প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ৯ অক্টোবর, ২০২৪ at ৬:২৪ পূর্বাহ্ণ

বিগত ৫ দিনব্যাপী হজ্ব কার্যক্রমে ১১ যিলহজ্ব আজিজিয়া থেকে আসার পথে গাড়িতে এক সিআইপি এর সাথে আপনি আর তুমি ব্যবহার নিয়ে মত পার্থক্য হয়। জামারাতে পাথর মারতে গিয়ে বহুবার মুখোমুখি পদদলিত হয়ে হাজীর মৃত্যু ঘটেছিল। ফলে বিগত ১৫/২০ বছরের ব্যবধানে জামারাতের কাঠামো বিশাল এরিয়া নিয়ে পুনঃ নির্মাণ করা হয়। এতে বেশ কয়েক দিক দিয়ে জামারাতে পাথর মারা যায়। তৎমধ্যে যারা পবিত্র মক্কায় ফিরে আসবেন তাদের জন্য আজিজিয়া অন্যতম। এদিকে রয়েছে স্কেলেটর এবং ৩ দিনব্যাপী রাত দিন (১০,১১,১২) তারিখ বিনা ভাড়ায় শাটল বাস। ১১ যিলহজ্ব শাটল বাসের ঐ স্থানে এক মসজিদে মাগরিবের জামাত পড়া হয়। কাবা শরীফের দিকে আসতে গিয়ে দেখি যাত্রীবাহী একটি মাইক্রো যাচ্ছে। আমি ড্রাইভারের সাথে আরবীতে আলাপ করলাম। একজন থেকে কত নিবে, কোথায় নামিয়ে দিবে। ভাড়া সাব্যস্ত হল ৩০ রিয়াল। সামনে একজন লোক বসা। আমি ২য় যাত্রী হিসেবে পেছনের সারিতে ঢুকে দরজার বিপরীতে জানালার পাশে বসি।

সামনের এক লোক সম্ভবত ৫০ এর কম বেশি তথা মাঝ বয়সী হবে। কিছুটা মুখ তথা ঘাড় ঘুরিয়ে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় আমাকে বলল, ‘তুঁই ত ভালা আরবি হইত পার দেইর; এডে বহুত দিন লত আছ পানলার।’ অর্থাৎ তুমি ত ভাল আরবি বলতে পার দেখি; এখানে অনেক দিন ধরে আছো মনে হয়। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে আবার বলল। তুঁই কেন দুবাই তুবাই থাক পানলার, হজ্ব গইত্তে আইস্যও পানলার। অর্থাৎ তুমি মনে হয় দুবাই থাক। হজ্ব করতে আসছো মনে হয়। যাত্রীর অভাব নেই কয়েক সেকেন্ডে মাইক্রো পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। আমি তাকে স্পষ্ট দেখতেছি না বাম দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দ্বিতীয় বার কথা বললেন কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে।

প্রথমবার উত্তর না দিলেও দ্বিতীয় বার আমি উত্তর দিলাম। ‘অনে আরে তুঁই কা ব্যবহার গইত্তে লাইগ্‌গন’। অর্থাৎ আপনি আমাকে তুমি কেন ব্যবহার করতেছেন। এতে স্বভাবতই ভদ্র লোকের গায়ে লাগে। তখন তার কথার মোড় কিছুটা পরিবর্তন হয়ে গেল। তখন তিনি বললেন, ‘তুঁই নহই কি হইম, তোঁই ত ভদ্র ভাষা’। অর্থাৎ তুমি না বলে কি বলব, তুমি ত ভদ্র ভাষা। তখন আমি বললাম, তুই ব্যবহার করে নিজের সন্তানসন্ততি বা নিজের নিয়ন্ত্রণে কর্মকর্তাকর্মচারীকে। এতে তিনি মনে হয় আরও রেগে গেলেন। রেগে গিয়ে বললেন, ‘তুঁই আরে শিখদ্বেনে, আই গ্রুপ অব কোম্পানী চালাই।’ অর্থাৎ তুমি আমাকে শিখায়তেছ , আমি গ্রুপ অব কোম্পানী চালাই। তুমি ভদ্র ব্যবহার। আপনি বলে যে হিন্দু সম্প্রদায়।

আমি বাধ্য হয়ে কয়েক সেকেন্ড করে দু’বার উত্তর দিয়ে ছিলাম। মসজিদুল হারমের আন্ডারগ্রাউন্ডে যাত্রী নামিয়ে দিচ্ছিল। স্বভাবতই তিনি আগে নেমে গেলেন। আমি নামার সাথে সাথে তিনি আমার সম্পূর্ণ মুখোমুখি না হয়ে ঘাড় বাঁকা করে কড়া ভাষায় বললেন, তোই আরে নছিন, আই সিআইপি। অর্থাৎ তুমি আমাকে চিনতে পার নাই, আমি একজন সিআইপি। আমি তার সম্পূর্ণ পরিচয় জানতে চাইনি। হয়ত নামটা জিজ্ঞেস করেছি।

ড্রাইভারের সাথে আলাপকালীন তিনি হয়ত আমাকে লক্ষ্য করেন মুখে সাদা লম্বা দাড়ি বৃদ্ধলোক। আরবি বলতে পারতেছি, দুবাই বা অন্য কোন আরব রাষ্ট্র থেকে হজ্ব করতে এসেছি।

উপসাগরীয় ৬টি আরব রাষ্ট্রে প্রবাসীগণকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কিছুটা হীনম্মন্যতা চিন্তা করে অনেকে ভাল অবস্থানে থাকলেও। অপরদিকে ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ইত্যাদি দেশে নিম্নমানের কাজ কর্মে থাকলেও তাদেরকে উচ্চ মর্যাদায় মূল্যায়ন করা হয় বলে মনে করি। ভদ্র লোক হয়ত আমাকে দুবাইওয়ালা বৃদ্ধ জ্ঞানের অভাব ব্যক্তি হিসেবে চিন্তা করে।

হজ্ব করতে এসেছি দীর্ঘ ৪২ দিনের সফর। মানুষের সাথে সুন্দর ব্যবহার করা দায়িত্ব ও কর্তব্য। এটা আমাদের রাসূল (.)’র সুন্নত। যদিওবা আমাদের পক্ষে রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে। বৃদ্ধ বয়স হজ্বের সফরে আছি। সর্বোচ্চ চেষ্টা করতেছি ধৈর্য্যের সাথে অতি বিনয় রক্ষা করতে।

ব্যবহারে মানুষের নানাবিধ পরিচয় পাওয়া যায়। একে অপরকে সম্বোধনের মধ্যে একেক ভাষা হয় একেক রকম। বাংলা ভাষা তিনভাগে ভাগ মনে করি। তৎমধ্যে তুই, তুমি, আপনি। ইংরেজিতে একটি শব্দই তিন সম্বোধনকে নিয়ন্ত্রণ করতেছে। আর তা হল ইউ (ণড়ঁ) । আরবিতে ‘আন্তা’ দিয়ে তিন শব্দকে কভার করতেছে। এই ব্যাপারে সিআইপি সাহেব গ্রুপ অব কোম্পানী চালাচ্ছেন। তিনি হজ্ব করতে গেছেন মনে হয়। সরকারের সিআইপি তুমি আর আপনির ব্যবধান নিয়ে তার দৃষ্টি ভঙ্গিতে তিনি ভাল বুঝছেন।

তোমরা ইবাদত করবে আল্লাহর এবং তাঁর সঙ্গে কোন কিছু শরীক করবে না, আর সদ্ব্যবহার করবে মাতাপিতা, আত্মীয়স্বজন, ইয়াতীম, মিস্‌কীন, নিকট প্রতিবেশী, দূরপ্রতিবেশী, সাথীসঙ্গী, মুসাফির ও তোমাদের দাসদাসীদের প্রতি। নিশ্চয় আল্লাহ ভালবাসেন না দাম্ভিক, অহংকারীকে।” (সূরা নিসা৪ঃ৩৬)

আর হে আমার পুত্র! তুমি অবজ্ঞা ভরে মুখ ফিরিয়ে নেবে না মানুষ থেকে এবং বিচরণ করবে না পৃথিবীতে অহংকার ভরে, নিশ্চয় আল্লাহ পছন্দ করেন না কোন দাম্ভিক, অহংকারীকে। (সূরা লুকমান৩১ঃ১৮)

আল্লাহ পাক আরও বলেন, তোমরা আল্লাহ ছাড়া কারও উপাসনা করবে না, পিতামাতা, আত্মীয়স্বজন, এতিম ও দরিদ্রদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার তথা সুন্দর আচরণ করবে এবং মানুষকে সুন্দর কথা বলবে। (সূরা বাকারা: আয়াত:৮৩)

রাসূল (.) বলেছেন,‘তোমাদের মধ্যে যার আচারআচরণ সুন্দর, সে আমার সবচেয়ে বেশি প্রিয় এবং আমার সবচেয়ে কাছে থাকবে’। (সুনানে তিরমিজি)

তিনি আরও বলেন,‘ ভালো কথা সদকাস্বরূপ’। (সুনানে বায়হাকি)

নবী পাক (.) বলেন,‘কিয়ামতের দিন মুমিনের আমলনামায় সুন্দর আচরণের চেয়ে অধিক ভারী আমল আর কিছুই হবে না। যে ব্যক্তি অশ্লীল ও কটু কথা বলে আর অশোভন আচরণ করে, তাকে আল্লাহ তাআলা ঘৃণা করেন। আর যার ব্যবহার সুন্দর, সে তার ব্যবহারের কারণে নফল রোজা ও তাহাজ্জুদের সওয়াব লাভ করবে।’ (সুনানে তিরমিজি)

তিনি আরও বলেন, সবচেয়ে বেশি যা মানুষকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে তা হল আল্লাহ তাআলার ভয় ও সুন্দর আচরণ। আর সবচেয়ে বেশি যা মানুষকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবে তা হল মুখ এবং লজ্জাস্থান। (সুনানে তিরমিজি)। তিনি আরও বলেন,‘সুন্দর আচরণই নেক আমল’। (সহিহ মুসলিম)

হাদিসে নবী পাক (.) আরও বলেছেন,‘তোমাদের মধ্যে যার আচারআচরণ সুন্দর, সে আমার সবচেয়ে বেশি প্রিয় এবং কিয়ামতের দিন সে আমার সবচেয়ে কাছে থাকবে। (সুনানে তিরমিজি)

মানুষের একটি ভাল কথা যেমন একজনের মন জয় করে নিতে পারে,তেমনি একটু খারাপ বা অশোভবন আচরণ মানুষের কষ্ট আসে। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ হিসেবে আমাদের উচিৎ সর্বদা মানুষের সঙ্গে ভালো ও সুন্দরভাবে কথা বলা।

সুন্দর আচরণ আমরা সবাই প্রত্যাশা করি। কিন্তু আমরা প্রায়ই অন্যের সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার করতে ভুলে যাই। সামান্য একটু অসতর্কতার কারণে আমাদের আচরণে একজন মানুষ অনেক কষ্ট পেতে পারে। তাই আমাদের সব সময় সচেতন থাকা উচিত। যাতে আমাদের আচরণে কেউ বিন্দুমাত্র কষ্ট না পায়। যার আচরণ যত বেশি সুন্দর সবাই তাকে তত বেশি ভালবাসে, সম্মান ও শ্রদ্ধা করে। যার আচরণ ভাল নয় সবাই তাকে ঘৃণা করে ও এড়িয়ে চলে। সুন্দর ব্যবহার সুন্দরভাবে কথা বলা সুন্দর মনের পরিচয় বহন করে। মানুষের একটি ভাল কথা যেমন একজনের মন জয় করে নিতে পারে, তেমনি একটু খারাপ বা অশোভন আচরণ মানুষের মনে কষ্ট আসে। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ হিসেবে আমাদের উচিত সর্বদা মানুষের সঙ্গে ভাল ও সুন্দরভাবে কথা বলা।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, গবেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সমস্যা এবং ভবিষ্যতে করণীয়
পরবর্তী নিবন্ধতুই ফিরলে