রিকশা থেকে নিউ মার্কেট শাহ আমানত মার্কেটের সামনে নামতেই কাছে ছুটে আসে ছয়–সাত বছর বয়সী এক কিশোর। হাতে ছিল কিছু পত্রিকা। কাছে এসেই বায়না ধরে তার থেকে একটা পত্রিকা কিনতে। নতুবা তাকে খাওয়ার জন্য কিছু টাকা দিতে হবে। টাকা না দিয়ে সামনে হাঁটলে পিছন পিছন চলে আসে কিশোরটি। পরিচয় জানতে চাইলে বলতে পারেনি ছেলেটি। শুধু চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে রাস্তার পাশে মায়ের সাথে থাকে সেটাই জানাল। নগরে এ রকম অসংখ্য শিশু–কিশোর–কিশোরী রয়েছে। যাদের কোনো পরিচয় নেই। মানুষ তাদের নাম দিয়েছে পথশিশু, ভাসমান বা সুবিধাবঞ্চিত। এসব শিশুর বেশিরভাগ মা অথবা বাবার পরিচয় নেই।
অনেকের আবার মা–বাবা থাকা সত্ত্বেও তাদের স্থান হয়েছে রাস্তায়। অল্প বয়সে মা হারানোয় বাবা অন্যত্র বিয়ে করেছে, সৎ মা আর জায়গা দেয় না এ রকমই রয়েছে অনেক শিশু। এদের বেশিরভাগ শিক্ষার আলো খুঁজে পায় না। জীবিকার তাগিদে লেগে যায় নানা কাজে। সঠিক তদারকি আর অভিভাবকত্ব না পাওয়ায় এসব সুবিধাবঞ্চিতরা জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধে। এ নিয়ে সরকারের সেবা সংস্থার বেশি বেশি উদ্যোগ এবং নজরদারি দরকার বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
আজ ২ অক্টোবর জাতীয় পথশিশু দিবস। দেশের পথশিশুদের সুরক্ষা ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রতিবছর আমাদের দেশে পালিত হয় এই দিবস। বলা হয়, আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। মায়ের কোল হলো একজন শিশুর নিরাপদ আশ্রয়স্থল। ক্ষুধার জ্বালায় কিংবা ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে যখন কোল ছেড়ে শিশুরা মা–বাবার ঘর ছাড়া হয়ে রাস্তায় জায়গা হয় তখনই তাদের পরিচয় হয় পথশিশু। রাস্তাঘাটে এক টাকা–দুই টাকার জন্য তারা পথচারীকে অনুরোধ করে নানাভাবে। কেউ কেউ আবার কাগজ কুড়াতে দেখা যায়। অনেকে বেঁচে নেন অন্যের চাকরি করা। জানা যায়, পথে পথে বেড়ে ওঠা এসব শিশুর তিন বেলা খাবার, মাথার ওপর ছাদ বা গায়ের কাপড় জোটে না। তাদের রাত কাটে রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড কিংবা রাস্তার পাশে।
২০২২ সালের পরিসংখ্যান ব্যুারোর একটি জরিপে দেখা যায়, দেশে পথশিশুদের ৮২ শতাংশ ছেলে এবং ১৮ শতাংশ মেয়ে। এদের মধ্যে ৩৭ দশমিক ৮ শতাংশ পথশিশু ক্ষুধা বা দারিদ্রতার জন্য বাড়ি ছেড়েছে। এর মধ্যে ৫ থেকে ৯ বছর বয়সী পথশিশু ১৯ দশমিক ২ শতাংশ, ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী পথশিশু রয়েছে ৫৪ শতাংশ এবং ১৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী পথশিশু ২৬ দশমিক ৭ শতাংশ। পথশিশুদের গড় বয়স ১২ দশমিক ৩ বছর। পথশিশু হওয়ার কারণ হিসেবে জরিপে পাঁচটি বিষয় উঠে আসে।
এর মধ্যে ৩৭ দশমিক ৮ শতাংশ পথশিশু দারিদ্রতা বা ক্ষুধার কারণে, ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ বাবা–মা শহরে আসার কারণে এবং ১২ দশমিক ১ শতাংশ কাজের সন্ধানে বাড়ি ছেড়ে শহরে এসেছে। প্রতি পথশিশুর ৫ জনের ২ জনই একা একা শহরে এসেছে। জানা যায়, পথশিশুর প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে সরকারিভাবে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। জানা গেছে, ২০০৪ সালে দেশে পথশিশুর সংখ্যা ছিল ৬ লাখ ৭৯ হাজারের কিছু বেশি। ২০১৪ সালে এ সংখ্যা হয় ১১ লাখ ৪৪ হাজার। একইভাবে ২০২৪ সালে এ সংখ্যা ১৬ লাখ হবে বলে ধরে নেওয়া হয়। আরেকটি জরিপে দেখা যায়, দশজন পথশিশুর তিনজন কখনো স্কুলে ভর্তি হয়নি। সকল পথশিশুর কেবল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ পঞ্চম শ্রেণি পাস করেছে। খুব নগণ্য সংখ্যক পথশিশু নিম্ন ও উচ্চ মাধ্যমিকে পড়াশুনা করেছে। প্রায় চার ভাগের একভাগ পথশিশু ধূমপান করে এবং ১২ শতাংশ মাদকের নেশায় আসক্ত এবং ৬৪ শতাংশ পথশিশু তাদের পরিবারে ফিরে যেতে চায় না।
চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নগরের রেলওয়ে স্টেশনের আশপাশে অসংস্য সুবিধাবঞ্চিত শিশু। এছাড়া নগরের প্রায় জায়গায় দেখা মিলে এসব ভাসমান শিশু–কিশোরদের। চট্টগ্রামে নগরে কী পরিমাণ এরকম পথশিশু রয়েছে এর সঠিক কোনো তথ্য জানা যায়নি। তবে পথশিশু বা সুধিাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করা একাধিক সংগঠন বা সংস্থার সাথে কথা বলে জানা গেছে এই সংখ্যা অন্তত ১০ হাজারের অধিক।
সংশ্লিষ্টরা জানান, মা–বাবার আদর ছাড়া বেড়ে ওঠা এই সন্তানগুলো জানে না তাদের অধিকার। ক্ষুধার তাড়নায় এসব শিশুরা জড়াচ্ছে নানা অপরাধে। খেয়ে না খেয়েই অনেকের কেটে যায় বেলা। কোনো কোনো শিশু একটু আধটু রোজগারও করে। ক্ষুধা মিটলেই ঘুম, সেটা যেখানেই হোক। তাদের এদিক ওদিক ছোটোছুটিই যেন ক্ষুধা মেটানোর জন্য। ঘরের অন্য শিশুদের মতো নেই এদের সুন্দর জামা কাপড়, নেই খাওয়া দাওয়া। শিশুদের এমন অবহেলায় বেড়ে উঠা সমাজের জন্যই বিপজ্জনক বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া এই শিশুদের সমাজের মূলধারায় যুক্ত করা তাদের খাবার ও শিক্ষার ব্যবস্থা করতে শুধু সরকার নয়, বেসরকারি ও ব্যক্তি পর্যায়েও উদ্যোগ নেওয়া জরুরি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
পথশিশুদের নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করে নগরফুল নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। ‘সুবিধাবঞ্চিত ও পথশিশু মুছে নগরফুল গড়ার প্রত্যয়ে’ স্লোগানে ২০১৫ সাল থেকে সংগঠনটি চট্টগ্রামসহ সারাদেশে সুবিধাবঞ্চিত এবং পথশিশুদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য কাজ করে আসছে। শিশুদের শিক্ষার সুযোগ তৈরি, স্বাস্থ্য সেবা প্রদান এবং একটি সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানসহ নানা কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে সংগঠনটি। সংগঠনটি সব সময় পথশিশুদের জীবনে স্বপ্ন দেখার এবং সেই স্বপ্ন পূরণের পথ সুগম করতে চেষ্টা করছে বলে জানান সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা বায়েজিদ সুমন। তিনি আজাদীকে বলেন, আমার বিশ্বাস, পথশিশুদের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে পারলে আমরা একটি মানবিক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে সক্ষম হবো। আমরা যেন প্রতিটি পথশিশুর জীবনে স্বপ্নের আলো জ্বালাতে পারি, সেই দায়িত্ব আমাদের সকলের। তাদের হাত ধরে একটি সুন্দর, সমান সুযোগের সমাজ গড়ে তোলা আমাদের একান্ত প্রয়োজন। পথশিশু দিবসে আমি সবার প্রতি আহ্বান জানাই, আসুন আমরা সকলে একত্রে কাজ করে তাদের জন্য একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ি। তিনি বলেন, নগরফুল এক দশক ধরে বেশি সময় ধরে সমাজের অবহেলিত শিশুদের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে কাজ করে যাচ্ছে। শিক্ষার মাধ্যমে শিশুদের ক্ষমতায়ন, স্বাস্থ্য সেবার মাধ্যমে তাদের সুস্থ জীবন নিশ্চিত করা এবং তাদের স্বপ্ন পূরণের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করা নগরফুলের মূল লক্ষ্য।
পথের পাঁচালি নামে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করে আরেকটি সংগঠন। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক নাঈম উদ্দিন বলেন, ২০১৭ সাল থেকে আমরা সুবিধাবঞ্চিতা শিশুদের নিয়ে কাজ করে আসছি। এর মধ্যে শিশুদের জন্মনিবন্ধন করিয়ে দেওয়া, তাদের হাতেকলমে শিক্ষা প্রদান করা এবং অপরাধমূলক কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য সচেতনতা সৃষ্টি করা অন্যতম।