সেরগেই বন্দরচুক

মানবতাবাদী এক মহান চলচ্চিত্রকার

শাহরিয়ার আদনান শান্তনু | সোমবার , ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ at ৬:১২ পূর্বাহ্ণ

১৯৩১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর কোলকাতার হিজলি ও চট্টগ্রামের কারাগারে রাজবন্দীদের উপর নির্মম নির্যাতনের প্রতিবাদে কোলকাতার গড়ের মাঠে এক বিরাট প্রতিবাদী জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সভাপতির বক্তব্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন: “প্রথমেই বলে রাখা ভালো, আমি রাষ্ট্রনেতা নই। আমার কর্ম ক্ষেত্র রাষ্ট্রিক আন্দোলনের বাইরে। কর্তৃপক্ষকৃত কোন অন্যায় বা ত্রুটি নিয়ে সেটাকে আমাদের রাষ্ট্রীয় খাতায় জমা করতে আমি বিশেষ আনন্দ পাইনে। এই যে হিজলির গুলি চালানোর ব্যাপারটি আজ আমাদের আলোচ্য বিষয়, তার শোচনীয় কাপুরুষতা ও পশুত্ব নিয়ে যা কিছু আমার বলবার সে কেবল অবমানিত মনুষ্যত্বের দিকে তাকিয়ে। ”

রাশিয়ান চলচ্চিত্রকার সেরগেই বন্দরচুককে নিয়ে লিখতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথকে আনতে হলো। কারণ, তাঁর বক্তব্য। ১৯৩১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা আজও স্মরণীয়। আজও বিশ্বময় চলছে কাপুরুষতা ও পশুত্বের লড়াই। যেমন উদাহরণ দিয়ে বলা যায় : সামপ্রতিক সময়ে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার নিয়ে যুদ্ধ। এখানে ঠিকই চলছে পশুত্বের লড়াই। অবমানিত মনুষ্যত্ব।

বিশত্রিশ দশকে ইউরোপে জেগে ওঠা ফ্যাসিবাদের অভ্যুদয় এবং মানবতা বিধ্বংসী সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ চলেছিল, তা বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। আর এর বিরুদ্ধে মানবিকতাকে সমুন্নত রাখতে এগিয়ে এসেছিলেন নাট্যকার, চলচ্চিত্রকার, উপন্যাসিকগণ। যুদ্ধবিরোধী অনেক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন, ইউরোপ ও আমেরিকায়। তবে এইসব চলচ্চিত্র নির্মাণে মানবিকতার বিষয়টি সবচেয়ে বেশি প্রতিভাত হয়েছে সোভিয়েত চলচ্চিত্রে। যেখানে আমেরিকার যুদ্ধবিরোধী চলচ্চিত্রে নৃশংসতা, হত্যা, ভায়োলেন্সকে মুখ্য করা হয়। কিন্তু সোভিয়েত চলচ্চিত্রগুলোয় প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে মানবাধিকার ও মানবতাকে। এই দৃষ্টিকোণে যুদ্ধবিরোধী চলচ্চিত্রে সোভিয়েত ধারা আজও মনে গেঁথে আছে।

The Fate of A Man চলচ্চিত্রের নির্মাতা সেরগেই বন্দরচুক। তিনি শুধু সোভিয়েত চলচ্চিত্র জগতে নয়, বিশ্ব চলচ্চিত্র জগতের বিখ্যাত একজন অভিনেতা ও চলচ্চিত্র পরিচালক। ১৯৫২ সালে তিনি সোভিয়েত গণ শিল্পীর মর্যাদায় সম্মানিত হয়েছিলেন। ১৯৬০ সালে পুরস্কৃত হয়েছিলেন “লেনিন পদকে”।

সেরগেই বন্দরচুকের শিল্পজীবন শুরু হয়েছিল অভিনেতা হিসেবে। রস্তোভএর থিয়েটার ইনস্টিটিউটে পড়াশোনা করতে ভর্তি হয়েছিলেন। সেখানে তিনি ছিলেন পুদভকিনের ছাত্র। কিন্তু পড়ালেখা শেষ হলো নাদ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে। যুদ্ধ বন্দরচুকের জীবনে ছাত্রাবস্থায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলেছিল বলে অনুমান করতে পারি। পরে তিনি ১৯৪৬ সালে মস্কো ফিল্ম ইনস্টিটিউটে অভিনয় ফ্যাকাল্টিতে ভর্তি হয়েছিলেন। এই বিভাগে তিনি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সেরগেই গেরাসিমভকে। বন্দরচুকের অভিনয় দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে গেরাসিমভ তাঁকে চলচ্চিত্রকার ইগর শেভচেস্কো্থর কাছে পাঠালেন। তখন ইগর তারাস শেভচেস্কোর উপর একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজ করছিলেন। বন্দরচুক তারাস শেভচেস্কোর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন এবং খ্যাতি লাভ করেন। এরপর বন্দরচুক আরো বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এবং তাঁর অভিনয় প্রশংসিত হয়। পরবর্তীতে শেক্সপীয়ারের “ওথেলো” চলচ্চিত্রে “ওথেলো”র ভূমিকায় অভিনয় করে বন্দরচুক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলেন।

কিন্তু একধরনের অতৃপ্তি কিংবা নতুন কিছু সৃষ্টি করার তাগিদ অনুভব করতে থাকেন সেরগেই বন্দরচুক। ততদিনে ঐতিহাসিক চরিত্রাভিনেতার ইমেজ হয়েছিল তাঁর। সেই ইমেজ ভেঙে বেরিয়ে এলেন ঞযব ঋধঃব ড়ভ অ গধহ চলচ্চিত্র নির্মাণ করে। বিখ্যাত উপন্যাসিক শলোখভের ঋধঃব ড়ভ অ গধহ প্রাভদা পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছিল। গল্পটি পড়ে বন্দরচুক মুগ্ধ হলেন। শুরু হলো নতুন অভিযাত্রা। ছাত্রজীবনে যুদ্ধের ভয়াবহতা ও নৃশংসতা তিনি প্রত্যক্ষ করেন। সেটাই তাঁকে তাড়িত করেছিল। যথেষ্ট যত্ন নিয়ে নির্মাণ করলেন এই চলচ্চিত্রটি। যুদ্ধের নানান দৃশ্য ফুটিয়ে তুলেন। মুক্তি পাবার পর সেরগেই বন্দরচুক চলচ্চিত্রকার হিসেবে রাতারাতি খ্যাতিলাভ করেন। বিখ্যাত “লা ফিগারো” পত্রিকায় ক্লদ মরিয়াক ঞযব ঋধঃব ড়ভ অ গধহ এর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে লেখা লিখলেন। এই চলচ্চিত্রটি নানান কারণে ব্যতিক্রমী। এর কারণ হিসেবে বলতে পারি যে, বন্দরচুক সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র আঙ্গিকে যুদ্ধ ও মানবতাকে উপস্থাপন করেছেন। যেখানে যুদ্ধ নয়আন্তরিক ও সংবেদনশীল মানবিকতা ফুটে উঠেছে।

পরবর্তীতে বন্দরচুক আরো চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: War and Peace, Waterloo, Red Bells-1, Red Bells -2,  They Fought for their country,  Quite Flows the Don  ইত্যাদি শুরুতেই রবীন্দ্রনাথের উক্তি দিয়ে বন্দরচুকের লেখা শুরু করেছিলাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একজন বড়মাপের দার্শনিক ছিলেন। সেই সময়ের তাঁর কথার প্রতিফলন আজও দেখতে পাই। যুদ্ধ আসলেই মানবতার হত্যাকারী। যুদ্ধকে অবশ্যই আমাদের থামাতে হবে। কীভাবে? প্রশ্নটা সেখানেই। সেরগেই বন্দরচুকের চলচ্চিত্রের ভাষায় বলি: অস্ত্র দিয়ে নয়। সমবেদনা, ভালোবাসা ও ন্যায্যতা দিয়ে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসম্পর্কের ভিত বিশ্বাস!
পরবর্তী নিবন্ধরাঙ্গুনিয়ায় নির্মাণাধীন ভবনের ছাদ থেকে পড়ে শ্রমিকের মৃত্যু