পাইপলাইনে তেল খালাস কবে

টেকনিক্যাল ও আইনি জটিলতা অগ্নিকাণ্ডে অচল বিএসসির দুটি অয়েল ট্যাংকার এসপিএম চালু করতে সময় লাগবে: বিপিসি

হাসান আকবর | রবিবার , ১৩ অক্টোবর, ২০২৪ at ৮:৩৪ পূর্বাহ্ণ

দেশের জ্বালানি তেল লাইটারিংয়ে নিয়োজিত বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিএসসি) দুটি জাহাজ অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণে অচল হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে পাইপলাইনের মাধ্যমে জ্বালানি তেল খালাসের জন্য নির্মিত সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং বা এসপিএম কবে চালু হবে তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। কিন্তু নানা আইনি এবং টেকনিক্যাল প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে যাওয়ায় ৭ হাজার কোটির বেশি টাকা ব্যয়ে নির্মিত প্রকল্পটি ঠিক কবে নাগাদ চালু হবে তা নিয়ে সংশয় ব্যক্ত করা হয়েছে। কয়েকদিন ধরে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তার সাথে কথা বলে বিদ্যমান অনিশ্চয়তা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে সরকার পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে একটি বিশেষ আইন বাতিল হওয়ায় এই অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে।

সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশে বর্তমানে বছরে ৭০ লাখ টন জ্বালানি তেলের চাহিদা রয়েছে। ১৩১৪ লাখ টন অপরিশোধিত (ক্রুড অয়েল) এবং ৫৬৫৭ লাখ টন পরিশোধিত (রিফাইনড অয়েল) জ্বালানি তেল আমদানি করে চাহিদা মেটানো হয়। আমদানিকৃত ক্রুড অয়েল রাষ্ট্রায়ত্ত একমাত্র পরিশোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারিতে পরিশোধনের পর তেল বিপণন কোম্পানির মাধ্যমে বাজারজাত করা হয়। দেশের প্রয়োজনীয় সব তেল আমদানি করা হয় সাগরপথে। আমদানিকৃত তেল নিয়ে আসা বড় বড় মাদার ভ্যাসেল বন্দর চ্যানেলে বার্থিং নিতে পারে না। এসব জাহাজ বহির্নোঙরে অবস্থান করে বিপিসির লাইটারেজ জাহাজ এমটি বাংলার জ্যোতি এবং এমটি বাংলার সৌরভের মাধ্যমে তেল লাইটারিং করে। এ প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ। একেকটি মাদার ভ্যাসেল থেকে তেল খালাস করতে ১১/১২ দিন সময় লাগে। বিপুল অর্থ জড়িত থাকে এই প্রক্রিয়ায়। এতে শুধু লাইটারেজ জাহাজের ভাড়া নয়, একইসাথে দিনের পর দিন অপেক্ষায় থাকা মাদার ভ্যাসেলগুলোর ভাড়া বাবদও বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হয় বিপিসিকে।

এই অবস্থায় জাহাজ থেকে তেল খালাসে সময় এবং অর্থ সাশ্রয় করতে গভীর সাগরে একটি ‘সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উইথ ডাবল পাইপলাইন’ নির্মাণের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ২০১০ সালে প্রকল্পটি একনেকের অনুমোদন লাভ করলেও অর্থাভাবে ঝুলেছিল। পরে প্রকল্পটিতে অর্থায়নে চীন সরকার আগ্রহ দেখায়। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরকালে প্রকল্পটি নিয়ে আলোচনা এবং পরে বাংলাদেশ সরকারের সাথে চীনের এঙ্মি ব্যাংকের চুক্তি হয়।

৫৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার বা সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ সহায়তায় ‘ইনস্টলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উইথ ডাবল পাইপলাইন’ (এসপিএম) শীর্ষক প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়। এ প্রকল্পের আওতায় চায়না পেট্রোলিয়াম ব্যুরো (সিপিবি) বঙ্গোপসাগরের মহেশখালীর পাশে গভীর সমুদ্রে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং নির্মাণ এবং ইস্টার্ন রিফাইনারি পর্যন্ত অফশোর এবং অনশোর মিলে মোট ২২০ কিলোমিটার ডাবল পাইপলাইন বসানোর কাজ করছে। এর মধ্যে ১৪৬ কিলোমিটার সাগরের তলদেশে এবং ৭৪ কিলোমিটার স্থলভাগের উপরে নির্মাণ করা হয়। কঙবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ী এলাকা থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণপশ্চিম গভীর সমুদ্রে মুরিং পয়েন্টটি অবস্থিত। গভীর সমুদ্রের সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) থেকে ৩৬ ইঞ্চি ডায়ার দুটি পাইপলাইন মহেশখালীর স্টোরেজ ট্যাংক পর্যন্ত এবং মহেশখালীর স্টোরেজ ট্যাংক থেকে ইস্টার্ন রিফাইনারি পর্যন্ত ১৮ ইঞ্চি ডায়ার দুটি পাইপলাইন স্থাপন করা হয়।

সাগরের ওই মুরিং পয়েন্টে জ্বালানি তেল বোঝাই বড় বড় মাদার ভ্যাসেল বার্থিং নিয়ে পাইপলাইনে জ্বালানি তেল খালাস করবে। মুরিং পয়েন্ট থেকে পাইপলাইনে তেল আসবে মহেশখালীর কালারমারছড়া স্টোরেজ ট্যাংকে। সেখান থেকে পাম্প স্টেশনের মাধ্যমে পাম্প করে পাইপের মাধ্যমে তেল পাঠানো হবে ইস্টার্ন রিফাইনারির ট্যাংকে। দুটি পাইপের একটি দিয়ে ক্রুড অয়েল এবং অপরটি দিয়ে রিফাইনড অয়েল ইস্টার্ন রিফাইনারিতে পৌঁছানো হবে। এই প্রক্রিয়ায় ৪৮ ঘণ্টায় ১ লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন অপরিশোধিত এবং ২৮ ঘণ্টায় ৭০ হাজার টন পরিশোধিত ডিজেল খালাস করা যাবে। এর বার্ষিক খালাসের ক্ষমতা হবে ৯০ লাখ টন। মহেশখালীতে ৯০ একর জায়গায় ছয়টি স্টোরেজ ট্যাংক ও পাম্প স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে। ছয়টি স্টোরেজ ট্যাংকের তিনটিতে পরিশোধিত এবং অন্য তিনটিতে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল মজুত করা হবে। প্রতিটি পরিশোধিত স্টোরেজ ট্যাংকারের ধারণক্ষমতা ৬০ হাজার ঘনমিটার এবং অপরিশোধিত স্টোরেজ ট্যাংকারের ধারণক্ষমতা ৩৫ হাজার ঘনমিটার।

শুরুতে প্রকল্প ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪ হাজার ৯৩৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। মূল অনুমোদিত প্রকল্পটিতে ২০১৫ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রকল্পটির কাজ সময়মতো শুরু করতে না পারায় দিনে দিনে প্রকল্প ব্যয় বাড়তে থাকে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, প্রকল্প ব্যয় বেড়ে ৭ হাজার ১২৪ দশমিক ৩৯ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে।

ইতোমধ্যে প্রকল্পটির কমিশনিং করা হয়েছে। এসপিএমের মাধ্যমে জ্বালানি তেল খালাস শুরু হলে বিপিসির বছরে অন্তত ৮শ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু কমিশনিংয়ের পর দুই জাহাজ জ্বালানি তেল খালাস করা হলেও গত প্রায় সাত মাস ধরে পাইপলাইনে আর জ্বালানি তেল খালাস করা হচ্ছে না। ইতোমধ্যে দেশে জ্বালানি তেলে লাইটারিংয়ে নিয়োজিত বিএসসির দুটি জাহাজ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডে অচল হয়ে গেছে। জাহাজ দুটিকে বহর থেকে প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বিএসসি ৩০ হাজার টন ধারণক্ষমতার একটি বিদেশি জাহাজ ভাড়ায় এনে বিপিসির তেল লাইটারিং করছে; যাতে লক্ষ লক্ষ ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হয়ে যাচ্ছে।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এসপিএম কেন সচল হচ্ছে না তা নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এত বড় অংকের টাকা খরচ করে পাইপলাইনসহ যাবতীয় অবকাঠামো গড়ে তোলার পরও কেন পাইপে তেল খালাস না করে বিদেশি জাহাজ ভাড়া করে লাইটারিং করতে হচ্ছে? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বিপিসির শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তার সাথে দৈনিক আজাদীর কথা হয়।

বিপিসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, এসপিএম চালু হবে এটা নিশ্চিত। তবে কবে নাগাদ চালু হবে সেটা অনিশ্চিত। কারণ এই পাইপলাইনে তেল আনার সাথে লোকবল এবং অভিজ্ঞতা প্রয়োজন; যা বিপিসির কাছে নেই। প্রকল্পটির পরামর্শক ছিল আবুধাবির আইএলএফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনসালটেন্সি নামে একটি প্রতিষ্ঠান। তারা প্রকল্পটি নির্মাণকালে বিপিসির পরামর্শক হিসেবে দেখভাল করে। প্রকল্পটি কীভাবে এবং কাদের দ্বারা পরিচালিত হলে বিপিসির স্বার্থ রক্ষা হবে সেই পরামর্শও তারা দিয়েছিল। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সাথে বিপিসির আলোচনায় মোটামুটি চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল যে, প্রকল্পটি তিন বছর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান চায়না পেট্রোলিয়াম ব্যুরো (সিপিবি) পরিচালনা করবে। অর্থাৎ তেল খালাসের কার্যক্রম তারাই চালাবে। ‘বিদ্যুৎ বিশেষ বিধান আইন২০১০’ এর আওতায় উক্ত প্রতিষ্ঠানকে ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হবে। কিন্তু সরকার পতনের পর ওই বিশেষ আইনটি বাতিল করা হয়। এর ফলে এখন কাউকে টেন্ডার ছাড়া সরাসরি কার্যাদেশ দেওয়ার আর সুযোগ নেই। ফলে নতুন করে দেশের প্রচলিত পিপিআর অনুসরণ করে টেন্ডার আহ্বান করে ঠিকাদার নিয়োগ করতে হবে।

এটি সম্পন্ন করতে দীর্ঘ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে জানিয়ে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেছেন, পাইপলাইনে জ্বালানি তেল খালাসের কার্যক্রম শুরু করতে আরো কিছুটা সময় লাগবে। কিন্তু কতদিন লাগবে সেই সম্পর্কে তিনি কিছু বলতে পারেননি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএমন রাষ্ট্র গঠন করব, যেন দুনিয়ার সামনে গর্ব করতে পারি
পরবর্তী নিবন্ধক্যান্সারের বিস্তার ঠেকানোর নতুন উপায় মিলল