সম্ভাবনাময় যুব সমাজ : সমস্যা এবং উত্তরণের উপায়

ড. সবুজ বড়ুয়া শুভ | সোমবার , ৭ অক্টোবর, ২০২৪ at ৫:২৬ পূর্বাহ্ণ

জীবনকে জীবন্ত করে রাখতে, সমাজসংসারকে সতেজ করে তুলতে যৌবনের অবদান অনস্বীকার্য। এই মানব জীবনে যৌবনই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ সময়। বিশ্বকবি তারুণ্যকে প্রকাশ করেছেন যৌবনের দূত হিসেবে। উজ্জ্বলউচ্ছ্বাস, দুরন্ত, চাঞ্চল্য, অনন্ত উদ্দাম, অস্থির উম্মাদনা সাফল্যের সিগ্ধতা, ব্যর্থতার গ্লানি, প্রেমবিরহ, পূর্বরাগঅনুরাগ, আনন্দবেদনা, সৃষ্টিশীল কাজ, বিজ্ঞান ও প্রকৃতির উৎকর্ষতার মাঝে জীবনকে মেলে ধরার পূর্ণ আলোক জ্যোতিময় প্রকাশ করার মহেন্দ্রক্ষণ হলো যৌবন। প্রিয় কবি বিমলেন্দু বড়ুয়া বলেছেন, যৌবন যতোই আকর্ষণীয় কিন্তু বা রোমাঞ্চকর হোকনা কেন তা কিন্তু ভীষণ যন্ত্রণা দায়ক। শারীরিক এবং মানসিক উভয় ক্ষেত্রে এর ছাপ লক্ষ্যণীয়। এ যেন ভরা জোয়ারের বিক্ষুব্ধ নদীর খলখল, ছলছলাত অবস্থা। তরঙ্গ ভঙ্গে, জল উপচে পড়ছে, কূল ভাঙছে, পানি গড়ছে আর কোথাও বা সৃষ্টি হচ্ছে ঘূর্ণিপাক, যৌবনের এ হচ্ছে এক আকর্ষণীয় উপমা’। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন ‘যৌবন জলতরঙ্গ’।

মানুষের জীবনে যখন যৌবন আসে তখন যে ভরা নদীর বুকে তরঙ্গদোলয়িত ছন্দের সুর তোলেসে সুর কখনোবা মধুর কখনোবা বেদনার। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ‘যৌবন বেদনার রস…’। ফুল ফোটার আগে কুঁড়ি যেমন বিকাশের বেদনায় মেলে ধরে তীব্র আবেগে, সৌরভ ছাড়াবার দুর্দান্ত বাসনায় কম্পমান হয়ে উঠে, তেমনি জীব জগতে সর্ব ভূতে সর্ব প্রাণীতে বিশেষত মানব মানবীর মধ্যে যৌবনে এই লক্ষণ দেখা যায়। এরই অন্য নাম যৌবন যন্ত্রণা। শত যন্ত্রণা জর্জরিত হওয়া সত্ত্বেও যৌবন যে জীবনের সর্বোৎকৃষ্ট স্বর্ণালী সময় তা সর্বতোভাবে স্বীকার্য সত্য। এজন্য যৌবনের জয়গানে সমগ্র ভুবনই মুখরিত। যৌবনকে ধরে রাখার অম্লান করে তোলার জন্য প্রয়াসের অন্তনেই।

মহামানবের সাগরতীরে

বর্তমান বিশ্বে এ পর্যন্ত যা কিছু মহৎ কাজ সম্পন্ন হয়েছে তার অধিকাংশ কৃতিত্ব হচ্ছে যৌবন শক্তির। স্মরণীয় বরণীয় সেই সব মহাপুরুষদের জীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে তার সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জিত সাফল্য যৌবনেই এসেছে। মহামতি গৌতম বুদ্ধ দুঃখ মুক্তির উপায় অন্বেষণে রাজ্যপাট প্রিয়াপরিজন ত্যাগ করে ছয় বৎসর কঠোর সাধনা শেষে বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন ৩৫ বছর বয়সে, যৌবনের সুবর্ণ অধ্যায়ে। তেমনি ভাবে শ্রীকৃষ্ণ, হযরত মোহাম্মদ (দঃ), যীশুখৃষ্ট, চৈতন্যদেব, স্বামী বিবেকানন্দ প্রমূখ যুগস্রষ্টা ধর্ম প্রবর্তকদের জীবনেও এই সত্যের সন্ধান পাওয়া যায়। তাঁরা সবাই যৌবনেই জগত সংসারকে কিছু দেওয়ার, দুঃখ জয়ের সাধনায় নিজেকে সমপ্রদানের মাধ্যমে সিদ্ধিলাভে সক্ষম হয়েছিলেন।

যৌবনের অমিত শক্তিকে তাঁরা সুষ্ঠুভাবে শাসনে রেখে সাধনা করেছিলেন বলে এই কালজয়ী সাফল্য কৃতিত্ব এসেছিল। আমাদের বাংলা সাহিত্যের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, সত্যেন্দ্র নাথ দত্ত, সুকান্ত ভট্টাচার্য, বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র, জসীম উদদীন, সুফিয়া কামাল প্রমুখ কবিসাহিত্যিকদের সৃষ্ট সম্ভারের শ্রেষ্ঠ ফসল যৌবন জীবনেই এসেছিল। রবীন্দ্র সাহিত্যের মহত্তোম লেখাগুলি রচিত হয়েছিল তাঁর যৌবন কালে। মাত্র ৪৪ বছর বয়সে নজরুল বাকশক্তি হারিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর সম্পূর্ণ সৃজনশীল সৃষ্টিকাল ভরা যৌবনে। ছন্দের যাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ৪২বছর বয়সে আর সুকান্ত ভট্টাচার্য ২২বছর বয়সে মারা যান। সুতরাং তাদের যৌবন কালে রচিত সাহিত্য সমৃদ্ধ করেছে আমাদের বাংলা সাহিত্য যৌবনের জয়গান

যৌবনকে নিয়ে সভ্যতার উষালগ্ন থেকে ভাবনাচিন্তার অন্ত নেই এবং তা এখনও দেশে দেশে নিয়ত অব্যাহত রয়েছে। যৌবনের স্থিতিকাল বিশ থেকে চল্লিশ এই দুই দশক হলেও মনের দিক থেকে উদ্দীপ্ত থাকলে এ পরিধি আরো বাড়ানো যায় তবে এটা মানুষ ভেদে সম্ভব। তাইতো অমিত তেজী যৌবনের জয়গানে কবিরা মুখর হয়েছেন সব সময়। ‘ওরে সবুজ, ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা, আদমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা ”। মিথ্যাপচা, কুসংস্কার, গোঁড়ামী, ধর্মান্ধতা, কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে যুব শক্তি সর্বকালে সোচ্চার থেকেছে। অচলায়তনের নাগপাশ ছিন্ন করে ‘অরুণ প্রাতের তরুণ দল’ সব সময় সম্মুখপানে এগিয়ে গেছে।

সামাজিক বিভেদ বৈষম্য উঁচুনীচু জাত কুল অসাম্যের বিরুদ্ধে, ধর্মের নামে মিথ্যা ভণ্ডামীর বিরুদ্ধে জাগ্রত থেকেছে যুবশক্তি। মানবতার জয়গানে মুখরিত যুব সমাজ চিরদিনই চায় মুক্ত বিহঙ্গের মতো ডানা মেলে আকাশে উড়তে। তাদের কাছে হিমালয়ের সুউচ্চ তুষার শৃঙ্গ কিংবা আফ্রিকার গহিন জঙ্গল কোনো দুর্গম বা শাপদসংকুল নয়। সংসপ্তক মন নিয়ে তারা এগিয়ে চলেজলেস্থলে অন্তরীক্ষে। তারুণ্যের শক্তি দুর্নিবারদুর্বিনীতদুর্বার। সকল প্রকার সংকীর্ণতা, জীর্ণতা, আবিলতা, অন্যায়অত্যাচারের বিরুদ্ধে যৌবন শক্তি বিভিন্ন সময়ে সংগ্রামী ভূমিকা পালন করেছে। তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম। দু’শো বছরের নিষ্ঠুর শাসন, সেই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে ফাঁসির মঞ্চে যাঁরা জীবনের জয় গান গেয়ে নিজেকে আত্মোৎসর্গের মাধ্যমে একটি স্বাধীনস্বদেশের স্বপ্ন জাগিয়ে তুলেছিলেন এবং ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী সেই মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখ সমরে যাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তাঁদের অধিকাংশ ছিল ছাত্রযুব সমাজ। বাংলা ভাষাকে বিশ্বের বুকে মায়ের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে যে কজন বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে এবং স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের অগ্রসেনানী সবাই কিন্তু যুব সমাজের প্রতিনিধি। তাইতো কবি বলেছেন– ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’। সেই সব শহীদের সেই সব যৌবন উদ্দীপ্ত যুবকদের আত্মত্যাগ কি বিফলে গেছে? অবশ্যই না। জাতি শ্রদ্ধার সাথে তাঁদের স্মৃতির প্রতি অর্ঘ দিয়ে স্মরণ করে ঘুণে ধরা যুব সমাজ

স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, যৌবন শক্তির উদ্বোধন চাই। যৌবনের জয়গানে আমরা যেমন বিভোর, তেমনি বর্তমানে শঙ্কিত বটে। আজকের বিশ্বজুড়ে যৌবন যেন ধুকে ধুকে মরছে। এখনকার যৌবন যেন বিকারগ্রস্থ, বিপদক্লিষ্ট তারুণ্যের বিপদগামী স্রোত এখন প্রবল আকার ধারণ করেছে। সময় এসেছে এখনই এই পথ রুদ্ধ করার। কারণ এই পাপ পঙ্কিল পথ দীর্ঘ হলে দেশ ও জাতি হয়ে পড়বে জীবন্ত ফসিল। তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলোতে, যুব সমাজের ভূমিকা খুবই, হতাশা আর বেদনাদায়ক। কিছু সংখ্যক অপরিনামদর্শী যুবকের কারণে গৌরবোজ্জ্বল যুব সমাজ আজ কলঙ্কিত। সামপ্রতিক সময়ে খু্‌ন, সন্ত্রাস, ধর্ষণ, ইভটিজিং, চাঁদাবাজী, ছিনতাই, চুরিডাকাতি, সর্বনাশা ড্রাগ নেশায় আসক্তি হয়ে অতলান্ত চোরাবালিতে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের আজকের যুব সমাজ।

একবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানের বিস্ময়কর উতকর্ষতার মাঝে প্রগতির উল্টো পিঠে সওয়ার হয়ে আমরা পেছনের দিকে ছুটে চলেছি। এখানে যৌবনের জৌলুস যে রূপকথার গল্প। সামাজিকসাংস্কৃতিক, শিক্ষা, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সবদিকে যুব সমাজ আজ অবহেলা আর বঞ্চনার শিকার। পরীক্ষাগারের গিনিপিগ বানিয়ে বুকে ধারালো ছুরি চালিয়ে এঙপেরিমেন্ট করছে উচু তলার সমাজপতিরা। হাসি মুখে বিষের পেয়ালা তুলে দিচ্ছে তারুণ্যদীপ্ত সেই সব যুবকের ঠোঁটে। অবুঝের মতো আকণ্ঠ পান করে মৃত্যুর মুখোমুখি হচ্ছে। লক্ষ লক্ষ যুবকযুবতী বেকার, কর্মসংস্থানের অন্বেষায় পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

অভিবাবকেরা যথাযথ কর্তব্য পলনে অবহেলা, সুদৃষ্টির অভাবে বিপথে পরিচালিত হচ্ছে যুবকেরা, ধর্মীয় নীতিবোধের অভাব কিংবা ধর্মান্ধতা, কুশিক্ষার ফলে পরীক্ষায় নকল প্রবণতা যা শিক্ষা ব্যবস্থাকে, আগামী ভবিষ্যৎকে পঙ্গু করে নতুন প্রজন্মকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করবে। মাদকদ্রব্যের বিষাক্ত ছোবলের বিষে নীল হয়ে আসছে পুরো যুব সমাজ। শহরের অলিগলি থেকে গ্রামগঞ্জের হাটবাজারেও পৌঁছে গেছে সেইসব নেশা দ্রব্য মদ, গাঁজা, হেরইন, ফেন্সিডিল, আফিম, সরস, মারিজুয়ানা, ইয়াবা ইত্যাদি। সমাজের প্রায় প্রতিটি পরিবারের যুবকেরা এসব নেশায় আসক্ত। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সরকারি, বেসরকারি, সামাজিকসাংস্কৃতিক সংগঠন সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

যৌবনের জল তরঙ্গ

জীবন স্রোতের এই উপকুলে যৌবনের জলতঙ্গের টুংটাং সুরধ্বনি, জীবনকে প্রাণিত করে, প্রাণবন্ত করে। যৌবনকে সুন্দর সুশ্রী ও উপভোগ্য করতে হলে প্রথমত চাই সৎশিক্ষা। উপযুক্ত শিক্ষা ও জ্ঞান অর্জন ছাড়া যৌবন জীবন নিষ্ফল হতে বাধ্য। সদাচার, শোভন সুরুচিপূর্ণ আচারআচরণ, বিনয় নম্রতা ও সৌন্দর্যে কখনও আর্থিক ব্যয় হয় না। যে কোনো সামাজিক পরিবারে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাংগঠনিক পরিবেশে কিংবা সভাসমিতিতে এসব সহজে অধিগত করা যায়। মানুষের প্রতি মমত্ববোধ, ভ্রাতৃত্বভাব, সহমর্মিতা ও মানবিক গুণাবলী একটু সচেতন হলেই অর্জন করা সম্ভব। আর এসব গুণাবলী মহিমা যৌবনের বড়ো সম্পদচরিত্রভূষণ। জীবন যৌবনের প্রতি আহ্বান; সুন্দর, মহৎ মানুষ চাই, আলোকিত মানুষ, আলোকিত জীবন যৌবন

লেখক : সংস্কৃতিকর্মী ও সংগঠক। আন্তর্জাতিক সংগঠন ওয়ার্ল্ড এ্যলায়েন্স

অব বুড্ডিস্টসএর সহসভাপতি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসুন্দর আগামী গড়তে শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠায় করণীয়
পরবর্তী নিবন্ধবধ্যভূমিতেই হোক শহীদ মিনার ও চট্টগ্রাম মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর