অশেষ কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাতেই হয় অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান ড. ইউনূসকে। তাঁর হাত দিয়েই একনেকে পাস হলো দক্ষিণ চট্টগ্রামের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ও বহু আকাঙ্ক্ষিত কালুরঘাট রেল কাম সড়ক সেতু। এই অনুমোদনের মধ্য দিয়ে স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে সারা দেশের সাথে কক্সবাজারের নিরবচ্ছিন্ন রেল যোগাযোগ ও সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার। সোমবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা বিভাগ অধীন শেরে বাংলা নগরস্থ এনইসি সম্মেলন কক্ষে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) দ্বিতীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে অনুমোদিত হয় চট্টগ্রামের কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীর উপর একটি রেল–কাম–রোড সেতু নির্মাণে ১১ হাজার ৫৬০ কোটি টাকার প্রকল্প। এটিতে ৭ হাজার ১২৫ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে কোরিয়া। অথচ প্রকল্পটি ২০১৮ সালে ১ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়নের জন্য একনেকে অনুমোদন দেওয়া হয়। অর্থাৎ ১০গুণ ব্যয়ে প্রকল্পটি বৈদেশিক ঋণ নিয়ে অনুমোদন পেয়েছে।
আমাদের এই চট্টগ্রামে কত মন্ত্রী–এমপি এলেন আর গেলেন। কত দাবি–কত আশা–প্রত্যাশা। কিন্তু এই কালুরঘাট সেতু পাস করিয়ে আনতে পারেননি কেউ। সেতুর স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল! অবশেষে ‘আঁরার ইউনূস’ সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে এগিয়ে গেলেন আন্তরিকভাবে। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত একনেক–এর এই সভায় ২৪ হাজার ৪১২ কোটি টাকার চারটি প্রকল্প অনুমোদন পায়। চারটি প্রকল্পের মধ্যে চট্টগ্রামেরই রয়েছে দুইটি প্রকল্প। একটি কালুরঘাট রেল কাম সড়ক সেতু, আরেকটি মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর। বিশ্লেষকদের মতে, নিরবচ্ছিন্ন রেল পরিবহন নিশ্চিত করা এবং চট্টগ্রাম–কক্সবাজার করিডরের অপারেশনাল সীমাবদ্ধতা দূর করা এর অন্যতম উদ্দেশ্য। বাণিজ্যিক রাজধানীর সড়কপথের যানজট কমাতে সেতুটি ভূমিকা রাখতে পারে। মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর থেকে পণ্য পরিবহনের রেল করিডর তৈরি হবে। তা ছাড়া চীন, ভারত, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে সংযুক্ত ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কের অংশবিশেষ নির্মাণ করা সম্ভব এ প্রকল্পের মাধ্যমে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কালুরঘাট সেতু প্রকল্পের সাথে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পের অনুমোদন সরকারের সুদূর প্রসারী পরিকল্পনার একটি। দোহাজারী–কক্সবাজার রেললাইন চালুর মাধ্যমে ঢাকা ও কক্সবাজারের মধ্যে সরাসরি রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। অন্যদিকে, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর চালু হলে এ অঞ্চলের ব্যবসা–বাণিজ্য বৃদ্ধির পাশাপাশি আন্তর্জাতিকভাবে এই রুটের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাবে।
এখানে উল্লেখ্য, মিটারগেজ লাইনবিশিষ্ট কালুরঘাট রেল কাম রোড সেতুটি ১৯৩১ সালে নির্মিত হয়। পরে ১৯৬২ সালে সেতুটির ডেক পরিবর্তন করে রেল কাম রোড সেতুতে রূপান্তর করা হয়। এ সেতুর ওপর দিয়ে ঘণ্টায় ১০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলাচল করে। এ সময় সেতুর ওপর দিয়ে সড়কপথের যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখতে হয়। সড়কযান এ সেতুতে কেবল একমুখী চলাচল করতে পারায় সেতুর উভয় পাশে সৃষ্টি হয় দীর্ঘ যানজটের।
কর্ণফুলী নদীর ওপর কালুরঘাট রেল কাম সড়ক সেতু নির্মাণ প্রকল্প একনেকে পাস হওয়ায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে বোয়ালখালী–কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়ন পরিষদ। গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে পরিষদের আহ্বায়ক মো. আব্দুল মোমিন, যুগ্ম আহ্বায়ক মুস্তফা নঈম ও সদস্যসচিব রমেন দাশগুপ্ত এ কৃতজ্ঞতা জানান। তাঁরা বলেন, কোটি মানুষের প্রাণের দাবি ছিল কালুরঘাট রেল কাম সড়ক সেতু নির্মাণ। বিবৃতিতে বলা হয়, বোয়ালখালী–পটিয়াসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষের প্রাণের দাবি কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীর ওপর রেল কাম সড়ক সেতু নির্মাণে আশা জাগানিয়া একটি অগ্রগতি হয়েছে। জাতির সূর্যসন্তান নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার দুই মাসের মধ্যে সেতু নির্মাণ প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন দেওয়ার মধ্য দিয়ে চট্টগ্রামবাসীর দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবে রূপ পেয়েছে।
অন্তত চার দশক আগে থেকে এ অঞ্চলের মানুষ কালুরঘাটে একটি নতুন সেতু নির্মাণের আকুতি জানিয়ে আসছে। ১৯৯১ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনে, প্রতিটি স্থানীয় নির্বাচনে কালুরঘাট সেতুর বিষয়টি প্রার্থীদের প্রতিশ্রুতিতে সেতুর বিষয়টি প্রাধান্য পেয়ে আসছে। ২০১৪ সালের শুরুতে দলমত নির্বিশেষে বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার নাগরিকদের নিয়ে গঠন করা হয় ‘বোয়ালখালী–কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়ন পরিষদ, চট্টগ্রাম।’ এর মধ্য দিয়েই সেতুর দাবি প্রথম জনসম্মুখে আসে এবং সেটি গণদাবিতে পরিণত হয়। এরপর পরিষদের পক্ষ থেকে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি এবং সেতুসংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ নিবিড় যোগাযোগের মধ্য দিয়ে আজ আমরা এ প্রেক্ষাপটে পৌঁছেছি।
এই প্রকল্প অনুমোদন পাওয়ার মধ্য দিয়ে নতুন আশায় বুক বাঁধছে চট্টগ্রামবাসী। নতুন ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনছে তারা। চট্টগ্রামের এই গণদাবি পূরণের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।