ভয়াবহ বিস্ফোরণ এবং অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের মালিকানাধীন এমটি বাংলার জ্যোতি জাহাজটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও জাহাজটির হ্যাজে থাকা ৮৫ কোটি টাকার ক্রুড অয়েলের গুণগতমান একেবারে অটুট রয়েছে। বিস্ফোরক অধিদপ্তরের পরিদর্শন এবং গুণগত মান পরীক্ষার পর ক্রুড অয়েলগুলোর খালাস কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আজকের মধ্যে জাহাজে থাকা প্রায় ১১ হাজার টন ক্রুড অয়েল খালাস সম্পন্ন হবে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন সূত্র জানিয়েছে, দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত একমাত্র জ্বালানি তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারিতে পরিশোধন করার জন্য আবুধাবীর এডনক কোম্পানি থেকে ক্রুড অয়েল আমদানি করা হয়। আমদানিকৃত ৯৮ হাজার ৩৮৩ টন মারবান ক্রুড অয়েল নিয়ে আসা বৃহদাকার মাদার ভ্যাসেল এমটি ওমেরা লিগ্যাসি থেকে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের জাহাজ এমটি বাংলার সৌরভ এবং এমটি বাংলার জ্যোতি জাহাজের মাধ্যমে ক্রুড অয়েল লাইটারিং করা হচ্ছিল। এরমধ্যে গত ৩০ সেপ্টেম্বর এমটি বাংলার জ্যোতি ১১ হাজার ৭১৬ টন ক্রুড অয়েল নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর ৭ নম্বর ডলফিন জেটিতে বার্থিং নেয়। জাহাজ থেকে ক্রুড অয়েল খালাস কার্যক্রম পরিচালনার সময় ওইদিন সকাল ১১টা নাগাদ জাহাজটিতে ভয়াবহ রকমের বিস্ফোরণ এবং অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে তিনজনের প্রাণহানীসহ জাহাজটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
জাহাজটিতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে এবং কালো ধোঁয়ায় চারদিকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। আশঙ্কা করা হচ্ছিল যে, জাহাজের হ্যাজে থাকা ক্রুড অয়েলগুলোও পুড়ে গেছে কিংবা গুণগত মান নষ্ট হয়ে গেছে। ঘটনার পর পরই বাংলাদেশ নৌ বাহিনী, বাংলাদেশ বিমান বাহিনী, কোস্টগার্ড, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, ফায়ার সার্ভিস এবং ইস্টার্ন রিফাইনারির ফায়ার ফাইটিং ইউনিট সমন্বিতভাবে আগুন নিভানোর কাজ শুরু করে। ফায়ার সার্ভিসের ৮টি ইউনিটের পাশাপাশি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের টাগবোট কাণ্ডারি ২, ৩, ৪, ৮, ১০ এবং বাংলাদেশ নেভির জাহাজ শিবশা থেকে আগুন নিয়ন্ত্রণের দুর্দান্ত এক অভিযান পরিচালনা করা হয় এবং বিস্ময়করভাবে মাত্র দেড় ঘণ্টার চেষ্টায় জাহাজটির আগুন পুরোপুরি আয়ত্বে আনা সম্ভব হয়। আগুন নিভানোর পর জাহাজটিতে পরিদর্শন করে কর্মকর্তারা লক্ষ্য করেন যে, আগুনে জাহাজের ব্যাপক ক্ষতি হলেও হ্যাজের দিকে আগুন যায়নি। তবে তীব্র তাপের মধ্যে ক্রুড অয়েলের গুণগত মান অক্ষুন্ন রয়েছে কিনা তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সংশয় প্রকাশ করেন।
এতে করে আগুন পুরোপুরি নিভানোর পরও জাহাজটি থেকে তেল গ্রহণ থেকে বিরত থাকে ইস্টার্ন রিফাইনারি। তেলের গুণগত মান সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে ক্রুডঅয়েলগুলো রিফাইনারির ট্যাংকে নেয়া ঠিক হবে না বলেও মন্তব্য করা হয়। ওই সময় বলা হয় যে, ক্রুড অয়েলের গুণগত মান পরীক্ষাসহ বিস্ফোরক অধিদপ্তরের ক্লিয়ারেন্স পাওয়ার পরই কেবল রিফাইনারি ক্রুড অয়েলগুলো ট্যাংকে নিয়ে যাবে। ফলে ওইদিন ক্রুড অয়েল খালাস বন্ধ রাখা হয়। পরদিনও বন্ধ থাকে জাহাজটির ক্রুড অয়েল খালাস কার্যক্রম। গত মঙ্গলবার বিস্ফোরক অধিদপ্তরের একটি টিম জাহাজটি পরিদর্শন করে। একই সাথে জাহাজ থেকে সংগ্রহ করা হয় ক্রুড অয়েলের নমুনা। পরীক্ষা নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, তীব্র তাপেও জাহাজের হ্যাজে থাকা ক্রুড অয়েলের গুণগত মানে কোন সমস্যা হয়নি।
গতকাল পরীক্ষা রিপোর্ট পাওয়ার পর জাহাজ থেকে ক্রুড অয়েল খালাস শুরু করা হয়। প্রায় ১১ হাজার টন ক্রুড অয়েল খালাস করতে ২২ ঘণ্টার মতো সময় লাগবে। আজ দুপুরের মধ্যে ক্রুড অয়েল খালাস কাজ সম্পন্ন হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে সূত্র বলেছে যে, এরপরই এমটি বাংলার জ্যোতিকে ডলফিন জেটি–৭ থেকে সরিয়ে মেরামতের জন্য পাঠানো হবে।
বিপিসির দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা গতকাল দৈনিক আজাদীকে বলেন, ক্রুড অয়েলের চালানটি প্রতিটন ৬শ’ ডলার দরে আবুধাবি থেকে আমদানি করা হয়। এমটি বাংলার জ্যোতি জাহাজে ৮৫ কোটি টাকার ক্রুড অয়েল ছিল। গুণগত মান অটুট থাকায় ক্রুড অয়েলগুলো রক্ষা পেয়েছে। আগুন নিভানোর কাজে সর্বাধুনিক এবং সমন্বিত অভিযান পরিচালিত না হলে জাহাজটির হ্যাজেও আগুন লেগে যেতো। ওই পরিস্থিতি তৈরি হলে শুধু ৮৫ কোটি টাকার ক্রুড অয়েলই নয়, একই সাথে ১১ হাজার টন তেলের বিশাল এবং ভয়ংকর এক আস্তরণ তৈরি হতো নদী ও সাগরে। যা বড় ধরণের পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ হয়ে উঠতো। ভাগ্যক্রমে আগুনের বিস্তার ঘটেনি বলেও ওই কর্মকর্তা মন্তব্য করেন।
ইস্টার্ন রিফাইনারির দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা এমটি বাংলার জ্যোতি থেকে ক্রুড অয়েল খালাস করা হচ্ছে বলে জানিয়ে দৈনিক আজাদীকে বলেন, ক্রুড অয়েলে কোন সমস্যা হয়নি। এগুলো পরিশোধন করে ডিজেল, পেট্রোল, অকটেন, জেট ফুয়েল, এলপিজিসহ বিভিন্ন ধরণের পেট্রোলিয়াম পণ্য উৎপাদন করা হবে।