৮ই অক্টোবর মহান বিশ্ব লায়ন্স সেবা দিবস–২০২৪। ১৯১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া আন্তর্জাতিক লায়ন্স ক্লাব বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সেবা সংগঠন। এক সময় বলা হতো বৃটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্তমিত হয় না। বর্তমানে লায়নরা গর্বের সাথে উচ্চারণ করেন ‘লায়ন সাম্রাজ্যে সূর্য্য অন্তমিত হয় না’। তার কারণ পৃথিবীতে লায়নইজম এত বেশি বিস্তার লাভ করেছে যে, প্রতি মুহূর্তে পৃথিবীর কোথাও না কোথাও সেবা কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। পৃথিবীতে এক গোলার্ধ্বে যখন দিন অপর গোলার্ধে তখন রাত অর্থাৎ দিন রাত প্রতিটি মুহূর্তে পৃথিবীতে লায়ন্স এর মাধ্যমে সেবা কর্মসূচী পালিত হচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বের ২১৪টি দেশে ৪৮৫২৯ টি ক্লাব ৮৮৪ লায়ন্স জেলার আওতায় প্রায় ১৪ লক্ষ, লায়ন সদস্যবৃন্দ সেবা কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত আছেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকাময় দিনগুলোতে ও মানব ইতিহাসের ক্রান্তিলগ্নে মানুষ যখন বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত হয়ে জীবন সংগ্রামের দিক নির্দেশনা খুঁজে ক্লান্ত সেই ক্রান্তিলগ্নে ১৯১৭ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরের মানব হিতৈষী এক বীমা কর্মকর্তা মিঃ মেলভিন জোন্স এর উদ্দ্যেগে এবং নেতৃত্বে অসামপ্রদায়িক এবং অরাজনৈতিক যেই সেবা সংগঠন যাত্রা শুরু করেছিল, তা হচ্ছে বর্তমান বিশ্বের সর্ববৃহৎ সেবা সংগঠন আন্তর্জাতিক লায়ন্স ক্লাব। বর্তমান এ বিশ্বের ২১৪টি দেশে ৪৮৫২৯ টি ক্লাব ৮৮৪ টি লায়ন্স জেলার আওতাভূক্ত হয়ে প্রতিনিয়ত মানব কল্যাণমূলক সেবা কর্মে নিয়োজিত রয়েছেন।
লায়ন সদস্য হওয়ার যোগ্যতা: আপনি যদি একজন সমাজ সচেতন ব্যক্তি হন এবং সেবা ধর্মী মনোভাব আপনার মাঝে থাকে তাহলে আপনি সদস্য হওয়ার যোগ্যতা রাখেন। তবে আপনাকে এই কথা অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে যে সদস্যপদ পেতে হলে আপনাকে সৎ, চরিত্রবান ও সেবার মনোভাব সম্পন্ন হতে হবে এবং সমাজ ও রাষ্ট্রবিরোধী কোন কার্যকলাপে জড়িত থাকা যাবে না।
উদ্দেশ্যাবলী: পৃথিবীর মানুষে মানুষে সমঝোতার মনোভাব সৃষ্টি ও লালন। সৎরাষ্ট্র ব্যবস্থা ও সুনাগরিকত্বের আদর্শের বিকাশ সাধন। জনগণের নাগরিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও নৈতিক উন্নতি বিধানে সক্রিয় আগ্রহ প্রদর্শন। লায়ন্স ক্লাবসমূহকে সুসম্পর্ক, সমপ্রীতি ও সমঝোতার বন্ধনে একত্রিত করা। জনস্বার্থ জড়িত সকল বিষয়ের মুক্ত আলোচনার ক্ষেত্র সৃষ্টি করা। তবে ক্লাব সদস্যগণ দলীয় রাজনীতি ও সমপ্রদায়ভুক্ত ধর্র্মীয় বিষয় নিয়ে বিতর্কে জড়িত হবেন না। সেবাব্রতী লোকদের ব্যক্তিগত আর্থিক লাভের বিবেচনা ব্যতিরেকে সমাজ সেবায় উৎসাহ প্রদান করা এবং ব্যবসা বাণিজ্য, শিল্প, বৃত্তি জীবন, জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট ক্রিয়াকর্ম ও ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে দক্ষতার উন্নয়ন ও উচ্চ নৈতিক আদর্শের বিকাশ।
লায়নের নীতিমালা: আমার বৃত্তি জীবনের মর্যাদার প্রতি আমি আস্থাবান হবো এবং সেই লক্ষ্যে নিষ্ঠার সাথে কর্মে লিপ্ত থেকে আমার পেশাগত কাজের উৎকর্ষের জন্য সুনাম অর্জনে সচেষ্ট থাকবো। সাফল্যে লাভ আমার অভীষ্ট লক্ষ্য হবে এবং সকল সৎ পারিশ্রমিক বা মুনাফা আমার ন্যায্য পাওনা বলে আমি দাবী করবো, কিন্তু অন্যায় সুবিধা গ্রহণ বা নিন্দনীয় বা নৈতিক আচরণের কারণে আমি আত্মসম্মান হানির বিনিময়ে কোন লাভ বা সাফল্য গ্রহণ করবো না। আমি মনে রাখবো নিজের ব্যবসায়িক সাফল্যের জন্য অপরের ব্যবসার পতন ঘটানোর প্রয়োজন নেই। আমি আমার গ্রাহক ও পৃষ্ঠপোষকদের কাছে বিশ্বস্ত এবং নিজ আচরণে অকপট থাকবো। অন্যের প্রতি আমার মনোভাব বা আচরণের সমীচীনতা বা নীতির প্রশ্নে কোন দ্বিধায় উৎপত্তি হলে নিজকে অভ্রান্ত বিবেচনা না করে সেই দ্বিধার অবসান করবো। আমি মনে রাখবো বন্ধুত্বই বন্ধুত্বের লক্ষ্য, বন্ধুত্ব কার্যসিদ্ধির মাধ্যম নয়।
আমি বিশ্বাস রাখবো প্রকৃত বন্ধুত্বের মূল্য একজনের প্রতি আরেক জনের উপকার বা সাহায্য দ্বারা নিরূপিত হয় না বরং সত্যিকার বন্ধুত্ব কিছুই দাবী করে না এবং উপকার গ্রহণ করে শুভেচ্ছার নিদর্শনররূপে। একজন নাগরিক হিসাবে আমার জাতি, আমার রাষ্ট্র ও আমার সমাজের প্রতি আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য আমি সর্বদা স্মরণ রাখবো কথায়, কাজে ও আচরণে তাদের প্রতি আনুগত্যে আমি অটল ও অবিচল থাকবো এবং তাদের প্রয়োজনে অকুণ্ঠভাবে আমার সময়, শ্রম ও সঙ্গতি নিয়োজিত রাখবো। দুঃস্থকে সহানুভুতি, দুর্বলকে সহায়তা, নিঃস্বকে আমার বিত্ত দান করে আমি মানুষের সাহায্য করবো। সমালোচনার ক্ষেত্রে আমি সতর্ক ও সংযত থাকবো কিন্তু প্রশংসায় হব উদার ও অকৃপণ, আমি গড়ে তুলবো ভাঙবো না কখনো।
বিশ্বের মাঝে লায়ন ইজম: ১৯১৭ সালের ৭ই জুন আমেরিকার শিকাগো শহরের বীমা কর্মকর্তা স্যার মেলভীন জোন্স এর নেতৃত্বে অরাজনৈতিক ও অসামপ্রদায়িক সেবা সংগঠন লায়ন্স ক্লাবস্ ইন্টারন্যাশনাল এর জন্ম হয়। ১৯১৭ সালের ৮ই অক্টোবর লায়নবাদের উদ্দেশ্যাবলী, নীতিমালা ঘোষণার মাধ্যমে ২২টি ক্লাবের সমন্বয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক লায়ন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল শিকাগো শহরের লাসিলি হোটেলে। সেই সম্মেলনে ৯টি অঙ্গরাজ্যে থেকে ২২টি ক্লাবের ৩৬জন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। পরবর্তীতে এই ৮ ই অক্টোবর সারা বিশ্বের লায়ন সেবা দিবস হিসাবে উদযাপিত হয়ে আসছে। আজ থেকে সুদীর্ঘ ১০৬ বছর পূর্বে লায়নইজম নামে সে সেবার বীজ বপন করা হয়েছিল, কালের পরিক্রমায় সেই বীজ থেকে চারা অঙ্কুরিত হয়ে বিশাল মহীরুহে পরিণত হয়েছে। ১৯১৭ সালে ৮ ই অক্টোবর প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ডঃ উইলিয়াম পি উডস্ –প্রেসিডেন্ট এবং স্যার মেলভীন জোন্স কার্যকরী সচিব নির্বাচিত হন। ১৯২৫ সালের লায়ন্স ইন্টারন্যশনাল কনভেনশানে বিশ্বখ্যাত সমাজসেবী হেলেন কেলার যোগদান করেন। তারঁ ডাকে সাড়া দিয়ে লায়ন সদস্যরা সারা বিশ্বের অন্ধত্ব নিবারণে ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করেন।
বর্তমান বর্তমান লায়ন্স সেবা বর্ষ (২০২৪–২০২৫) এর ইন্টারন্যাশনাল প্রেসিডেন্ট LN.FABRICIO OLIVEIRA তিনি ব্রাজিলের অধিবাসী। তিনি ডাক দিয়েছেন ‘MAKE YOUR MARK’.
লায়ন্স জেলা ৩১৫–বি–৪, বাংলাদেশ এর এই সেবা বর্ষে (২০২৪–২৫) নেতৃত্ব দিচ্ছেন লায়ন কোহিনূর কামাল এম.জে.এফ। সদ্য প্রাক্তন জেলা গভর্নর লায়ন এম.ডি.এম মহিউদ্দিন চৌধুরী–পি.এম.জে.এফ ১ম ভাইস জেলা গভর্নর লায়ন মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ অপু – এম.জে.এফ ও ২য় ভাইস জেলা গভর্নর লায়ন মোঃ কামরুজ্জামান লিটন এম.জে.এফ, মাননীয় জেলা গভর্নর এর হাত শক্তিশালী করছেন। কেবিনেট সেক্রেটারী লায়ন বেলাল উদ্দিন চৌধুরী ও কেবিনেট ট্রেজারার লায়ন মোঃ ইমতিয়াজ ইসলাম – পি.এম.জে.এফ দায়িত্ব সুচারু রূপে পরিচালিত করছেন। এছাড়া GAT টীমের সদস্যবৃন্দ, উএঝ টীমের সদস্যবৃন্দ সবসময় জেলার কর্মকাণ্ড প্রসারিত করছেন।
‘যত্নের ছায়া,ছড়ায় মায়া’ আমরা লায়ন সদস্যরা জীবনের অর্ঘ্য সাজাই আশার কুসুমে, স্বপ্নের বুননিতে গড়ি অনাগত জীবনের নকশীকাঁথা। বিগত দিনের জীর্ণতার নাগপাশ ছিন্ন করে অনাগত দিনের রক্তিম সূর্য্যের উষ্ণ আলিঙ্গনে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। প্রতিকূলতা অক্টোপাসের মত সহস্র বেষ্টনীতে ঘিরে আছে আমাদের সমাজকে। আমাদের দৃঢ় প্রত্যয় হোক মাদকমুক্ত ও সন্ত্রাসমুক্ত যুব সমাজ প্রতিষ্ঠা করে ফুলের মত সুবাসিত জীবন গড়ি। গভীর ধ্বংস স্তূপের মাঝে দাঁড়িয়ে ও আমরা নির্মাণের কঠিন শপথে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
সম্মানিত জেলা গভর্নর লায়ন কোহিনূর কামাল এ.জে.এফ এর ডাক ‘যত্নের ছায়া, ছড়ায় মায়া’ একটি যুগপোযোগী ও ঐতিহাসিক ডাক। আসল শান্তি এমন একটি মারণন্ত্র যা দিয়ে মানুষকে, জীবনকে ও বিশ্বকে জয় করা যায়। ‘যত্নের ছায়া, ছড়ায় মায়া’ সফল করতে পারলে আমরা যেমন মানুষকে শুধু নয় প্রকৃতির মাঝে সবাইকে জয় করতে পারবো। ‘যত্নের ছায়া, ছড়ায় মায়া’ যেমন মানুষের অন্তর জয় করা যায়, তেমনি বিবাদমান শত্রুতা –যুদ্ধবিগ্রহ ও জয় করা যায়।
তাই আসুন, আমরা সকলে মিলে মাননীয় জেলা গভর্নর এর যুগান্তকারী ডাক ‘যত্নের ছায়া,ছড়ায় মায়া’ সার্থক করে অসহায় বিপন্ন পৃথিবীতে শান্তির নীড় গড়ে তুলি ।
লেখক: লায়ন্স জেলার রিজিয়ন চেয়ারপার্সন হেড কোয়ার্টার, চিকিৎসক, সমাজকর্মী।