মেয়ে হয়ে জন্মানোই আজন্ম পাপ এমনটাই ভাবতো হতো বাঙালি নারীকে। এই উপমহাদেশে সবসময়েই নারীকে অবলা আর দুর্বল ভাবা হয়। কিন্তু নিজের সামাজিক অবস্থান, পারিবারিক কঠোরতা কোনো কিছুই যাকে সাহিত্যচর্চা থেকে দূরে রাখতে পারেননি, তিনি এই উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক আশাপূর্ণা দেবী।
মায়ের অনেকগুলো কন্যা সন্তানের পর আবারো আশাপূর্ণা জন্মগ্রহণ করায় তাদের ঠাকুরমা উপহাস করে বলেছিলেন, “মেয়ের স্বাদ পূর্ণ হয়েছে, আর মেয়ে নয়।” তাই তাঁর নাম রাখা হল, ‘আশাপূর্ণা’। আধুনিক সমাজে নারীর গুরুত্ব, তাদের অধিকার, দুঃখ–বেদনার কথাও তুলে ধরেছেন তিনি।
মেয়েদের প্রতি পদে পদে এত অবহেলা একদিন তাঁর সাহিত্যে প্রথম প্রতিশ্রুতি–র পথ বেয়ে বিদ্রোহিনী ‘সুবর্ণলতা’ হয়ে ‘বকুলকথা’য় এসে মুক্তির সন্ধান পেল। ভাইরা পড়তেন আর তা শুনে শুনে শিখলেন বর্ণপরিচয়। আর সেই তিনি লেখালিখি করে পেলেন সাহিত্যে রবীন্দ্র পুরস্কার, জ্ঞানপীঠ পুরস্কার, পদ্মশ্রী, বিশ্বভারতীর দেশিকোত্তম উপাধি ।
‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’তে তিনি লেখেন, “নারী জীবন তো দেখলাম, পরের জন্মে পুরুষ হয়ে দেখব কেমন লাগে।”
শত বিরোধিতার পরেও থেমে থাকেননি দুরন্ত আশাপূর্ণা। ছোটবয়স থেকেই ভাইদের সাথে খেলা করা, ঘুড়ি উড়ানো, ক্যারাম খেলা ছাড়াও মাটি ও কাঠ দিয়ে পুতুল বানাতেন। নিজের দুরন্তপনার কথা নিজেই উল্লেখ করে আশাপূর্ণা বলেছেন, “খেলার দাপটে, আইওডিনের শিশি দু–চার দিনে খতম, হাত–পায়ের কোনো না কোনো স্থানে ছেড়া ন্যাকড়ার ব্যান্ডেজ বাঁধা আছেই।”
যতই দস্যিপনা থাকুক, পড়াশোনার প্রতি আশাপূর্ণার ছিল তীব্র আগ্রহ। তবে মেয়ে হয়ে জন্ম নেয়াটাই যেন কাল হয়ে দাঁড়ালো। ঠাকুরমার কঠোর নিষেধ এবং পারিবারিক নানা বিধিনিষেধের বেড়াজালে পড়ে স্কুলে গিয়ে পড়াশোনা করা ছিল বারণ। ভাইদের বই পড়ে নিজের প্রবল ইচ্ছাকে শক্তিতে পরিণত করেছিলেন ধীরে ধীরে।
ঠাকুরমার কড়া শাষণের কথা মনে করে আশাপূর্ণা বলেছিলেন, “স্কুলে পড়লেই যে মেয়েরা বাচাল হয়ে উঠবে, এই তথ্য আর কেউ না জানুক আমাদের ঠাকুরমা ভালোভাবেই জানতেন। এবং তার মাতৃভক্ত পুত্রদের পক্ষে ওই জানার বিরুদ্ধে কিছু করার শক্তি ছিল না।”
আমাদের দেশে মেয়েদের জীবন এখনও কি খুব একটা পরিবর্তন হয়েছে? নিজের ইচ্ছেকে সবাই কিন্তু কাজে লাগাতে পারে না। কোথাও যেন একটা শেকল বাধা থাকে নারীর জীবনে।
কিশোরী আশাপূর্ণা একদিন রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখলেন। কবি সেই চিঠি পড়ে বুঝেছিলেন, আগামীদিনের বাংলাসাহিত্যে এক সন্ধ্যাতারা ফুটতে চলেছে! চিঠির জবাবে কবি লিখলেন, “আশাপূর্ণা, তুমি সম্পূর্ণা।”
চৌদ্দবছর বয়সে বিয়ে হয়ে গেল আশাপূর্ণার। শ্বশুরবাড়িতেও ছিল প্রচন্ড রক্ষণশীলতা।
সেখানে মেয়েরা নভেল পড়বে, গল্প লিখবে এই ভাবাও অকল্পনীয়! আশাপূর্ণা দেবীর বড় ভরসা ছিলেন তাঁর স্বামী। সংসারে সব ঝামেলা মিটিয়ে, সন্তানদের খাইয়ে–দাইয়ে, ঘুম পাড়িয়ে, রাতে হ্যারিকেনের আলোয় লিখতে বসতেন আশাপূর্ণা। পরবর্তীকালে সেই দুঃখের কাহিনি বাংলা সাহিত্যে ফুটে উঠলো তাঁর কথায় ও অজস্র লেখায়।
শিশুসাহিত্যসহ সাহিত্যের নানা দিকে অবদান রেখে লিখেছিলেন দুইশটিরও বেশি গ্রন্থ। এসব বই আবার অনুবাদ হতো ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন ভাষাসহ নানা দেশের ভাষায়। এরপর সাহিত্যের সব থেকে বড় পুরস্কার এলো “জ্ঞানপীঠ”।
জ্ঞানপীঠ পাওয়ার পর তাঁর স্বামী বলেছিলেন, আজ আমার ইচ্ছে করছে সারা কলকাতা মোমবাতির আলো দিয়ে সাজাই।
তবে সেদিন আশাপূর্ণা দেবীর স্বামী সারা বাড়ি মোমবাতি দিয়ে সাজিয়েছিলেন। নেমে এসেছিল, “আশাপূর্ণা দীপাবলি।”
আশাপূর্ণা দেবী জন্মগ্রহণ করেন ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দের ৮ জানুয়ারি (বাংলা ২৪ পৌষ, ১৩১৫) কলকাতায় মাতুলালয়ে। আদি নিবাস ছিল হুগলির বেগমপুরে। বাবার নাম হরেন্দ্রনাথ গুপ্ত এবং মায়ের নাম সরলাসুন্দরী দেবী। বাবা–মা দুজনেই ছিলেন শিল্প–সাহিত্যে অনুরাগী। এমনকি তাঁর বাবা হরেন্দ্রনাথ গুপ্ত কমার্শিয়াল আর্টিস্ট হিসেবে বেশ নাম করেছিলেন।
সরলাসুন্দরী দেবী সাহিত্যপাঠ নিয়ে মেতে থাকতেন । বাবা–মায়ের এই গুণগুলোই হয়তো পেয়েছিলেন আশাপূর্ণা দেবী, নয়তো অমন রক্ষণশীল পরিবেশে থেকেও লেখায় এমন প্রতিবাদের ঝড় তুলতে পারতেন না। নারীদের অধিকার নিয়ে কথা বলতে পারতেন না। তিনি কোনোদিনও স্কুলে যাননি। তবে তার মায়ের ইচ্ছেতেই ঘরেই পড়াশোনা করতেন আশাপূর্ণা। তাঁর বয়স যখন সাড়ে পাঁচ বছর, তখন তাঁর বাবা আপার সার্কুলার রোডের নিজস্ব বাসভবনে চলে আসেন। অল্প বয়স হলেও সেইসব স্মৃতি আশাপূর্ণার জীবন ও সাহিত্যে নানাভাবে ছাপ পড়েছিল।
বাবা–মা নানাভাবে ছেলেমেয়ের মনন বিকাশের চেষ্টা করতেন। তাই তো সাধনা, প্রবাসী, ভারতবর্ষ, সবুজপত্র, বঙ্গদর্শন, বসুমতী, সাহিত্য, বালক, শিশুসাথী, সন্দেশসহ প্রায় ১৬–১৭টি নানা ধরনের পত্রিকা নানা সময়ে বাড়িতে আসতো, আর দৈনিক পত্রিকা তো ছিলই। আশাপূর্ণার মা ছিলেন বিভিন্ন সাহিত্য পরিষদ এবং লাইব্রেরির সদস্য। এমনকি বাড়িতেও ছিল নানা ধরনের বইয়ের সম্ভার। এসব বই আশাপূর্ণাকে পরিপূর্ণ সাহিত্যপ্রেমী হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করেছে। বই পড়ার আনন্দ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, আমার ছেলেবেলাটা কেটেছে, একটি স্বর্গীয় জগতে, সংসারের ঊর্ধ্বে। বই পড়াই ছিল দৈনন্দিন জীবনের আসল কাজ।
আমাদের সমাজে অনেক শিক্ষিত মেয়েও সংসারের চাপে পড়ে সবকিছু থেকে দূরে সরে আসেন। অথচ সাহিত্যের প্রতি অগাধ ভালোবাসা নিয়েও সমান তালে সংসার চালিয়ে নেয়া সম্ভব, তাও প্রমাণ করেছিলেন তিনি। ১৯২৪ সালে, কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা কালিদাস গুপ্তের সাথে বিয়ে হয় আশাপূর্ণা দেবীর। তাঁদের ঘরে জন্ম নিয়েছিল দুই পুত্র আর এক কন্যা। সংসারেরের নানা ব্যস্ততার মাঝেও ভালো লেখক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন আশাপূর্ণা দেবী।
জানা যায় আশাপূর্ণা দেবী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে রবীন্দ্রসংগীত শুনতে পছন্দ করতেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আশাপূর্ণা দেবীর একটি প্রিয় রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে শুনিয়েছিলেন তাঁর বাড়িতে এসে।
“ধায় যেন মোর সকল ভালবাসা
প্রভু, তোমার পানে, তোমার পানে।”
১৩ জুলাই ১৯৯৫ সালে আশাপূর্ণা দেবী মৃত্যুবরণ করেন।