AI এবং H2H মার্কেটিং, আচরণগত বিজ্ঞান এবং জাতিসংঘ ২.০ যুগের সূচনা

এম. এ. মুকিত চৌধুরী | রবিবার , ১৩ অক্টোবর, ২০২৪ at ৯:০৫ পূর্বাহ্ণ

বর্তমান যুগে ব্যবসা এবং মার্কেটিংয়ের ধরন দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। মার্কেটিংয়ের প্রচলিত ধারণাগুলো এখন সম্পূর্ণ নতুনভাবে পুনর্নির্মাণ হচ্ছে, যেখানে মানবিক সম্পর্কের গুরুত্ব আগের চেয়ে অনেক বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে। আগে শুধুমাত্র পণ্য বা সেবা বিক্রি করাই মূল লক্ষ্য ছিল, এখন সেই লক্ষ্য পরিবর্তিত হয়ে গেছে মানুষের সাথে গভীর এবং মানবিক সম্পর্ক তৈরি করার দিকে। এই পরিবর্তনের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র– H2H (Human to Human) মার্কেটিং এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI)

H2H মার্কেটিং: সম্পর্কের ভিত্তিতে সফলতা: H2H মার্কেটিংয়ের মূল লক্ষ্য হলো ব্যবসা এবং গ্রাহকের মধ্যে মানবিক সম্পর্ক তৈরি করা। সাধারণত, প্রচলিত ব্যবসায়িক মডেলে B2B (Business to Business) এবং B2C (Business to Consumer) মডেলের মাধ্যমে পণ্য বা সেবার প্রসার ঘটানো হতো, যেখানে লক্ষ্য ছিল কেবল বিক্রির উপর ভিত্তি করে। কিন্তু H2H মার্কেটিং সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে, ব্যবসা পরিচালনা করার সময় গ্রাহকের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তোলাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।

H2H মার্কেটিংয়ের প্রধান উদ্দেশ্য হলো মানুষের মানসিকতা, আবেগ, এবং প্রয়োজনকে বিবেচনা করে তাদের সাথে একটি সম্পর্ক তৈরি করা। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো ব্র্যান্ড কোনো গ্রাহকের ব্যক্তিগত চাহিদা এবং অনুভূতিগুলোকে গুরুত্ব দেয়, তাহলে সেই গ্রাহক শুধু একটি পণ্য কেনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবেন না। তিনি সেই ব্র্যান্ডের সাথে একটি আবেগীয় বন্ধন তৈরি করবেন এবং ব্র্যান্ডের প্রতি অনুগত হয়ে উঠবেন।

H2H মার্কেটিংএর উদাহরণ: একটি ভালো উদাহরণ হতে পারে জনপ্রিয় কফি চেইন স্টারবাকস। স্টারবাকস শুধু কফি বিক্রি করে না, বরং গ্রাহকের জন্য একটি অভিজ্ঞতা তৈরি করে। গ্রাহকদের পছন্দ অনুযায়ী তাদের কফির অর্ডার কাস্টমাইজ করা, কফির কাপের উপর তাদের নাম লেখা, এবং আরামদায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করার মাধ্যমে তারা গ্রাহকদের সাথে একটি গভীর মানবিক সম্পর্ক তৈরি করে। এর মাধ্যমে গ্রাহকরা শুধু একটি কফি পান করছেন না, বরং তারা একটি অনুভূতি এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার অংশ হচ্ছেন।

এই ধরনের মানবিক সংযোগই হলো H2H মার্কেটিংএর মূলমন্ত্র। গ্রাহকদের অনুভূতিগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে তাদের সাথে সম্পর্ক তৈরি করলে তা দীর্ঘমেয়াদে ব্যবসার জন্য উপকারী প্রমাণিত হয়।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI): মানবিক সম্পর্ককে শক্তিশালী করা: AIএর উদ্ভাবন এবং ব্যবহার আমাদের জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে, এবং মার্কেটিং তার ব্যতিক্রম নয়। AI এখন কেবল একটি নতুন প্রযুক্তি নয়, এটি মানবিক সম্পর্ক এবং সংযোগগুলোকে আরও উন্নত এবং কার্যকর করে তুলতে সাহায্য করছে। H2H মার্কেটিংএর ক্ষেত্রে AI এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

AIএর সাহায্যে কাস্টমাইজড অভিজ্ঞতা: AIএর মাধ্যমে এখন গ্রাহকের প্রয়োজন এবং চাহিদা আরও সঠিকভাবে বুঝতে পারা যায়। গ্রাহকরা কিভাবে কোনো নির্দিষ্ট পণ্য বা সেবা সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন, কী ধরনের পণ্য কিনছেন, তারা কীভাবে ব্রাউজ করছেনএই সবকিছু অও বিশ্লেষণ করে এবং সেই অনুযায়ী ব্র্যান্ডগুলোকে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে।

যখন কোনো ব্র্যান্ড অওএর মাধ্যমে গ্রাহকদের পছন্দ, অভ্যাস, এবং অনুভূতির ওপর ভিত্তি করে ব্যক্তিগতকৃত অভিজ্ঞতা তৈরি করে, তখন সেই অভিজ্ঞতা গ্রাহকদের কাছে আরও বেশি অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে। এটি শুধুমাত্র পণ্য বিক্রির কথা নয়, বরং একটি সম্পর্কের বিষয়। উদাহরণস্বরূপ, Netflix AIএর মাধ্যমে গ্রাহকদের দেখা কন্টেন্টের ভিত্তিতে পরবর্তী দেখার জন্য সুপারিশ দেয়, যা গ্রাহকের জন্য অভিজ্ঞতাকে আরও ব্যক্তিগত করে তোলে।

AIএর সাহায্যে ডেটাচালিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ: H2H মার্কেটিংএর ক্ষেত্রে AI সবচেয়ে বড় সুবিধা নিয়ে এসেছে ডেটা বিশ্লেষণের মাধ্যমে। AI বড় পরিমাণে ডেটা সংগ্রহ করতে পারে এবং সেই ডেটার উপর ভিত্তি করে কৌশল তৈরি করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কোনো গ্রাহকের কেনার প্যাটার্ন, ব্রাউজিং ইতিহাস, এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কার্যকলাপের উপর ভিত্তি করে অও অনুমান করতে পারে গ্রাহক ভবিষ্যতে কী কিনতে পারে, কী ধরনের পণ্য তাদের জন্য প্রাসঙ্গিক।

AIএর মাধ্যমে এই ডেটা বিশ্লেষণ কেবল ব্র্যান্ডের জন্য নয়, গ্রাহকের জন্যও উপকারী। গ্রাহক তার প্রয়োজনের সাথে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ অফার পায় এবং ব্র্যান্ডও তার জন্য সঠিক পণ্য বা সেবা প্রস্তাব করতে পারে। এই সমন্বয় একটি গভীর এবং দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক গড়ে তোলে।

আচরণগত বিজ্ঞান: মানবিক সম্পর্ক এবং AIএর সম্মিলিত প্রভাব: আচরণগত বিজ্ঞান মূলত মানুষের আচরণ এবং মানসিক প্রক্রিয়াগুলোর গভীর বিশ্লেষণ করে। H2H মার্কেটিং এবং AIএর ক্ষেত্রে আচরণগত বিজ্ঞানের প্রভাব অত্যন্ত গভীর। এটি মানুষের আবেগ, অনুভূতি, এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া বোঝার মাধ্যমে কৌশল তৈরি করতে সাহায্য করে।

আচরণগত বিজ্ঞানের সাহায্যে কাস্টমাইজড মার্কেটিং: আচরণগত বিজ্ঞান এবং AIএর সমন্বয় কাস্টমাইজড মার্কেটিংয়ের নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। এখন ব্র্যান্ডগুলো গ্রাহকের আবেগ এবং মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে কৌশল তৈরি করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, গ্রাহক যদি কোনো পণ্যের প্রতি ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখায়, তাহলে ব্র্যান্ড সেই পণ্য সম্পর্কিত আরও তথ্য প্রদান করতে পারে বা গ্রাহকের জন্য বিশেষ অফার তৈরি করতে পারে।

এই ধরনের কাস্টমাইজড অভিজ্ঞতা গ্রাহকের মনে একটি বিশেষ স্থান তৈরি করে এবং সেই ব্র্যান্ডের প্রতি তার অনুগত্য বৃদ্ধি করে।

AI এবং আচরণগত বিজ্ঞানের একীভূত প্রয়োগ: AI এবং আচরণগত বিজ্ঞানের সম্মিলিত প্রয়োগের মাধ্যমে ব্র্যান্ডগুলো গ্রাহকের অভিজ্ঞতাকে আরও সমৃদ্ধ এবং মানবিক করে তুলতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, AI গ্রাহকের পূর্বের আচরণ বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য কার্যক্রম সম্পর্কে পূর্বাভাস দিতে পারে, যা কেবলমাত্র একটি ক্রয় নয়, বরং একটি সম্পর্ক তৈরি করতে সাহায্য করে। আচরণগত বিজ্ঞানের সাহায্যে ব্র্যান্ডগুলো গ্রাহকের সাথে এমনভাবে যোগাযোগ করতে পারে, যা তাকে মানসিকভাবে আরামদায়ক এবং নিরাপদ বোধ করায়। এটি কেবলমাত্র বিক্রির ক্ষেত্রেই নয়, সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

জাতিসংঘের (UN) প্রয়োগ: বিশ্বব্যাপী পরিবর্তন: জাতিসংঘ (NU) বর্তমান সময়ে AI এবং আচরণগত বিজ্ঞানের প্রয়োগের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী পরিবর্তন আনার জন্য কাজ করছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে AI এবং আচরণগত বিজ্ঞানের সাহায্যে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, এবং সামাজিক নিরাপত্তার উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে। জাতিসংঘের বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে অও এবং আচরণগত বিজ্ঞানের ব্যবহার মানুষের জীবনকে আরও সহজ এবং উন্নত করছে।

স্বাস্থ্য খাতে AIএর প্রয়োগ: স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে AI এবং আচরণগত বিজ্ঞানের সম্মিলিত প্রয়োগের মাধ্যমে রোগের পূর্বাভাস, রোগ প্রতিরোধ এবং উন্নত চিকিৎসা সম্ভব হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, AI রোগীদের স্বাস্থ্য ডেটা বিশ্লেষণ করে স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে পূর্বাভাস দিতে পারে, যা ডাক্তারদের দ্রুত এবং সঠিক চিকিৎসা দিতে সাহায্য করে।

শিক্ষা খাতে AIএর প্রভাব: জাতিসংঘের শিক্ষা খাতেও AIএর প্রয়োগের মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শিক্ষার প্রসার ঘটানো সম্ভব হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, AIএর সাহায্যে বিভিন্ন ভাষার ছাত্রছাত্রীরা একে অপরের সাথে সহজেই যোগাযোগ করতে পারছে এবং জ্ঞান অর্জন করতে পারছে।

AI, H2H মার্কেটিং এবং আচরণগত বিজ্ঞানের সম্মিলিত ভবিষ্যৎ: আচরণগত বিজ্ঞান, AI, এবং H2H মার্কেটিংএর সম্মিলিত প্রয়োগ আগামী দিনের ব্যবসায়িক এবং সামাজিক ক্ষেত্রগুলোতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে চলেছে। এই তিনটি ক্ষেত্র একসঙ্গে কাজ করার মাধ্যমে ব্র্যান্ডগুলো শুধু পণ্য বিক্রি নয়, বরং মানুষের সাথে গভীর এবং মানবিক সম্পর্ক তৈরি করতে পারছে।

জাতিসংঘের মতো সংস্থাগুলো বিশ্বব্যাপী এই প্রযুক্তির ব্যবহার করে মানব কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে, যা ভবিষ্যতে আরও বড় পরিসরে উন্নয়ন এবং পরিবর্তনের সূচনা করবে।

H2H মার্কেটিং, AI এবং আচরণগত বিজ্ঞানের এই নতুন যুগের সূচনা বিশ্বকে নতুনভাবে দেখতে এবং বোঝাতে সাহায্য করবে। এর মাধ্যমে ব্যবসা এবং মানুষের সম্পর্কের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ এবং প্রযুক্তির সংমিশ্রণ ঘটবে, যা ভবিষ্যতে একটি সফল এবং মানবিক সমাজ গঠনে সাহায্য করবে।

এই নতুন যুগে, H2H মার্কেটিং, AI, এবং আচরণগত বিজ্ঞান কেবল ব্যবসায়িক সফলতা নয়, মানবিক উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। প্রযুক্তি এবং মানবিক মূল্যবোধের সমন্বয়ে ভবিষ্যতের মার্কেটিং এবং সমাজ একটি নতুন দিগন্তে পৌঁছাবে।

লেখক : সিনিয়র ম্যানেজার, স্ট্র্যাটেজিক সেলস,

এলিট পেইন্ট এন্ড কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রীজ লিঃ

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধসমকালের দর্পণ