেমীর সাথে সম্পর্ক ঠিক রেখেছে, তারাই সে স্রষ্টাপ্রিয় অনুগতদের সাথে সদলবলে বেহেশতে যাবে। সেমতে, মনকে প্রশান্ত করতে হলে স্রষ্টাপ্রিয়দের সহচর্য ছাড়া গত্যান্তর নেই।
অনুতপ্ত মনের পরিচয়: পবিত্র কোরআনে এসেছে নফসে লাওয়ামা বা কৃত অপরাধে অনুতপ্ত মনের ব্যাপারে। সেখানে বলা হয়েছে আমি কসম করছি কেয়ামত দিবসের। আরও কসম করছি (সেই মনের, যে নিজেকে তিরস্কার করে) নফসে লাওয়ামার (সূরা কিয়ামত : ১–২) অর্থাৎ তিরস্কারকারী অনুতপ্ত মন হলো, নফসে লাওয়ামা। এ আয়াতে কেয়ামতের পরে অনুতপ্ত মনের কথা বলার তাৎপর্য হলো, মৃত্যুর পর কেয়ামতের দিন হিসাব–নিকাশের জন্য ফেরারী মনগুলোকে আবার জাগিয়ে দেয়া হবে। তাই কেয়ামতের সাথে তপ্ত মনের কথা উল্লেখ হয়েছে। অনুতপ্ত মন মূলত দুষ্টু মনের পতনকে বলা হয়। অর্থাৎ, এই অবস্থায় দুষ্টু মনের প্রলোভনে যদিও হঠাৎ স্রষ্টার অবাধ্যতা করেও বসে, তখন সেই মনের অনুতাপের অন্ত থাকে না। আর এ ধরনের অনুতাপের নাম হলো তাওবাতুন–নাসুহা বা শুদ্ধ সরল অন্তঃকরণের অনুতাপ। এই অনুতাপ হচ্ছে দুষ্টু মনের সাথে অভ্যন্তরীন লড়াই। এজন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন কুপ্রবৃত্তির সাথে যুদ্ধ হলো জিহাদে আকবর বা শ্রেষ্ঠ জিহাদ।’ আর অনুতপ্ত মনের এই স্তর অতিক্রম করতে পারলে আরো উন্নীত স্তরে পৌঁছা যায়। যাকে বলা হয় প্রশান্ত মনের স্তর।
দুষ্টু মন বা প্রেতাত্মার পরিচয়ঃ নফসে আম্মারা বা দুষ্টু মনের ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে নিশ্চয় নফসে আম্মারা বদ কাজ করায়, তবে আল্লাহ যাদের ওপর রহম করেন। আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও দয়ালু। (সূরা ইউসুফ : ৫৩) দুষ্টু মন মূলত মানুষকে কু–কাজের প্রতি প্রলুব্ধ করে, কুমন্ত্রণা যোগায়। তাই দুষ্টুচারিতা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া ইবাদতকামী মনের জন্য একান্ত প্রয়োজন। কেননা, এটা সবচেয়ে ভয়াবহ ও মারাত্মক শত্রু। এ শত্রু থেকে যে বিপদের সম্মুখীন হতে হয়, তা খুবই মারাত্মক। এর প্রতিরোধ করা খুবই কঠিন। এ দুষ্টু মনের রোগেরও শেষ নাই আর রোগগুলোর চিকিৎসাও খুব কষ্টসাধ্য। কারণ, ঘরে যখন ডাকাত পড়ে, তখন তার হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া খুবই কঠিন। যে কোনো মুহূর্তে জীবননাশের শঙ্কাও থাকে প্রবল। বিশিষ্ট দার্শনিক ইমাম গাজ্জালী তার গ্রন্থে লিখেন আমার আহ্বানকারী আমার যে ক্ষতি করেছে, আমার মন তার প্রভাব কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারছে না। কেননা, সে আমার রোগ ও বেদনা বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। আমি সে শত্রুকে কিভাবে প্রতিরোধ করতে পারি, যে শত্রুর বাসা আমার অভ্যন্তরেই। তাই এ প্রেতাত্মা বা দুষ্টু মনের স্তরকে দমন করে মনের প্রথম উত্থান ঘটে অনুতপ্ত মনের স্তরে। আর তপ্ত মনের স্তরকে অতিক্রম করলে মানবমনের সবচে’ বড় উত্তরণ ঘটে প্রশান্ত মনে।
লেখক: প্রাবন্ধিক।