চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) ৬ষ্ঠ পরিষদের নির্বাচিত মেয়র এবং কাউন্সিলর কেউ দায়িত্বে নেই। সবাইকে অপসারণ করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। মেয়রের পরিবর্তে নিয়োজিত প্রশাসক দায়িত্ব পালন করছেন। একইসঙ্গে চসিকের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনায় প্রশাসকসহ ২১ সদস্যের একটি কমিটি রয়েছে, যারা কাউন্সিলরের দায়িত্ব পালন করছেন। আবার ৬ষ্ঠ পরিষদ নির্বাচনে বিএনপির মেয়র প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেনের দায়ের করা মামলায় রায়ে তাকে মেয়র ঘোষণা করা হয়েছে। একইসঙ্গে নির্বাচন কমিশনকে ১০ দিনের মধ্যে গেজেট প্রকাশের নির্দেশ দেয়া হয়।
এ অবস্থায় বিষয়গুলো নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। আইন বিশেষজ্ঞদের অনেকে বলছেন, গতকাল ঘোষিত রায়ের মাধ্যমে ডা. শাহাদাত হোসেনের মেয়র হওয়ার পথ সুগম হল। আবার অনেকে নানা আইনি জটিলতা দেখছেন। তারা বলছেন, ভোটের গেজেট প্রকাশ করতে হলে ফুল নির্বাচন কমিশনের অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গত মাসে পদত্যাগ করেছেন। তাই নতুন নির্বাচন কমিশন না হওয়া পর্যন্ত গেজেট প্রকাশ করা যাবে না। তবে ডা. শাহাদাত হোসেনের দাবি, ফুল নির্বাচন কমিশন না থাকলেও গেজেট প্রকাশে বাধা নেই। কারণ আদালত ইসিকে নয়, নির্বাচন কমিশন সচিবকে ১০ দিনের মধ্যে গেজেট প্রকাশের নির্দেশনা দেন। তাই আদালতের নির্দেশিত ১০ দিনের মধ্যে গেজেট প্রকাশ করা হবে বলে মনে করেন শাহাদাত। এদিকে অনেকে বলছেন, বিশেষ পরিস্থিতির কারণে মেয়র ও কাউন্সিলরদের অপসারণ এবং প্রশাসক নিয়োগ হয়েছে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে। ডা. শাহাদাত হোসেন মেয়র হলে ওই প্রজ্ঞাপন আগে বাতিল করতে হবে।
এদিকে আইন অনুযায়ী, নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক মামলার রায় ঘোষণার ৩০ দিনের মধ্যে উপধারা (১) এর অধীন গঠিত নির্বাচনী আপিল ট্রাইব্যুনালে আপিল দায়ের করার সুযোগ আছে। নির্বাচনী আপিল ট্রাইব্যুনাল কর্পোরেশনের নির্বাচন সংক্রান্ত যে কোনো আপিল দায়ের করার ১৮০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করবে। এখন কেউ আপিল করলে নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্তও গেজেট প্রকাশ করা যাবে না।
সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের আইন অনুবিভাগের যুগ্মসচিব নুরুল ইসলাম আজাদীকে বলেন, সবার কাছেই বিষয়টি নিয়ে কৌতুহল আছে এবং জটিল মনে হচ্ছে। কিন্তু বিষয়টি অতটা জটিল নয়। কারণ রেজাউল করিম চৌধুরীকে অপসারণ করে সরকার প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে। এই মামলা তো আগে থেকে দায়ের করা ছিল ইলেকশন ট্রাইব্যুনালে। সরকার মেয়রকে অপসারণ করে প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে সেটা তো ট্রাইব্যুনাল জানে না। ট্রাইব্যুনাল ওই মামলাটাকেই বিচার করেছে এবং ট্রাইব্যুনালের কাছে যেটা সঠিক মনে হয়েছে, আগের মেয়র (রেজাউল করিম চৌধুরী) নির্বাচিত নন, তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে যিনি (ডা. শাহাদাত) ছিলেন তার নামে গেজেট প্রকাশ করতে বলেছে। এটা কোর্টের দৃষ্টিকোণ থেকে সেই রায়টা দিয়েছে যেটা সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে পেয়েছে।
তিনি বলেন, বাস্তবতা হচ্ছে যাকে বাদ দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে মেয়র ঘোষণার জন্য কোর্ট ডিরেকশন দিয়েছে তাকে সরকার ইতোমধ্যে বাদ দিয়ে দিয়েছে। কাজেই এটা অনেকটা অকার্যকর এই জন্য, তার নামে গেজেট করলেও কি হবে এখন। পুরো দেশের সবগুলো স্থানীয় সরকারের ক্ষেত্রে সরকার নির্বাচিত মেয়রদের অপসারণ করে প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে। এই রায়টা যদি কয়দিন আগে হত তাহলে ডা. শাহাদাতও ওই বাদের মধ্যে পড়ে যেতেন। তিনি বলেন, তাছাড়া এখন যেহেতু কমিশনার নেই গেজেটও প্রকাশ করা যাবে না। কোর্ট যদি ডিরেকশন দিয়ে থাকে তাহলে রায়ের কপি কমিশনে আসবে। এই রায়ের কপি দেখে কমিশন একটা সিদ্ধান্ত নিবেন। সংশ্লিষ্ট আইনগুলো পর্যালোচনা করে তারপর আমরা দেখব বিকল্প কোনো ব্যবস্থা আছে কিনা। যদি বিকল্প থাকে সে অনুযায়ী যতদূর বাস্তবায়ন সম্ভব ততদূর বাস্তবায়ন হবে। যদি বাস্তবায়ন অযোগ্য হয় তাহলে কিছুই করা যাবে না।
রায়ের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে কোনো আপিল করা হবে কিনা জানতে চাইলে বলেন, কমিশন তো কোনো মামলা করেনি। করছেন মেয়র প্রার্থী। এখন আপিল করলে রেজাউল করিম করতে পারেন। কমিশনের আপিল করার সুযোগ নেই।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ আজাদীকে বলেন, রায়ের প্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন কী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। যেহেতু রায়ের আগেই সমস্ত মেয়রকে অপসারণ করা হয়েছে। তবে সরকার চাইলে বেসামরিক লোককে প্রশাসক নিয়োগ দিতে পারে।
চট্টগ্রামের সমমনা আইনজীবী সংসদের সাংগঠনিক সম্পাদক তৌহিদুল মুনির চৌধুরী টিপু আজাদীকে বলেন, পুরো রায় না পড়ে মন্তব্য করা একটু কঠিন। সরকার ইতোমধ্যে মেয়রদের অপসারণ করেন। আবার আদালত রায় দিল। এখানে একটু জটিলতা আছে। তবে কোর্টের আদেশ তো সরকারও মানতে বাধ্য।
ডা. শাহাদত হোসেনের আইনজীবী মফিজুল হক ভূঁইয়া আজাদীকে বলেন, দুটো বিষয় আছে। প্রশাসনিক আদেশ এবং বিচারিক আদেশ। প্রশাসনিক আদেশে প্রশাসক নিয়োগ করেছে। আবার বিচারিক আদেশে ডা. শাহাদাত হোসেনকে মেয়র ঘোষণা করা হয় এবং ১০ দিনের মধ্যে প্রজ্ঞাপন জারির জন্য নির্বাচন কমিশন সচিবকে নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। এখন আদালতের আদেশ যখন নির্বাচন কমিশনে যাবে তখন তারা কিভাবে এই আদেশ কার্যকর করবে, নাকি করবে না অথবা আইনি কোনো জটিলতা থাকলে সেটা সমাধান করবে।
জানা গেছে, ২০২১ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জানুয়ারি চসিকের ষষ্ঠ পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এতে ৩ লক্ষ ৬৯ হাজার ২৪৮ ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন রেজাউল করিম চৌধুরী। একই বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি শপথ নেন তিনি। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্বগ্রহণ করেন ১৫ ফেব্রুয়ারি। সর্বশেষ গত ১৯ আগস্ট তাকে অপসারণ করা হয়। একইদিন বিভাগীয় কমিশনার মো. তোফায়েল ইসলামকে প্রশাসক পদে নিয়োগ দেয়া। এছাড়া গত ২৭ সেপ্টেম্বর অপসারণ করা হয় কাউন্সিলরদের। একইদিন প্রশাসকের নেতৃত্বে ২১ সদস্যের কমিটি করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এর মধ্যে প্রশাসকদের অপসারণ করা হয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’ এর ধারা ১৩ক প্রয়োগ করে। একই আইনের ২৫ক–এর উপধারা (১) প্রয়োগ করে প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হয়। কমিটি গঠন করা হয়েছে ২৫(ক)(২) ধারা অনুযায়ী। ২৫(ক) ধারায় বিশেষ পরিস্থিতিতে প্রশাসক নিয়োগ ও কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে সরকারের ক্ষমতা বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়।
এছাড়া ২৫(ক)(২) ধারায় বলা আছে, ‘সরকার প্রয়োজনবোধে যথাযথ বলে বিবেচিত হয় এমন সংখ্যক সদস্য সমন্বয়ে গঠিত কমিটিকে প্রশাসকের কর্মসম্পাদনে সহায়তা প্রদানের জন্য নিয়োগ করতে পারবে’।