চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের কৃষি উন্নয়ন ও ভূ–উপরিস্থ পানির সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গৃহীত প্রায় সাড়ে ৬শ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নিয়ে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রকল্পের আওতায় দায়সারা গোছের কাজ করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে সংঘবদ্ধ একটি চক্রের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পের আওতায় খাল খনন, কালভার্ট নির্মাণ, পুকুর ও জলাশয় তৈরি, গাড়ি ভাড়া, কম্পিউটারসহ নানা যন্ত্রপাতি ক্রয়ের কাজে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিষয়টি দ্রুত তদন্ত করার জন্য সংশ্লিষ্টরা আবেদন জানিয়েছেন।
সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষি খাতের উন্নয়নসহ পানির সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গত বছর একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। প্রায় সাড়ে ৬শ কোটি টাকার এই প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলাসহ কক্সবাজার অঞ্চলে নানা কার্যক্রম চলছে। কিন্তু এসব কার্যক্রমে দুর্নীতি ও অনিয়ম হচ্ছে বলে অভিযোগ করে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, তড়িঘড়ি করে প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতে নজিরবিহীন কর্মকাণ্ড চালানো হচ্ছে। গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর মাত্র দুই মাসে এই প্রকল্পের আওতায় অন্তত ৫শ টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে। ছুটির দিনেও ইস্যু করা হয়েছে ওয়ার্ক অর্ডার। অস্থায়ী লোকবল নিয়োগের ক্ষেত্রেও অনিয়ম হয়েছে। বিএডিসি চট্টগ্রাম অঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নুরুল ইসলাম এই প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
বিএডিসির ওয়েবসাইটে দেওয়া প্রকল্পের তথ্যাবলী থেকে জানা গেছে, চট্টগ্রাম–কক্সবাজার কৃষি উন্নয়ন ও ভূ–উপরিস্থ পানির সুষ্ঠু ব্যবহার প্রকল্পের অংশ হিসেবে বেশ কয়েকটি খাল পুনঃখনন, অনাবাসিক ভবন (ইউনিট অফিস), খালের পাড়ে আউটলেট স্থাপন, জলাধার/পুকুর খনন (পাড় বাঁধাই ও বৃক্ষরোপণ, ডাগওয়েল নির্মাণ (সৌরশক্তি চালিত পাম্পসহ), ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ, আর্টেশিয়ান নলকূপ খনন ও কমিশনিং, রেগুলেটর বা সাবমার্জড ওয়্যারসহ বড় আকারের সেচ অবকাঠামো নির্মাণ, ক্রসড্যাম কিংবা কালভার্টসহ মধ্যম আকারের সেচ অবকাঠামো নির্মাণ, ফুটব্রিজ কিংবা ক্যাটলক্রসিংসহ ছোট আকারের সেচ অবকাঠামো নির্মাণসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ রয়েছে। প্রকল্পের আওতায় ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি খাল পুনঃখনন করা হয়েছে। কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ের বাসিন্দাদের অভিযোগের ভিত্তিতে সূত্র জানিয়েছে, এসব খাল খননের নামে দুই পাড়ের ঘাষ কেটে পরিষ্কার করা হয়েছে। কোনো কোনো এলাকায় সামান্য মাটি কাটা হলেও তা ধারেকাছেই ফেলে রাখা হয়েছে। বৃষ্টিতে যা আবার খালে গিয়ে পড়েছে। প্রকল্পের আওতায় কালভার্ট নির্মাণেও অনিয়ম হয়েছে।
প্রকল্পটির আওতায় ৪০ দিনের কম সময়ে নজিরবিহীনভাবে ৪৬১টি টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে উল্লেখ করে সরকারের উপদেষ্টা বরাবরে প্রেরিত এক অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, এসব টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে কোনো ধরনের নিয়ম নীতির তোয়াক্কা করা হয়নি।
প্রকল্পের ভূমি জরিপের সবগুলো কাজ পেয়েছে ডিজিটাল সার্ভে কনসালটেন্সি ও ল্যান্ড সার্ভে টিম নামের দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এ দুটি প্রতিষ্ঠানের মালিক সম্পর্কে মা ও মেয়ে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। মেসার্স বিপ্লব ট্রেডার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ৪ বছরের জন্য ৪ কোটি ৮১ টাকা ব্যয়ে তিনটি গাড়ি ভাড়া করা হয়েছে। এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির মালিক প্রকল্প পরিচালক নিজে বলেও বিএডিসি অফিসে প্রচারণা রয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, নিজের পছন্দের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজ দিতে পিপিআর নীতিমালা লঙ্ঘন করে টেন্ডার বাছাই কমিটির চেয়ারম্যানও হয়েছেন প্রকল্প পরিচালক নিজেই। অন্তত ১০টি টেন্ডার ওটিএম পদ্ধতিতে কল করেও পরে তা স্থগিত করা হয়। পরে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে পছন্দের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজগুলো ভাগ করে দেওয়া হয়েছে।
পুরো প্রকল্পটি নিয়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায়সহ বিএডিসির সদর দফতরেও অনেক অভিযোগ জমা পড়েছে। কিন্তু প্রকল্প পরিচালকের বড় ভাই বিএডিসির শীর্ষ কর্মকর্তা হওয়ায় সব অভিযোগ ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেন। তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বিএডিসি চট্টগ্রাম অঞ্চলে সংঘবদ্ধ একটি চক্র কোটি কোটি টাকার হরিলুট চালাচ্ছে। বিভিন্ন সময় বিষয়গুলো নিয়ে অভিযোগ করা হলেও রহস্যজনক কারণে অভিযুক্তরা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন।
দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে জানতে বিএডিসি চট্টগ্রাম অঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এবং উক্ত প্রকল্পের পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার নুরুল ইসলামকে একাধিকবার ফোন করা হয়। কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ করেননি।