পাঁচ দিনের ব্যবধানে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিএসসি) দুটি তেলবাহী জাহাজে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ১০ সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। গতকাল রোববার চট্টগ্রামে বিএসসির কনফারেন্স রুমে সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তা এবং বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান এবং পরিচালকসহ শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন তিনি। সভা শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে তিনি বলেন, ঘটনা তদন্তে ১০ সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ছোটখাট ঘটনা ঘটলেও আপনাদের মনে সন্দেহ জাগতে পারে, এটা অন্য কোনো ব্যাপার কিনা। সে সন্দেহ যাতে দূর হয় এবং প্রকৃত বিষয়টা বের করে আনতে পারি সেজন্য একটা বেশ বড় এনকোয়ারি কমিটি, যেখানে সব ধরনের এঙপার্টরা থাকবেন। সিকিউরিটি এঙপার্ট থেকে শুরু করে যারা অয়েল ট্যাংকারে কাজ করেছেন এবং বিএসসির প্রতিনিধি নিয়ে ৯–১০ জনের কমিটি তৈরি করা হয়েছে।
অনুসন্ধান দলের সদস্যরা সাগরে গিয়ে জাহাজ দুটির অবস্থা পর্যবেক্ষণ করবেন জানিয়ে তিনি বলেন, তারা আসবেন, অন দ্য স্পট জাহাজটাও তারা দেখবেন, আসলে বিষয়টা কী। মানুষ যেগুলো সন্দেহ করছে সে ধরনের কিছু আছে কিনা। তিনি বলেন, কী হয়েছে সেটা নিয়ে অনুমানভিত্তিক কোনো কথা বলতে চাই না। ইনকোয়ারি হবে। শেষ হলে তার রেজাল্টগুলো আপনারা জানতে পারবেন। এ মুহূর্তে কিছু বললে এনকোয়ারি ইনফ্লুয়েন্সড হয়ে যাবে। কমিটির প্রতিবেদন দেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, পরপর দুটি ঘটনা কেন ঘটেছে, এটা কোনো পিওরলি অ্যাকসিডেন্ট নাকি আপনারা যেটা বলছেন সেটা, সে উত্তর পেতেই মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এ কমিটি গঠন করা হয়েছে।
সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পরও অল্পদিনের মধ্যে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী দুটি জাহাজে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা কোনো নাশকতা কিনা, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, পরপর দুটি ঘটনায় স্বাভাবিকভাবে মানুষের মনে একটা সন্দেহ থাকতে পারে। স্বাভাবিকভাবে আমরা যে সময়টাতে আছি, এটা তো একটু অস্থির সময়। আমরা সরকারের পক্ষ থেকে চেষ্টা করছি এ অস্থিরতাটা কমাতে।
বিএসসির মালিকানাধীন বাংলার জ্যোতি জাহাজে গত ৩০ সেপ্টেম্বর সকালে বিস্ফোরণ এবং অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। জাহাজটি বহির্নোঙরে অবস্থানাকারী মাদার ভ্যাসেল থেকে ১১ হাজার ৭০০ টন ক্রুড অয়েল এনে বন্দরের ডলফিন জেটিতে বার্থিং নিয়েছিল। ওখান থেকে ইস্টার্ন রিফাইনারিতে পাইপলাইনের মাধ্যমে ক্রুড অয়েল খালাসের সময় জাহাজটিতে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ড ঘটে। ওই ঘটনায় একজন ক্যাডেটসহ তিনজন নিহত হন।
বাংলার জ্যোতির দুর্ঘটনার পাঁচ দিনের মাথায় ৪ অক্টোবর মধ্যরাতে বহির্নোঙরে মাদার ভ্যাসেল থেকে ক্রুড অয়েল লাইটার করে নিয়ে আসার সময় বহির্নোঙরে বাংলার সৌরভেও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। জাহাজটিতেও ১১ হাজার ৫৫ টন ক্রুড অয়েল ছিল।
পরপর দুটি ঘটনার পর বিষয়টিতে নাশকতার সন্দেহ করেন সংশ্লিষ্টরা। দেশের জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তার বিঘ্নিত করতে কোনো মহল এই নাশকতা চালাচ্ছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন বিএসসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কমডোর মাহমুদুল মালেক।
বিএসসির দুই জাহাজে অগ্নিকাণ্ড এবং প্রাণহানির ঘটনার পর গতকাল চট্টগ্রামে এসে রাষ্ট্রীয় সংস্থাটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন নৌ উপদেষ্টা সাখাওয়াত হোসেন। পরে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, যেহেতু দুটো জাহাজ বিস্ফোরণের কারণে অকেজো হয়ে গেছে, তার বিকল্প হিসেবে অন্যান্য জাহাজের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে, যাতে লাইটারিং জাহাজের কার্যক্রম অব্যাহত থাকে। আমি কোস্টগার্ড, নৌবাহিনী এবং পোর্ট কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি, তারা দ্রুত সময়ের মধ্যে গিয়ে আগুন নিভিয়েছে এবং সেখানে আটকে পড়া ৪৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করতে পেরেছে। নেভাল চিফ, বন্দর চেয়ারম্যান, কমান্ডার থেকে শুরু করে সবার সঙ্গে আমার সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ছিল। ভোর সাড়ে ৪টা পর্যন্ত আমি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছি। তারা আমাকে জানিয়েছে, সবাইকে উদ্ধার করা হয়েছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশি উদ্যোক্তা, যারা বিদেশে ব্যবসা করেন; তারা জাহাজ এবং পাটে বিনিয়োগ করতে ইচ্ছা পোষণ করেছেন। আমি বিদেশিদের আহ্বান জানাই, তারা যেন আমাদের জাহাজ শিল্পে বিনিয়োগ বাড়ায় এবং একসঙ্গে কাজ করেন। এ শিল্পকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেন।
চীন থেকে জাহাজ কেনায় দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে বলে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, মন্ত্রণালয়ের একটা টিম জাহাজ কেনার বিষয় নিয়ে কাজ করছে। আগের যে দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল, ডলারের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় জাহাজের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু আমরা নেগোসিয়েশনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। তারা যে দাম নির্ধারণ করেছেন, সেটা থেকে কমিয়ে আনার চেষ্টা করছি। জাহাজ আমাদের প্রয়োজন, তাই আমরা যাতে সেগুলো কিনতে পারি, সেভাবে এগিয়ে যাচ্ছি। জাহাজ কেনার ব্যাপারে দুর্নীতির যে প্রশ্নগুলো উঠছে, মন্ত্রণালয় এসব ব্যাপারে দুদকের সাহায্য নেবে এবং দুদক তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।