কর্মকর্তা–কর্মচারীদের আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করেছেন চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতালের দুই কর্মকর্তা। তারা হলেন প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. আমান উল্লাহ আমান ও পরিচালক ডা. নওশাদ আজগর চৌধুরী। গতকাল শনিবার বিকাল ৩টার পর পদত্যাগ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাহারায় হাসপাতাল ত্যাগ করেন তারা।
এর আগে বেলা ১১টা থেকে চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক জাহাঙ্গীর চৌধুরীর পদত্যাগ চেয়ে বিক্ষোভ শুরু হয়। ‘হাসপাতালের কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দ’ ব্যানারে অংশ নেওয়া বিক্ষোভকারীরা হাসপাতালের সামনের মাঠে অবস্থান নেন। এ সময় তারা বিভিন্ন স্লোগান দেন। তারা হাসপাতালে বিভিন্ন সময়ে অনিয়ম হয়েছে অভিযোগ করে বক্তব্য রাখেন। ১৪ দফা দাবি উপস্থাপন করেন তারা। কর্মকর্তা–কর্মচারীদের পাশাপাশি স্থানীয় লোকজন এবং পাহাড়তলী কলেজের কিছু শিক্ষার্থীকেও বিক্ষোভ করতে দেখা গেছে। শিক্ষার্থীদের গলায় কলেজের পরিচয়পত্র ছিল।
এদিকে বিক্ষোভ চলাকালে হাসপাতালের চিকিৎসাসেবাসহ অন্যান্য প্রশাসনিক কাজে বিঘ্ন ঘটে বলে অভিযোগ করেছেন রোগীর স্বজনরা। তবে আন্দোলনকারী এ অভিযোগ অস্বীকার করেন।
দুপুর সোয়া ১টার দিকে হাসপাতালে উপস্থিত হয়ে দেখা গেছে, পরিচালক ডা. নওশাদ আজগর চৌধুরীর কক্ষে লোকজনের জটলা। সেখানে পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর সদস্যরাও ছিলেন। ওই কক্ষে ছিলেন মো. আমান উল্লাহ আমান ও পরিচালক ডা. নওশাদ আজগর চৌধুরী। এ সময় উত্তেজিত কয়েকজন হাসপাতালে বিভিন্ন অনিয়ম হয়েছে বলে দাবি করেন। তারা এই দুই কর্মকর্তার পদত্যাগ দাবি করেন। কয়েকজন বিক্ষোভকারী জানান, সকালে আন্দোলন শুরু হওয়ার পর এই দুই কর্মকর্তাকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। পরে বিকাল ৩টার পর পদত্যাগ করে তারা হাসপাতাল ছাড়েন।
খুলশী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মুজিবুর রহমান আজাদীকে বলেন, উনারা (যারা বিক্ষোভ করেন) যাদেরকে থাকতে পারবেন না বলেছেন তারা (আমান উল্লাহ ও নওশাদ আজগর চৌধুরী) চলে গেছেন। পরবর্তীতে কী হবে সেটা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানবেন। আমরা কেবল বিক্ষোভের খবর শুনে ঘটনাস্থলে যাই এবং আমাদের উপস্থিতির কারণে বিশৃঙ্খল কিছু ঘটেনি। এ সময় সেনাবাহিনীও ছিল।
রোগীর দুর্ভোগ : আন্দোলন চলাকালে হাসপাতালের চিকিৎসাসেবায় বিঘ্ন ঘটে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বাকলিয়া থেকে আসা এক রোগীর স্বজন আজাদীকে বলেন, এক মাস তিন দিন ধরে আমার রোগী ভর্তি আছেন। সকালে চিকিৎসাসেবা পেয়েছেন। ১১টার পর থেকে চিকিৎসক ও নার্স কাউকে পাওয়া যায়নি। তবে আন্দোলনকারীদের কয়েকজন দাবি করেন, চিকিৎসাসেবায় বিঘ্ন ঘটছে না। ওয়ার্ডে চিকিৎসক দায়িত্ব পালন করছেন।
রুহুল আমীন নামে এক রোগীর স্বজন আড়াইটার দিকে আজাদীকে জানান, তার মাকে হাসপাতালে ৬ দিন আগে ভর্তি করিয়েছেন। গতকাল শনিবার সকালে ডাক্তার রিলিজ দিয়েছেন। আন্দোলনের কারণে হিসাব শাখার কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই বিল পরিশোধ করতে পারছেন না।
তিনি বলেন, সকালে ৩৫ হাজার টাকার প্রাথমিক বিল দেওয়া হয়। কিন্তু সেখানে খাতভিত্তিক কত টাকা খরচ হয়েছে তা উল্লেখ নেই। মোট বিল দেওয়া হয়েছে। খাতভিত্তিক বিল না থাকায় বিস্ময় প্রকাশ করেন তিনি বলেন, ৬ দিনে যে বিল এসেছে তা বেসরকারি হাসপাতালের মতো।
আন্দোলনকারীদের যত অভিযোগ : হুইল চেয়ারে করে আন্দোলনে একাত্ম প্রকাশ করতে আসেন হাসপাতালের কর্মচারী গোবিন্দ। তিনি বলেন, আমি পায়ে আঘাত পেয়েছি, অ্যাঙিডেন্ট করেছি। অসুস্থ। গত কয়েক মাসের বেতন–ভাতা পাইনি।
এ সময় পাশ থেকে জাকির হোসেন নামে একজন আজাদীকে বলেন, হাসপাতালের স্টাফ অ্যাঙিডেন্ট করেছে। তাকে হাসপাতাল থেকে সহায়তা দেওয়া উচিত ছিল। তা না করে বেতন দিচ্ছে না। নিজেকে স্থানীয় বাসিন্দা পরিচয় দিয়ে তিনি বলেন, হাসপাতালের স্টাফ না হলেও এলাকার হাসপাতাল হিসেবে আমাদেরও দায়বদ্ধতা আছে। তাই এসেছি।
জাহিদ হোসেন নামে হাসপাতালের এক কর্মচারী আজাদীকে বলেন, আমার ডিউটির সময় হচ্ছে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টা। কিন্তু আমাকে ৫টা পর্যন্ত ডিউটি করতে হয়। অতিরিক্ত সময়টা ওভারটাইম হওয়ার কথা। কিন্তু আমাকে ওভারটাইম দেওয়া হয় না। গত মাসে ওভারটাইম চাওয়ায় আমার মূল বেতন থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা কেটে রাখে।
হাসপাতালের ফার্মেসি অ্যাটেনডেন্ট রোমেন আজাদীকে বলেন, এখানে পদোন্নতি হয় না এবং বেতন বাড়ে না। এসব নিয়ে কেউ কথা বললে তার চাকরি চলে যায়।
আহসান হাবীব নামে এক কর্মচারী আজাদীকে বলেন, অনেক অনিয়ম হয়েছে হাসপাতালে। আমরা জাহাঙ্গীর চৌধুরীর পদত্যাগ চাই। অতীতে কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে চাকরিচ্যুত বা বদলি করা হতো। আমাকেও বদলি করা হয়েছে।
কী আছে ১৪ দফায় : আন্দোলকারীরদের ১৪ দফায় বলা হয়, জাহাঙ্গীর চৌধুরীর সীমাহীন দুর্নীতির তদন্ত করতে হবে। তার পরিবারের সদস্যদের কাছে হাসপাতালের বকেয়া পাওনা কয়েক লক্ষ টাকা। হাসপাতালের ফান্ডে অবিলম্বে ফেরত দিতে হবে। তার আত্মীয়করণ থেকে ডায়াবেটিক হাসপাতালের সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারী মুক্তি চান।
এছাড়া প্রত্যেক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর প্রভিডেন্ট ফান্ডের আলাদা আলাদা পাশ বই, যাতায়াত ভাতা বৃদ্ধি, বেতন–ভাতা বৃদ্ধি, অবিলম্বে কর্মকর্তা–কর্মচারীদের গ্র্যাচুয়িটি চালু, কথায় কথায় চাকরিচ্যুতি বন্ধ, যাদের অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুতি করা হয়েছে তাদের সকলকে স্ব–পদে চাকরিতে বহাল করার দাবি জানান। অবিলম্বে সমাজসেবা অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসকের অধীনে সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে যারা জয়ী হয়ে আসবেন তাদেরই হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার দাবি করা হয়।
১৪ দফায় ২৪ বছরের প্রভিডেন্ট ফান্ডের হিসাব দেওয়ার পাশাপাশি চিকিৎসক ও কর্মকর্তা–কর্মচারীদের থেকে প্রগতি ইন্স্যুরেন্সের নামে কেটে নেওয়া টাকার হিসাব এবং লভ্যাংশসহ টাকা ফেরত দেওয়ার দাবি করা হয়।
১৩ নম্বর দফায় বলা হয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ডায়াবেটিক হাসপাতালের অনুদানের টাকা জাহাঙ্গীর চৌধুরী তার ব্যক্তিগত ফান্ডে নিয়ে খরচ করেন। অবিলম্বে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা মোতাবেক সাড়ে ২৭ লক্ষ টাকা জাহাঙ্গীর চৌধুরীকে ডায়াবেটিক হাসপাতালের ফান্ডে জমা দিতে হবে। এছাড়া হাসপাতালের ফার্মেসি থেকে নেওয়া তার পরিবারের সদস্যদের কয়েক লক্ষ টাকার ইনসুলিন ও ওষুধের বকেয়া টাকা হাসপাতালের ফান্ডে ফেরত দেওয়ার দাবি করা হয়।
আন্দোলনকারীরা হাসপাতালের দৈনিক আয় ১০ লাখ টাকার উপরে হলেও এ হাসপাতালের ফান্ডে কোনো এফডিআর নেই কেন প্রশ্ন তুলে তার তদন্ত দাবি করেন। এছাড়া কোটি কোটি টাকা কোথায় খরচ হলো তার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করা হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ২ কোটি টাকার অনুদান হাসপাতালের ফান্ডে জমা না দিয়ে ব্যক্তিগত ফান্ডে কেন জমা হলো প্রশ্ন তুলে তার তদন্ত করতে হবে বলে ১২তম দফায় দাবি জানানো হয়।