হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (ক) : আরাধ্য গন্তব্যে

মুহাম্মদ ওহীদুল আলম | শুক্রবার , ১১ অক্টোবর, ২০২৪ at ৭:২৫ পূর্বাহ্ণ

আল্লাহ্‌র অলিদের বিষয়ে আলোচনার সবচেয়ে বড় ইতিবাচক দিক হচ্ছে মানুষকে তা ক্রমশ আল্লাহ্‌র দিকেই নিয়ে যায়। আল্লাহ্‌র যে কোন একজন অলির আলোচনায় অনিবার্যভাবে আপনাকে কুরআনের প্রসঙ্গ টানতে হবে।

কুরআনের প্রসঙ্গ এলে আপনাকে অনিবার্যভাবে আল্লাহ্‌র হাবিব হযরত রসুলে মকবুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর স্মরণ করতে হবে। আর তাঁকে স্মরণ করতে গেলে স্বাভাবিক, স্বতঃস্ফূর্ত ও অনিবার্যভাবে আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের জিকির করতে হবে। সৃষ্টির জীবনে আল্লাহ্‌র স্মরণ তথা জিকিরই প্রধান ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ।

মানুষের শারীরিক চিকিৎসার চেয়ে ক্বলবের চিকিৎসা অধিক জরুরি। আল্লাহ্‌র অলিরা হচ্ছেন মানুষের মনোরোগের চিকিৎসক। যারা তাঁদের সান্নিধ্যে আসে তাদের আত্মা কলুষমুক্ত হয়। আর কলুষমুক্ত আত্মা নিয়ে যে মানুষ আল্লাহ্‌র দরবারে উপস্থিত হতে পারবে সে মানুষই সফলকাম। কিন্তু সমগ্র দুনিয়া আত্মার চিকিৎসার চেয়ে শরীরের চিকিৎসায় বেশি আগ্রহী। পার্থিব সম্পদ অর্জনের লালসা তাদেরকে কবরে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ব্যতিব্যস্ত রাখে। মানুষের এ নাছোড় বৈশিষ্ট্যের কথা আল্লাহ্‌ তাঁর কালামে পাকের ১০২ নং সূরায় (সূরা আততাকাসুর) প্রাঞ্জল ভাষায় ব্যক্ত করেছেন। অনেক মানুষই আছে যারা শুধু পার্থিব সমস্যায় পড়ে অলিদের দরবারে যায়। আত্মাকে কলুষমুক্ত করার জন্য কম সংখ্যকই যায়। সে কম সংখ্যকই ভাগ্যবান। পৃথিবীতে তাই অলির সংখ্যা যেমন সীমিত তেমনি তাঁদের প্রকৃত অনুসারীও সীমিত।

সে সীমিত সংখ্যক অলিদের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম অলি হচ্ছেন হযরত শাহানশাহ্‌ সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (.) (১৯২৮১৯৮৮)। তিনি তাঁর পূর্বসুরীদের মত মানুষের আত্মার চিকিৎসায় অগ্রণী ছিলেন।

সমসাময়িকদের মধ্যে তাঁর খ্যাতি আকাশচুম্বী। মানুষের আত্মগরিমাকে তিনি ধূলায় মিশিয়েছেন। তিনি অবনত হয়েছিলেন মহান রব্বুল আলামীনের কাছে। তাই আল্লাহ্‌ তাঁর মর্যাদাকে সমুন্নত করেছেন মানুষের কাছে। আল্লাহ্‌ প্রেমে বিভোর থাকাই ছিল তাঁর সার্বক্ষণিক বৈশিষ্ট্য। স্বল্পকালীন স্বাভাবিক অবস্থায় মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ত তাঁর সামনে। পার্থিব সমস্যাগ্রস্ত মানুষের দুর্দশা লাঘবে তখন তিনি ব্যবহার করতেন তাঁর আধ্যাত্মিক শক্তি। বিশ্ব মানবতার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসাই ছিল তাঁর কর্মকাণ্ডের নিয়ামক। এ কর্মকাণ্ডের মধ্যে প্রকাশ হয়ে পড়েছিল তাঁর বহু কারামত। কিন্তু নিজের ইচ্ছায় তিনি তা প্রকাশ করেন নি। আমাদের মনে হয় মানুষের বিশ্বাসকে দৃঢ় ভিত্তি দেয়ার জন্য আল্লাহ্‌ই তা প্রকাশের ব্যবস্থা করেছিলেন।

চট্টগ্রামের জনপ্রিয় পত্রিকা দৈনিক আজাদীতে ‘ভূগোলের গোল’ কলাম লেখক ডা. কিউ এম অহিদুল আলম, ডাক্তার বা লেখক হিসাবে তখনও তেমন প্রসার লাভ করেন নি। তিনি মেডিসিনে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে বুলগেরিয়া থেকে মাত্র কিছুদিন হল দেশে ফিরেছেন। চট্টগ্রামের গোল পাহাড়ের মোড়ে তিনি চেম্বার করছেন। সপ্তাহের একদিন নিজ বাড়ি (ধলই, হাধুরখীল, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম) ও একদিন নাজিরহাটে ফ্রি চিকিৎসা করেন। এমনি এক শীতের দিনে শাহানশাহ্‌ সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (রহ.) তাঁকে ডেকে পাঠান। তখন তাঁর কাছে কিছু কিছু রোগী আসতে শুরু করেছেন। ডাক্তারী পেশার শুরুতে রোগীদের মধ্যে আস্থা সৃষ্টির জন্য চেম্বারে নিয়মিত উপস্থিত থাকাই শর্ত। বাবাজানের খবর পেয়ে তিনি ইতস্তত করছেন। গেলে ফিরে আসতে দেরি হবে। যাতায়াত করতে হবে টেক্সিতে। রোগী আসলে ফিরে যাবে। ইত্যাদি ছিল তাঁর ইতস্তত করার কারণ। তথাপি ডাক্তার সাহেব তাঁর মাকে জিজ্ঞেস করেন মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফ যাবেন কিনা। মা বললেন: ‘তোমার কাছে খবর দিয়েছেন তিনি। অবশ্যই তুমি যাবে।’ দ্বিধা জয় করে ডাক্তার সাহেব ছুটলেন মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফে। গিয়ে দেখেন যাঁকে খবর দিয়ে আনা হয়েছে তাঁর প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপও নেই বাবাজানের। যেন তাঁকে চেনেনই না। প্রমাদ গুণলেন ডাক্তার। চিন্তা করলেন কিরে বাবা হলোটা কী? দরবারে উপস্থিত একজন ভক্তকে তিনি নিজের কথাটা জানালেন। উক্ত ভক্ত ছিলেন ডাক্তার সাহেবের পূর্ব পরিচিত। তিনি বাবাজানের কাছে ডাক্তারের কথা তুললেন। বাবাজান বললেন: ‘উনার তো রোগী টোগী মারা যাবে। আবার যাতায়াতও খরচ সাপেক্ষ।’

ভক্তটি যা বোঝার বুঝলেন। বললেন: ‘বাবাজান, মানুষের তো ভুল হতে পারে। আপনি ডাক্তার সাহেবকে মাফ করে দেন।’ পরে ডাক্তারের সাথে বাবাজান কথা বলেছিলেন। তিনি তাঁর হাত দেখিয়ে বলেছিলেন: ‘আমার এলার্জি হয়েছে। আপনি ঔষধ দেন।’

তিনি কি শুধুমাত্র নিজের চিকিৎসার প্রয়োজনে ডাক্তারকে ডেকেছিলেন না ডাক্তারের ভবিষ্যত পথ সমৃদ্ধ করার সুযোগ উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন সে কথা এখনও রহস্যময়। ডাক্তার কিউ এম অহিদুল আলম এর কাছেও ঘটনাটি একটি রহস্যময় অভিজ্ঞতা হিসাবে বিবেচিত। কিভাবে জেনেছিলেন তিনি তাঁর মনের গোপন খবর? যেমন আরেক রহস্যময় অভিজ্ঞতা হয়েছিল মোহাম্মদ আয়ুব আলীর। ১৯৭৬ সাল। হাটহাজারী কলেজ থেকে বি এ পরীক্ষা দেবেন তিনি। ১৯৭২৭৩ এর নকলের ছড়াছড়ির পর মরহুম অধ্যাপক আবুল ফজলের দৃঢ়তায় পরীক্ষা পাসের হার ৯৫ ভাগ থেকে ১ বা ২% এ নেমে এসেছে। তখন তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর। পরীক্ষার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন মোহাম্মদ আয়ুব আলী দোয়া নেয়ার আশায় জিয়া বাবার দরবারে পরীক্ষা শুরুর পূর্বে হাজির হয়েছিলেন। দেখেন অনেক লোক যথারীতি জড়ো হয়েছে দরবারে। বাবা কিন্তু ভেতরের ঘরে বিছানায় শোয়া। জানালা দিয়ে একটুখানি যা চোখে পড়ে তাতে দেখা যায় তিনি অতি ধীরে স্বীয় বাম পা দোলাচ্ছেন। দর্শনার্থীদের ফিরিয়ে দিচ্ছেন খাদেমগণ। বলছেন বাবা খুবই ‘জুলজালা’ অবস্থায় আছেন। মানুষ দেখলে ক্ষেপে যাবেন। আপনারা সবাই আজ ফিরে যান। কিন্তু মানুষের যা স্বভাব। যাব যাব করেও রয়ে গেছেন অনেক দর্শনার্থী। শেষ পর্যন্ত প্রায় নিরাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন তাঁরা। আয়ুবও তাঁদের দলে। হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজে একটু খানি পেছন ফিরেই তিনি দেখতে পেলেন বাবাজান তাঁকে বলছেন আস্‌সালামু আলায়কুম। প্রায় অপ্রস্তুত আয়ুব প্রথমে সালাম দেবার সুযোগ যেমন পাননি, তেমনি সালামের জবাবও দিতে পারেননি। তিনিও প্রায় ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলে ওঠলেন: আস্‌সালামু আলায়কুম। বাবাজান বললেন : ‘আল্লাহ্‌র শোহরত। যান।’ ইতিমধ্যে লোকজন হুড়মুড় করে ফিরে আসছেন। কিন্তু ততক্ষণে বাবাজান আবার ঢুকে পড়েছেন হুজরা শরীফে। দরোজা যথারীতি খিলবদ্ধ। আয়ুবকে ঘিরে ধরলেন অন্যান্য দর্শনার্থী। কী বললেন আপনাকে? কী নিয়তে এসেছিলেন আপনি? সবার মুখে এ ধরনেরই প্রশ্নাবলী। অথচ আয়ুব ভাবছেন: কিছুইতো বলতে পারিনি।

কিছুইতো বলা হলোনা। তথাপি তাঁর মনে তাৎক্ষণিক ভাবে জেগে ওঠল একটি স্থির চিত্রকল্প। নদী পারে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। ওপারে যাবার আশায়। বাবাজান যেন তাঁকে নৌকায় তুলে দিয়ে একটু ঠেলা দিয়ে বললেন: আল্লাহ্‌র শোহরত।

১৯৭৬ সালে হাটহাজারী কলেজ থেকে একটি মাত্র ছাত্র বি এ পরীক্ষায় পাস করেছিলেন। তিনি মোহাম্মদ আয়ুব আলী। তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম কোর্টের একজন অ্যাডভোকেট। তিনি ইন্তিকাল করেছেন ১৫ মার্চ ২০২১ সালে।

মানুষকে মুগ্ধ করার জন্য আমরা এ দু’টো ঘটনার উল্লেখ করিনি। এর চেয়ে চমকপ্রদ ঘটনার বিবরণ আপনারা তাঁর জীবনীতে পাবেন। আমাদের বলার উদ্দেশ্য হল যে কঠোর সাধনা বলে তিনি এ রহস্যময় শক্তির অধিকারী হতে পেরেছিলেন তৎপ্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। যে কঠিন রিয়াজতসাধনা তাঁকে স্রষ্টার সান্নিধ্যে নিয়ে গিয়েছিল সে সাধনার ছিটেফোঁটা হলেও নিজেদের জীবনে রপ্ত করা। আল্লাহ্‌র দিকে ক্রমাগত অভিযাত্রা ছাড়া মানুষের মুক্তির আর কোন পথ নেই। আল্লাহ্‌ ছাড়া বান্দার দ্বিতীয় কোন গন্তব্য নেই। শাহানশাহ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (.) এর সাধনা ছিল সে গন্তব্যের পথে হাঁটা এবং আমাদের মন বলে তিনি সে পরম আরাধ্য গন্তব্যেই গেছেন পৌঁছে।

লেখক : প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধমধ্যপ্রাচ্য সংকট নিরসনে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলের নীরবতা কেন
পরবর্তী নিবন্ধজুম’আর খুতবা