১৯৭২ সালের আগস্টে বাংলাদেশ বেতার, ঢাকার ট্রান্সকিপশন সার্ভিসের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। পরিচালকের দায়িত্ব নেন শহীদুল ইসলাম। এটি স্বাধীন বাংলা দেশের সর্ব প্রথম একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ আর্কাইভিং স্থাপনা। যাতে ধারণকৃত রয়েছে লোকসংগীত, লোকনাট্য, বিশিষ্ট ও খ্যাতনামা শিল্পী, সংগীতজ্ঞ, কবি,সাহিত্যিকদের সাক্ষাৎকার, গান, জাতীয় সংগীত ইত্যাদি।
১৯৭৩ সালে পল্লীকবি জসীম উদদীনের উৎসাহ ও তত্ত্বাবধানে, শহীদুল ইসলামের উদ্যোগে ঢাকার শাহবাগে বাংলাদেশ বেতার ঢাকার ট্রান্সকিপশন সার্ভিসের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম ‘লোকসংগীত উৎসব’। যেখানে আমন্ত্রণ জানানো হয় সারা দেশের প্রথিতযশা ও নামিদামি সব লোক সংগীত শিল্পী, লোকসংগীতে দল, কবি গান, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের রাজ রানী শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণব ও শেফালী ঘোষ, মাইজভাণ্ডারি গানের দল, সিলেটের ধামাইল, হাছন রাজার গান, উত্তর বংগের ভাওয়াইয়া গানের বরপুত্র রথীন্দ্রনাথ রায়, রাজশাহীর গম্ভীরা, নাদিরা বেগম, কুষ্টিয়ার লালনের দল বিশেষত ফরিদা পারভীনসহ জানা অজানা অনেক শিল্পী। সে ছিল এক বিশাল আয়োজন!
সে অনুষ্ঠানে সিলেটের দল ‘বিদিত লাল দাশ ও তার সঙ্গীরা’ যে অজানা, অচেনা, অপূর্ব ভাব সম্বৃদ্ধ, তালে, সুরে, কথায়, অসাধারণ নতুনত্বে, নব্য ঢংয়ে স্টাইলে বাউল আঙ্গিকের গান গেয়ে সমগ্র অনুষ্ঠানকে টালমাটাল ও পুরা সার্থক করেছিল সেটি আগে কেউ, শোনেনি, জানে না তার স্রষ্টা কে, কোন অঞ্চলের গান।
সে গান হল ‘সাধের লাউ বানাইল মোরে বৈরাগী।’ তার পর দিন থেকেই লোকের মুখে মুখে সে গান বাজতে লাগল। দ্বিতীয় বার ১৯৭৫ সালে সার্ক সাংস্কৃতিক উৎসবে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে এ গান গেয়ে বাজিমাত করে বিদিত লাল দাশ ও তার সঙ্গীরা। অনেকদিন পর উপমহাদেশের খ্যাতিমান শিল্পী রুনা লায়লা কোলকাতা থেকে সংগ্রহ নামে এ গান বের করেন। নিজস্ব ঢংয়ে, অন্যভাবে সেটি দুই বাংলাসহ সারা বিশ্বে প্রচুর জনপ্রিয়তা পায়। কিন্তু কোথাও গীতিকার, সুরকারের নাম উল্লেখ করেনি। অনেক শিল্পী শহরে, গ্রামে, গঞ্জে গেয়ে এ গানকে আরো জনপ্রিয় করে তোলপাড় করে তোলে। ১৯৭৮ সালের কথা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগে পড়াকালীন প্রতিবছর শিক্ষা সফর ও গবেষণার অংশ হিসেবে যেতে হয় কোন না কোন সম্বৃদ্ধ অঞ্চলে যার পরবর্তীতে একটি রিপোর্টও জমা দিতে হত। সেবার আমাদের সফর ও অভিজ্ঞতার জন্য স্থান নির্বাচন করা হয় সিলেট। আমাদের বিবিধ গবেষণার উপাদান সংগ্রহের সুবিধার্থে খাদিম নগরের শাহ পরান বাবার মাজার সন্নিকটস্থ ‘পল্লী উন্নয়ন একাডেমীতে’ তিনদিনের অবস্থান সহ কার্যক্রমের আয়োজন করা হয়। আমাদের সেমিনার, আলোচনা, দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন ও সন্ধ্যায় থাকতো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন।
শেষের দিন ছিল মাজার পরিদর্শন। আমরা হযরত শাহজালালের মাজার পরিদর্শন শেষে গেলাম হযরত শাহ পরানের মাজারে। সবাই যার যার মতে জেয়ারত সহ ঘোরাঘুরি করছিল বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে।
আমি দেখলাম একটি গানের দল নারী পুরুষ মিলে অঘোরে গেয়ে চলেছে,
‘ তুমি অসময়ে বাজাও বাঁশী
কালা সময় বুঝ না
যখন আমার সময় হয় গো
কালা তখন তোমায় দেখি না‘
পরে ধরলেন,
‘ওরে আমার অবুঝ মন
আমি কার লাগিয়া বাঁধলাম বাড়িঘর
যারে বাবি আপন আপন
সে আমাকে ভাবে পর’।
শেষ গান ধরল,
‘সাধের লাউ বানাইল মোরে বৈরাগী’
যে গান সবার মুখে মুখে। আমিও গলা মিলালাম বেহালা বাজিয়ে গাওয়া গায়কের সাথে। তরুণ ও বয়স্ক পুরুষ ও মেয়েরা নৃত্য করছে তালে তালে। সঙ্গে দোতারা, একতারা, বাঁশী, ঢোল ও পারকিউশন। গান থামলে ত্রিশোর্ধ ঢাকার দেওয়ান জালাল আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন আমি নাকি ভালোই গাই। পরিচয়, জানা শোনা, আলাপচারিতার মাঝে আমার অনুসন্ধানী মন জানতে চাইল তার পরিবেশিত গানগুলি কার? সে আমাকে জানাল প্রথম দুটি গান তার রচনা ও সুর। তৃতীয় গানটি সিলেট অঞ্চলের ‘শীতালংগী রাগ’। যে গান সম্পর্কে আমার কোন ধারণাই ছিল না। আমাদের সময় কম বিধায় ডাক পড়লে আমি বিদায় নিলাম ধন্যবাদ জানিয়ে।
রহমান মৃধা নামে সুইডেনস্থ ফাইজারের সাবেক পরিচালক তার এক লেখায় লিখেছিলেন, ‘সাধের লাউ বানাইল মোরে বৈরাগী’ সিলেটের এই গান ব্যাপক জনপ্রিয় হয়। বিভিন্ন দলে এ গান গাইত। বিশেষ করে বিদিত লাল দাশ। তাদের গাওয়া এ গান দেশে বিদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। শিল্পী রুনা লায়লাও এ গান গেয়ে বেশ জনপ্রিয়তা পান’।
ড. মোহাম্মদ আমিন তার এক লেখায় উল্লেখ করেছেন, ‘এ গান সিলেট অঞ্চলের গান। এর প্রথম চার লাইন বহুকাল পূর্ব হতে সিলেটের সাধারণ মানুষের মুখে মুখে গাওয়া হত। তবে রচয়িতা কে জানা যায় নাই। অনেকে অনেক চেষ্টা করেও গানের বাকী লাইনগুলি সংগ্রহ করতে পারেন নি‘।
এ গানের ইতিহাস সম্পর্কে লিখতে গিয়ে জনাব আজিম পরদেশী বিস্তারিত লিখেছেন, ‘যে কোন বাংলা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অপূর্ণ থেকে যায় যদি গাওয়া না হয় সেই বহুল পরিচিত সাধের লাউ গান। এ গান শোনেনি এ রকম কোন বাংলাভাষীকে পাওয়া দুষ্কর। বাংলাদেশের বাঙালিদের চাইতে কোলকাতার বাঙালিদের কাছে এ গান অধিক জনপ্রিয়। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না বা জানার চেষ্টা করি না এ গানের রচয়িতা কে ? সুরকার কে?
এটা সিলেট অঞ্চলের গান। একথা পুরাতন গায়কেরা জানলেও নতুনরা এ বিষয়টা জানার তেমন প্রয়োজন বোধ করে না। শুধু গাইলেই হল। এ গানের ইতিহাস অন্য গানের মত নয়। এই গানের রচনা থেকে সুরকার পর্যন্ত অনেকের ছোঁয়া লেগেছে। দুলাল ভৌমিক ও হিমাংশু বিশ্বাস মিলন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া করার সময় হঠাৎ একদিন একটি অনুষ্ঠানে সিলেট এসে হাজির। তারা দুই জনই ছিলেন রামকানাই দাশের ছাত্র। তারা পণ্ডিতজিকে বলল আমরা এ গানের চার লাইন সংগ্রহ করেছি আর কোন লাইন নাই। অর্থাৎ
‘ সাধের লাউ বানাইল মোরে বৈরাগী
লাউয়ের আগা খাইলাম
ডোগা গো খাইলাম
লাউ দি বানাইলাম ডুগডুগি ’।
এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সিলেটের খ্যাতিমান দুই গীতিকার কবি গিয়াসউদ্দিন ও ব্রাহ্মণ রাজবেরী চক্রবর্তী। তখন কবি গিয়াসউদ্দিন গানের পরবর্তী তিন লাইন লিখলেন,
‘লাউয়ের এত মধু/ করল গো যাদু/ লাউ করলাম সংগের সংগী’।
আর শেষ চার লাইন লিখলেন ব্রাহ্মণ রাজবেরী চক্রবর্তী। তিনি যেহেতু ব্রাহ্মণ তাই গয়া ও কাশীর কথা লিখেন,
‘আমি গয়া গেলাম / কাশী গো গেলাম/ সঙ্গে নাই মোর বৈষ্ণবী’।
গানটির প্রথম সুর করেন রাজবেরী চক্রবর্তী কিন্তু উপস্থিত মজলিসে আরো সুন্দর সুর তৈরির চেষ্টা চলে।
তখন পণ্ডিত রাম কানাই দাশ একটি সুর তুলেন এবং গাইলেন। যা সবার পছন্দ হয়। পরবর্তীতে সিলেটের বিভিন্ন দলে এ গান ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সিলেটের গণ্ডি পেরিয়ে এ গানকে দেশে পরিচিত করিয়ে দেন সিলেটের আর এক কিংবদন্তী শিল্পী, সুরকার, গীতিকার, সংগঠক বিদিত লাল দাশ। আর এ গানকে মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেন কিংবদন্তী শিল্পী রুনা লায়লা।
সিলেটের বিশিষ্ট লোকসংগীত শিল্পী ড. বিশ্বজিত রায় ও একই মতামত দেন তবে তার মতে ‘এ গানের সুরকার বিদিত লাল দাশ এবং এ গানটি জন প্রিয় করেন তিনি। তিনি হাছন রাছা, রাধারমন দত্ত, শীতালং শাহ ও কবি গিয়াসউদ্দিনের অনেক গানের সুরকার ছিলেন’। অনেকের মতে পণ্ডিত রামকানাই দাশই ছিলেন এ গানের সফল সুরকার।
আমাদের এ যাবৎকালের গুণীজনদের মত, বিশিষ্টজনের তথ্য উপাত্ত, সাক্ষাৎকার, আলোচনা, বিবিধ পুস্তকের উদ্ধৃতি, প্রচলিত উপাখ্যান ও ফকির গায়কের ধারণা, জ্ঞান থেকে বুঝতে পারি এ গানের ইতিহাস, উৎস, রচয়িতা বা গীতিকার, সুরকারের নাম অনেক জনের চেষ্টার পর এখনো অজ্ঞাত।
এ গানটি অনেককাল আগে রচিত, সুরটিও প্রাচীন। কারো কারো মতে দেড়শ বছরেরও অধিক। তাই শীতালংগী রাগ বা গীতের ধারণা, শীতালং শাহের গান সমূহ ‘সিলেটের নাগরী হরফে লিপিবদ্ধকরন, এগান ছাপিয়ে প্রকাশ করতে নিষেধ করা,
মুখে মুখে ও বিবিধ বৈঠকে গাওয়া, সিলেট, কাছাড় এবং করিমগঞ্জের বিবিধ স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এবং বহু গান হারিয়ে যাওয়া, হিমাংশু বিশ্বাস কর্তৃক কোনো ফকিরের কাছ থেকে সর্বপ্রথম এ গানের স্থায়ী এবং একটি অন্তরা উদ্ধার, কোনো কোনো সংগ্রাহকদের কাছ থেকে দুর্ঘটনায় হারিয়ে যাওয়া এবং শীতালং শাহ’র বাউল গান বা রাগের আলোচনার মাধ্যমে আরো জানা যায় তিনি অনেক বাউল গান রচনা করছেন যা ‘বাউল রাগে’র অন্তর্ভুক্ত যেখান তিনি নিজেকে নারী রূপে কল্পনা করে আল্লাহ্কে নর রূপে কল্পনা করেছেন আবার অন্য সময় নিজেকে রাধিকারূপে কল্পনা করে আল্লাহ্কে কৃষ্ণ রূপে কল্পনা করেছেন। রাধা, কৃষ্ণ,গয়া, কাশী তাই তার গানে উল্লেখ পাই।
তিনি লিখেছেন : ‘আমি গয়া গেলাম / কাশীগো গেলাম / সঙ্গে নাই মোর বৈষ্ণবী‘। আবার শীতালং শাহ নিজে গান রচনা করে সুর দিতেন নিজেই এবং প্রয়োজনীয় সংশোধন নিজেই করতেন। এ সকল আলোচনায় আমরা হয়তো এ গানের গীতিকার সুরকার হিসেবে বলতে পারি শীতালং শাহ বৈ অন্য কেউ নন। আগামীতে আরো জানার অপেক্ষায়।
লেখক: সংগীত শিল্পী, প্রাবন্ধিক।