নগরীর ২ নং গেট রেল ক্রসিং। শনিবার; ঘড়ির কাঁটায় সময় বেলা ১১টা ৪০ মিনিট। রেল ক্রসিংয়ে সতর্ক অবস্থানে দেখা যায় বোরকা পরিহিত একজন নারী গেটম্যানকে। মুখে থাকা বাঁশি বাজিয়ে থামানোর চেষ্টা করছিলেন রেল ক্রসিং দিয়ে পারাপার হওয়া গাড়ি; সরিয়ে দিচ্ছিলেন পথচারীদের।
হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে নামিয়ে দিচ্ছেন সড়কের দুই প্রান্তের ব্যারিকেড। রেললাইনের দিকে বার বার উঁকি মেরে দেখছিলেন তিনি। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে পর্যটন এক্সপ্রেস যাওয়ার শিডিউল রয়েছে। এরই মধ্যে বেজে ওঠে হাতে থাকা টেলিফোনটি। ওইদিক থেকে ট্রেন আসার সতর্কবার্তা শুনে মুখে বাঁশি আর লাল ও সবুজ রঙের পতাকা হাতে নিয়ে দ্রুত দাঁড়িয়ে যান রেল ক্রসিংয়ে দ্বারে। হাতে থাকা সবুজ পতাকাটি নেড়ে লাইন পরিষ্কারের বার্তা দিচ্ছিলেন ছুটে আসা ট্রেনটিকে। ১১টা ৪৫ মিনিটের দিকে গেট দিয়ে নিরাপদে ছুটে যায় ট্রেনটি। পুনরায় হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে ব্যারিকেড উঠিয়ে স্বাভাবিক করে দেন যান চলাচল।
এই তার নিত্যদিনের কাজ। প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা করে ডিউটি করতে হয় তাকে। দায়িত্বে থাকা অবস্থায় ২ নং গেট রেল ক্রসিংটি দিয়ে বেশ কয়েকবার ট্রেন আসা–যাওয়া করে। নগরীর সবচেয়ে ব্যস্ততম রেল গেট এটি। এই রেল ক্রসিং দক্ষতার সাথে সামাল দিতে হয় তাকে। ওই নারী গেটম্যানের নাম শিল্পী বেগম। তার বয়স ৩৬ ছুঁইছুঁই। তার গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালী জেলায়। থাকেন নগরীর আমবাগান এলাকায়। ২০১১ সালে বাংলাদেশ রেলওয়েতে নারী গেটম্যান হিসাবে যোগ দেন তিনি। ৬ বছর ধরে গেটম্যান হিসেবে কর্মরত আছেন ২ নং গেটের এই ক্রসিংয়ে।
গেটম্যান শিল্পী বেগমের স্বামী নেই। অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত একমাত্র ছেলেকে নিয়ে সংসার। গেটম্যানের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নিখুঁতভাবে পালন করে যাচ্ছেন তিনি। নারী হয়েও দীর্ঘদিন ধরে সাহসিকতা ও দক্ষতার সাথে পুরুষ গেটম্যানের মতো দায়িত্ব পালন যাচ্ছেন। দিন–রাত পালাবদলে কাজ করেন। ডিউটি চলাকালে এদিক–ওদিক যাওয়ার সুযোগ নেই।
ব্যস্ততম এই গেটের পুরো দায়িত্ব একা কীভাবে সামাল দেন? এমন প্রশ্নের জবাবে শিল্পী বলেন, কাজের মধ্যে নারী–পুরুষ পার্থক্য আছে বলে আমি মনে করি না। মনোবলই বড়। এই কাজ আমার জন্য কঠিন কিছু নয়। আমি সহজে কাজ করছি। আমি মনে করি গেটম্যানের চাকরি দায়িত্বশীল কাজ। দায়িত্বরত অবস্থায় খুবই সতর্ক থাকতে হয় আমাদের। এই কাজে একটু অবহেলা করলে বড় বিপদ। বিগত ৬ বছর যাবৎ দায়িত্বশীলতার সাথে কাজ করে যাচ্ছি। সামনেও করে যাব। অনেক সময় খারাপও লাগে, যখন সড়কের উপর ব্যারিকেড দেওয়ার পরও উল্টো দিক থেকে রেল ক্রসিং দিয়ে গাড়ি পারাপার হতে থাকে। সাধারণ মানুষ বুঝে না এতে যেকোনো সময় বিপদ হতে পারে। অথচ দায়ভারটা আমার ওপর পড়বে। যেহেতু এই ব্যস্ততম রেল ক্রসিং দুজন গেটম্যান দরকার।
শিল্পী জানালেন, আগে কোনো সময় চিন্তা করিনি গেটম্যানের চাকরি করব। সরকারি চাকরির জন্য চেষ্টা করছিলাম, বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষা অংশগ্রহণ করেছিলাম। স্বাভাবিকভাবে গেটম্যানের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি পেয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিলাম। পরে গেটম্যান পদে চূড়ান্ত নিয়োগপ্রাপ্ত হই। গেটম্যান হিসাবে যখন নিয়োগ পেয়েছি তখন দায়িত্বশীলতার সাথে কাজ চালিয়ে যাওয়া আমার কর্তব্য বলে মনে করি। সংসারের সকল কাজ সামাল দিয়ে গেটম্যানের দায়িত্বটা সঠিকভাবে পালন করে যাচ্ছি। কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।
ষোলশহর স্টেশন মাস্টার মো. জয়নাল আবেদীন বলেন, নারী গেটম্যান হলেও উনি দক্ষতার সাথে তার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তাকে দায়িত্বে অবহেলা করতে দেখিনি। তবে রেল ক্রসিংগুলোতে আরো লোক বাড়ানো দরকার। ক্রসিংয়ের উপর যেভাবে ভাসমান দোকান গড়ে উঠেছে তাতে ঝুঁকি রয়েছে। আমাদের গেটম্যানরা তাদের সরে যাওয়ার জন্য বললেও তারা সরে যাচ্ছে না। যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। সেখান থেকে উঠে যেতে বললে উল্টো আমরা চাঁদা দাবি করেছি বলে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ দেবেন বলে হুমকি দিচ্ছেন হকাররা।