চসিকের বিদ্যুৎ প্রকল্পটি বাতিল

কর্ণফুলী নদীর চর বাকলিয়া

মোরশেদ তালুকদার | রবিবার , ৬ অক্টোবর, ২০২৪ at ৫:৪৬ পূর্বাহ্ণ

পরিবেশবাদীসহ সচেতন মহলের আপত্তি উপেক্ষা করে কর্ণফুলী নদীর চর বাকলিয়ায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) গৃহীত বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পটি বাতিল করা হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে কর্ণফুলী নদী দূষণের পাশাপাশি জীববৈচিত্র্যসহ পরিবেশপ্রতিবেশগত ভারসাম্য বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই প্রকল্পের জন্য প্রস্তাবিত ৩৫ একর ভূমি নামঞ্জুর করে দেয় ভূমি মন্ত্রণালয়। বিষয়টি গত বৃহস্পতিবার বোয়ালখালী উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে জানিয়ে দেয় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। এর আগে গত বছর প্রকল্প বাস্তবায়নে চসিকের অনূকূলে প্রতীকী মূল্যে ভূমি বরাদ্দ চেয়ে মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়। প্রকল্প বাতিলের বিষয়টি নিশ্চিত করে চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম আজাদীকে বলেন, বিষয়টি আমাকে জানানো হয়েছে। তবে এখনো অফিসিয়ালি চিঠি পাইনি। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসনের রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর মো. রাজিব হোসেন আজাদীকে বলেন, বর্জ্য শোধনাগার স্থাপনের প্রস্তাবটি নামঞ্জুর করেছে মন্ত্রণালয়। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তদারকি করে সিদ্ধান্তটি সংশ্লিষ্টদের জানানো হয়েছে।

জানা গেছে, শাহ আমানত সেতু থেকে আনুমানিক দেড় কিলোমিটার উজানে নদীর মাঝখানে চর বাকলিয়া। ১৯৩০ সালে অর্থাৎ কালুরঘাট সেতু নির্মাণের কারণে পলি জমে ধীরে ধীরে নদীর মাঝখানে এই চর জেগে ওঠে। চরের মোট আয়তন প্রায় ১০৫ একর বলে স্থানীয়দের ধারণা। বর্তমানে চরটি সরকারি ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত।

এদিকে চর বাকলিয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন প্ল্যান্ট স্থাপন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আপত্তি জানিয়ে আসছে পরিবেশবাদীসহ সচেতন মহল। তারা বলছেন, চর বাকলিয়া উদ্ভিদ বৈচিত্র্যে ভরপুর। এখানে রয়েছে স্বর্ণলতাসহ বিরল ১১৩টি ঔষধিসহ ১৫৫ প্রজাতির উদ্ভিদ। বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট হলে যা ধ্বংস হয়ে যাবে। একইসঙ্গে এ চর হচ্ছে পাখিসহ বিভিন্ন প্রাণীর আবাসস্থল। প্ল্যান্ট হলে সেটাও নষ্ট হবে। এছাড়া চট্টগ্রাম শহর থেকে বর্জ্য আনানেওয়ার ক্ষেত্রে তা নদীতে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেক্ষেত্রে দূষিত হবে কর্ণফুলী। এমনকি হালদা নদীর মোহনা কাছে হওয়ায় দূষণের শিকার হতে পারে হালদাও। শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটি বাতিল হওয়ায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন তারা।

চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক আলিউর রহমান আজাদীকে বলেন, ২০১৯ সালে হাই কোর্ট নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করেছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৮ () অনুসারে পরিবেশ সংরক্ষণ, প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তার বাধ্যবাধতা আছে। সে হিসেবে নদীর মাঝে জেগে ওঠা চরে বর্জ্য শোধন প্রকল্প অবৈধ। আমরা এ বিষয়ে দাবি জানিয়ে আসছিলাম। শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটি বাতিল হওয়ায় কর্ণফুলী ধ্বংস হওয়া থেকে রক্ষা পাবে।

জানা গেছে, চীনের প্রতিষ্ঠান সেভিয়াচেকঅর্চাড জেভির কর্ণফুলী নদীতে জেগে ওঠা চর বাকলিয়ায় বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্ল্যান্ট বসানোর প্রস্তাব দেয় চসিককে; যা মন্ত্রণালয়কে জানিয়ে দেয় চসিক। এছাড়া গত দুই যুগে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে আরো অন্তত ২০টি প্রস্তাব পায় চসিক। এর মধ্যে পরিবেশ ধ্বংস হওয়ার দাবি থাকা চর বাকলিয়ার প্রস্তাবটিতে আগ্রহ দেখায় মন্ত্রণালয়। তাছাড়া গত ৫ মার্চ পরিবেশ অধিদপ্তরও অনাপত্তি দেয়।

জানা গেছে, গত বছরের ২ নভেম্বর স্থানীয় সরকার বিভাগকে একটি চিঠি দেয় চসিক। এতে উল্লেখ করা হয়, বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক প্রস্তাবিত চর বাকলিয়ায় ৩৫ একর খাস জমি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের অনুকূলে বন্দোবস্ত প্রদানের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব প্রেরণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রশাসনিক অনুমোদন চায় চসিক। এ চিঠির ১৪ দিনের মাথায় ১৬ নভেম্বর ভূমি স্থানীয় সরকার বিভাগ প্রশাসনিক অনুমোদন দেয়।

এর আগে বোয়ালখালী উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) ২০২৩ সালের জুলাইয়ে জেলা প্রশাসনকে একটি প্রতিবেদন দেয়। ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে জেলা প্রশাসনের রাজস্ব শাখার পক্ষ থেকে সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে ২৩ জুলাই একটি চিঠি দেওয়া হয়। এতে বলা হয, বোয়ালখালীর সহকারী কমিশনারের (ভূমি) প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ওই ৩৫ একর জমি একটি বিচ্ছিন্ন চর। চরে চলাচলের কোনো রাস্তা নেই। মূল ভাগের সাথে ব্রিজ নির্মাণ করে সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব নয় মর্মে প্রতীয়মান হয়। সেভিয়াচেকঅর্চাড জেভির সাথে মৌখিক আলাপে জানা যায়, ওই সংস্থা বার্জ শিপের মাধ্যমে কর্ণফুলী নদীর মাধ্যমে প্রকল্প এলাকায় বর্জ্য পরিবহন করবে।

এরপর প্রকল্পটির জন্য মন্ত্রণালয়ে ভূমি বরাদ্দের প্রস্তাব দেয় জেলা প্রশাসন; যা নামঞ্জুর দেয় ভূমি মন্ত্রণালয়। নামঞ্জুর করে দেওয়া ভূমি মন্ত্রণালয়ের পত্রে বলা হয়, কর্ণফুলী নদীর চরে বর্জ্য শোধনাগার স্থাপন করা হলে নদীর পানি দূষিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে এবং জীববৈচিত্র্যসহ পরিবেশপ্রতিবেশগত ভারসাম্য মারাত্মকভাবে বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালী উপজেলার চর বাকলিয়া মৌজার বিএস ১ নম্বর খতিয়ানভুক্ত ৫৪৪ নম্বর দাগের ৩৫ একর জমিতে বর্জ্য শোধনাগার স্থাপনের প্রস্তাবটি নামঞ্জুর করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, বেসরকারি উন্নয়ন ও গবেষণা সংস্থা ইফেক্টিভ ক্রিয়েশন অন হিউম্যান ওপিনিয়ন (ইকো) ২০২২ সালে তাদের একটি গবেষণায় চর বাকলিয়ার উদ্ভিদবৈচিত্র্য তুলে ধরে এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধিকল্পে সে গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করে। গবেষণায় চর বাকলিয়ায় মোট ১৫৫ প্রজাতির উদ্ভিদ শনাক্ত করেন। যার মধ্যে ৬৪ প্রজাতির বৃক্ষ, ২০ প্রজাতির বিরুৎ, ৫৭ প্রজাতির গুল্ম, ১২ প্রজাতির লতানো উদ্ভিদ ও পরাশ্রয়ী উদ্ভিদের সংখ্যা ছিলো ২টি। ১৫৫টি উদ্ভিদের ভিতর ১১৩টি ঔষধি গাছ বিদ্যমান।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুক রাসেল আজাদীকে বলেন, বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট করলে চর বাকলিয়ার সামগ্রিক পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হবে। সেখানে প্রচুর উদ্ভিদ আছে। সেটা স্বর্ণলতার হাব। সাধারণত অন্য কোথাও স্বর্ণলতা পাওয়া যায় না।

পূর্ববর্তী নিবন্ধগভীর রাতে কেমিক্যাল কারখানায় দুর্বৃত্তের হামলা
পরবর্তী নিবন্ধতিন মাস পর আজ খুলছে চবি