ধূমপানের ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে প্রতিবছর সারা বিশ্বে মারা যাচ্ছে ৮০ লক্ষাধিক মানুষ, তার মধ্যে ১২ লাখের মতো মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী পরোক্ষ ধূমপান। বিড়ি, সিগারেট, চুরুট, পাইপ, হিটেড টোব্যাকো, ই–সিগারেটের বা হুক্কার মাধ্যমে জ্বলন্ত ধোঁয়া নিশ্বাসের সাথে টেনে নেওয়া এবং তা বের করে দেওয়ার প্রক্রিয়াকেই সাধারণত ধূমপান বলে। এদের মূল উপাদান হচ্ছে তামাক।
এ লেখার পূর্বে বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে যেমন মাটি বাঁচান, প্লাস্টিক থেকে পরিবেশ বাঁচান, ইটভাটা থেকে আবাদি জমি বাঁচান, ভূমি দস্যুদের হাত থেকে পাহাড় বাঁচান, গরুর গোবর ও গৃহস্থালী আবর্জনা ব্যবহার করে জমির উর্বরতা শক্তি বাড়ান ইত্যাদি শিরোনামে বিভিন্ন পত্রিকায় লিখেছি। লক্ষ্য করে দেখলাম, আমাদের কাজকর্ম, প্রতিশ্রুতি ঐ দিবস উদযাপনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।
আমরা ইচ্ছায়–অনিচ্ছায় প্লাস্টিক বন্ধের দিবসে প্লাস্টিকের ব্যানার ও ফেস্টুনের ব্যবহার এবং ধূমপান দিবসের মঞ্চে বসেই দেদারসে ধূমপান করে থাকি। উল্লেখ্য যে, বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে তাল মিলিয়ে গত ৩১শে মে ২০২৪ আমাদের দেশেও বিশ্ব তামাক দিবস পালিত হয়েছে। এই দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘তামাক জাতীয় দ্রব্য থেকে শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা’।
আমরা অনেকেই নিজেরা ধূমপান করি না, কিন্তু ধূমপায়ীদের মাধ্যমে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে থাকি। ধূমপায়ী তার ধূমপানের মাধ্যমে নিজের, অন্যের ও পরিবেশের ক্ষতি করে থাকে। তাদের কাছ থেকে অনেকেই দূরত্ব বজায় রেখে চলতে চান, মনে মনে বিরক্ত হন এবং অপ্রকাশ্যে বকাঝকা করেন, কিন্তু ধুমপায়ীদের কোনো অনুশোচনা তাতে দেখা যায় না। তারা অনুধাবন করেন না যে, তাদের ধূমপানের কারণে তার পাশে থাকা সাধারণ মানুষ বা প্রতিবেশীরা কষ্ট পান। ধূমপান মানব স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর, তা জানা সত্ত্বেও একজন ব্যক্তি যেমন ধূমপান করার অধিকার রাখে তেমনই অধূমপায়ী সাধারণ মানুষ এবং প্রতিবেশীদেরও তার ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে।
ধূমপানের মাধ্যমে প্রতিবেশীরা যাতে কষ্ট না পায়, সেই দিকে খেয়াল রাখা দরকার।
এই প্রসঙ্গে আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (দ.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়’ (বুখারী হা/৪৭৮৭; মুসলিম হা/৬৮)।
ধূমপানের পাশাপাশি জর্দা এবং গুলও সেবনকারীর কোনো উপকারে আসে না বরং নিঃশ্বাস–প্রশ্বাসের মাধ্যমে দুর্গন্ধ ছড়ায়, তাতেও কিন্তু প্রতিবেশীরা বিরক্ত হন।
অনেকে ধূমপানকে বদ অভ্যাস হিসেবে আখ্যায়িত করেন কিন্তু আমাদের সমাজে সর্বোচ্চ পদে আসীন অনেক ব্যক্তিবর্গ ধূমপানে আসক্ত, কাজেই তাকে বদ অভ্যাস বলাও কঠিন। ধূমপায়ী স্বামীর এই অভ্যাস অধূমপায়ী স্ত্রীরা নীরবে যুগ যুগ ধরে সহ্য করে থাকেন। ধূমপান সম্পর্কে পৃথিবীর সব কোম্পানির সিগারেটের প্যাকেটের গায়েই লেখা থাকে ‘সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’। আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে যে, সমগ্র পৃথিবীতে অন্য কোনো রোগ–ব্যাধির তুলনায় ধূমপানে সবচেয়ে বেশি অপমৃত্যু ঘটছে। বিশ্বে ধূমপায়ীদের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম যা মোট জনসংখ্যার ৩৯ শতাংশ, তার মধ্যে নারী–পুরুষ উভয়েই রয়েছেন। ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউয়ের ২০২৩ সালের ডেটা অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৫ বছরের ওপরে মেয়েদের মধ্যে ধূমপায়ীর সংখ্যা ছিল ১৭.৭ শতাংশ, ২০১৯ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭ শতাংশের মতো। অর্থাৎ, গত চার বছরে বাংলাদেশে মেয়েদের মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
আমাদের সমাজে দুই ধরনের ধূমপান লক্ষ্য করা যায়, প্রকাশ্যে এবং গোপনে। সাধারণত বাবা, শিক্ষক, অফিসের কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতারা প্রকাশ্যে আর ছেলে–মেয়ে, ছাত্র–ছাত্রী এবং অধীনস্থ কর্মকর্তা–কর্মচারীরা গোপনে ধূমপান করে থাকেন।
বাংলাদেশে রাস্তাঘাট, কাঁচা বাজার, অফিস আদালত, আবাসিক ভবন, বাস, ট্রেন ও অন্যান্য যানবাহনে প্রকাশ্যে ধূমপান করে থাকেন, তাতে সহযাত্রী, পরিবার–পরিজন, বন্ধু–বান্ধব ও আশে–পাশের লোকজনের অনেক কষ্ট হয়। আবার কেউ প্রতিবাদ করে বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়েন এবং অনেক সময় অপমানিতও হন। সিগারেট না দেওয়ায় প্রতিবেশীকে ক্ষিপ্ত হয়ে লাঠি দিয়ে মাথায় আঘাত করে মেরে ফেলার অভিযোগ এসেছে প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে।
ধূমপানের ফলে মানুষের শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়াসহ ফুসফুস, মুত্রথলি, ঠোঁট, মুখ, জিহবা, কণ্ঠনালি, কিডনী ইত্যাদিতে ক্যান্সার হয় এবং ধূমপায়ী ব্যক্তি বারবার হৃদরোগে আক্রান্ত হন। প্রতিবেশীরাও তা থেকে রক্ষা পান না। তথ্যানুসারে, কর্মস্থল এবং পথেঘাটে ধূমপানকারীর সঙ্গে থাকলে অধূমপায়ীদের হৃদরোগের হারও ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ বেড়ে যায়। বিভিন্ন গবেষণায় বাংলাদেশে পরোক্ষ ধূমপানের প্রভাবে প্রতি বছর ২৫ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায় এবং বছরে প্রায় ৬১ হাজারের বেশি শিশু পরোক্ষ ধূমপান জনিত রোগে আক্রান্ত হয়। প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৪২.৭ ভাগ মানুষের মধ্যে পরোক্ষ ধূমপানের প্রভাব লক্ষ্য করেছেন।
ডব্লিউ এইচ ও রিপোর্ট অনুযায়ী ‘তামাক: আমাদের গ্রহের বিষ’ এবং জঞ্জালযুক্ত জিনিস। সিগারেটের ধোঁয়ায় প্রায় ৭০০০–এর অধিক রাসায়নিক রয়েছে তাদের মধ্যে ৭০টিরও বেশি ক্যান্সারের সাথে যুক্ত। এগুলো ফেলে দিলেও আমাদের পরিবেশে যুক্ত হয়। বছরে প্রায় ৪.৫ ট্রিলিয়ন সিগারেট ফিল্টার আমাদের মহাসাগর, নদী, শহরের ফুটপাত, পার্ক ও মাটিতে যুক্ত হয়ে পরিবেশকে দূষিত করছে। তাছাড়া সিগারেট, ধোঁয়াবিহীন তামাক এবং ই–সিগারেটের মতো পণ্যগুলি প্লাস্টিক দূষণ বাড়ায়। সিগারেটের ফিল্টারে মাইক্রোপ্লাস্টিক থাকে, যা বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক দূষণের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে।
তাছাড়া তামাকের আবাদকালে অন্যান্য শস্যের তুলনায় মাটি থেকে অধিক পরিমাণে পুষ্টি ও ক্ষতিকর ধাতুসমূহ গ্রহণ করে থাকে, যার ফলশ্রুতিতে তামাকে, সিগারেটে ব্যবহৃত কাগজে, ফিল্টার এবং সিগারেটের ধোঁয়ায় এলুমিনিয়াম, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, তামা, সিসা, পারদ এবং জিংক এর মত বিষাক্ত ধাতু সমূহ থাকে। সিগারেটের ধোঁয়া ফুসফুসের ক্যান্সারের মতো জটিল রোগের সৃষ্টির পাশাপাশি বাতাসেও প্রতিবছর হাজার হাজার টন কার্সিনোজেনিক কেমিক্যালস, গ্রিনহাউস গ্যাস ও অন্যান্য বিষাক্ত কণা ছেড়ে পরিবেশকে দূষিত করে।
ধূমপানের ক্ষতিকর দিকগুলো বিবেচনা করে, সাধারণ মানুষের স্বার্থে কর্মস্থল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বহুতল আবাসিক ভবন, রাস্তাঘাট ও গণপরিবহনে ধূমপান নিষিদ্ধ করার কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া দরকার।
উল্লেখ্য যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) গত ২১ শে মার্চ ২০১৬ সিন্ডিকেটের সভায় ঢাবিকে পুরোপুরি ধূমপানমুক্ত করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অনুষদ, বিভাগ এবং ইন্সস্টিটিউটসহ সব ভবনে ধূমপান নিষিদ্ধ করেছে। অন্যদিকে সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ও (শাবিপ্রবি) ২০১৫ সালে উন্মুক্ত স্থানে ধূমপান নিষিদ্ধ করেছে।
বাংলাদেশে ধুমপান বন্ধে ২০০৫ সালে প্রণিত আইন অনুযায়ী, প্রকাশ্যে ধূমপানের জরিমানা ধরা হয়েছিল ৫০টাকা। কিন্তু পরে ২০১৩ সালে ধুমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইনের সংশোধনী এনে জনসমাগমস্থলে ধুমপানের শাস্তির অর্থ ৫০ থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করা হয়, কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলনের কোনো উদাহরণ নেই। নিয়ন্ত্রণ আইনটি কার্যকর করা অতীব জরুরি। তাছাড়া, তামাক চাষকে সর্বপর্যায়ে নিরুৎসাহিত করা এবং তামাকজাত দ্রব্যের উপর অধিক মাত্রায় করারোপ করার মাধ্যমে তার ব্যবহার কমানো সম্ভব হতে পারে। প্রয়োজনে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর মতো বিভিন্ন স্থানে ধূমপান জোন তৈরির মাধ্যমে অধূমপায়ীদেরকে তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া থেকে রক্ষা করা যেতে পারে।
অনেক ক্ষেত্রে ধূমপান তরুণ প্রজন্মকে মাদক সেবনের দিকে দাবিত করে এবং তার প্রভাব পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের উপর পড়ে।
এই তরুণ প্রজন্মই আমাদের ভবিষ্যৎ, তাদেরকে ধূমপানের নেশা থেকে বিরত রাখতে দেশের সব মহলের সমন্বিত প্রয়াস থাকা দরকার। আশা করি, সকলের প্রচেষ্টায় আমরা একটা ধূমপানমুক্ত সমাজ গড়ে তুলতে পারবো।
লেখক: প্রফেসর, মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।