‘আপনি জমির মালিক?’ প্রশ্ন শুনেই অসংলগ্ন কথাবার্তা বলতে থাকেন। এতে সন্দেহ হলে তাৎক্ষণিক বন্ধ করে দেওয়া হয় জমি রেজিস্ট্রির কার্যক্রম। আটক করা হয় জমিদাতা ও গ্রহীতাকে। রেজিস্ট্রি অফিসের এক কর্মচারী বাদী হয়ে তাদের বিরুদ্ধে মামলাও করেন। আদালতে পাঠানো হলে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দেন। শেষে তাদের স্থান হয় জেল হাজতে।
যাদের নিয়ে এ আলোচনা তারা হলেন, নগরীর খুলশীর নাছিরাবাদ বেবী সুপার মার্কেটের পেছনের বাসিন্দা মো. আলী ও ভোলা জেলার বোরহান উদ্দিন থানার বাটামারা এলাকার বাসিন্দা মো. শহিদ।
জমি বিক্রি করার জন্য অবশ্যই জমির মালিক হতে হয়। কিন্তু মো. আলী জমির মালিক না হওয়া সত্ত্বেও গত ২৪ সেপ্টেম্বর মো. শহিদকে সাথে নিয়ে কোর্টহিলের পাহাড়তলী সাব রেজিস্ট্রি অফিসে জমি রেজিস্ট্রি করতে আসেন। মো. আলী আর মো. শহিদ কাগজপত্র নিয়ে সাব রেজিস্ট্রারের কাছে গেলে আলীকে উদ্দেশ্য করে সাব রেজিস্ট্রার জানতে চান, আপনি জমির মালিক কিনা? তখন মো. আলী ঘাবড়ে গিয়ে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলতে থাকেন। এতে সাব রেজিস্ট্রারের সন্দেহ হয়। পরে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করা হলে তারা জানায়, তারা পরস্পর যোগসাজশে পূর্বপরিকল্পিতভাবে জাল–জালিয়াতির মাধ্যমে অন্য ব্যক্তির বৈধ সম্পত্তি বিক্রয় করার ‘পাওয়ার অব অ্যাটর্নি’ সৃজন করেন এবং পরে তা বিক্রি করেন। এতে জমির প্রকৃত মালিক ও আসামিদের কাছ থেকে ক্রয়কারী দ্বিতীয় মালিক প্রতারিত হয়।
তারা আরো জানায়, অপরের জমিকে নিজের জমি দাবি করে মিথ্যা পরিচয়ে জমিদাতা সেজে জমি রেজিস্ট্রি করার উদ্দেশ্যে জমির জাল দলিল সৃজন করে খাঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পুলিশের কাছে দেওয়া স্টেটমেন্ট অনুযায়ী, এ চক্রের সাথে কতিপয় আইনজীবী, মুহুরী ও বিভিন্ন ধরনের দালাল সম্পৃক্ত রয়েছেন।
আদালত সূত্র জানায়, প্রতারক মো. আলী ও মো. শহিদের কাছ থেকে ১০০ টাকা মূল্যের ৪টি স্ট্যাম্প, ৯টি কার্টিজ পেপারে টাইপকৃত অপ্রত্যাহারযোগ্য পাওয়ার অব অ্যাটর্নি, হলফনামা, সোনালী ব্যাংকের ২৯০০ টাকার স্ট্যাম্প ফি রশিদ, বিএস খতিয়ানের মূলকপি, আব্দুর রশিদ মিয়া নামের একজনের ওয়ারেশি সনদের মূলকপি এবং মো. আলী ও মো. শহিদের পাশাপাশি মো. আনিছ নামের অপর এক ব্যক্তির মূল এনআইডি কার্ড উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া দাতা, গ্রহীতা শনাক্তকারী রেজিস্ট্রেশনের জন্য প্রয়োজনীয় ১৭ পাতা কাগজপত্রের ফটোকপিও উদ্ধার করা হয়।
আদালত সংশ্লিষ্টরা জানান, জাল–জালিয়াতি করে প্রতারণা কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না। রেজিস্ট্রি অফিস থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে প্রতারক চক্র সক্রিয় রয়েছে। এমনকি আদালতের সাথে প্রতারণা করতেও অপরাধবোধ কাজ করে না প্রতারক চক্রের। গত ১০ সেপ্টেম্বর পাবনায় জাস্টিন ট্রুডোর জন্মসনদ তৈরীর ঘটনায় নিলয় নামের এক তরুণকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। নিলয় টাকার বিনিময়ে ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র, পুলিশ ক্লিয়ারেন্সসহ বিভিন্ন সনদ তৈরি করে দিতেন এমনটা জানিয়েছে র্যাব।
দুদক চট্টগ্রাম সূত্র জানায়, আলোচিত ক্যাসিনোকাণ্ডে ২০১৯ সালের ২০ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার হওয়া জি কে শামীমের বিরুদ্ধে ২০২০ সালের ২২ নভেম্বর দুদক চট্টগ্রাম–১ একটি জালিয়াতির মামলা দায়ের করেন। শামীম গণপূর্তের আলোচিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জি কে বি অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। মামলায় তিনি ছাড়াও আরেক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দি বিল্ডার্স ইঞ্জিনিয়ার্স এসোসিয়েটস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল করিম চৌধুরীকেও আসামি করা হয়েছে। জাল ডকুমেন্ট উপস্থাপন করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৫ কোটি টাকার কাজ ভাগিয়ে নেওয়ার অভিযোগে এ মামলা করা হয়।
এদিকে জাল–জালিয়াতির মাধ্যমে সৃজনকৃত ‘ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা বিক্রয়ের চুক্তিনামা’ প্রতারণার মাধ্যমে খাঁটি হিসেবে দাখিল করার দায়ে মো. জামাল হোসেন নামের খুলশীর এক বাসিন্দার বিরুদ্ধে গত বছরের ২২ জানুয়ারি বিচারক বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। তৎকালীন ১ম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জুয়েল দেবের আদালতে মামলাটি করেন ৫ম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সাদ্দাম হোসেন। সেই মামলার এজাহারে বলা হয়, আসামি জামাল হোসেন বায়েজিদ থানার একটি মামলায় জব্দকৃত ব্যাটারি চালিত অটোরিকশার মালিক দাবি করে জিম্মার আবেদন করেন এবং জিম্মার আবেদনের সাথে সংযুক্তি হিসেবে একটি নন জুডিসিয়াল স্ট্যাম্প দাখিল করেন। ১০০ টাকার খঠ ০৩৯৫৮৬৫ নম্বর ক্রমিকের স্ট্যাম্পটিতে সদর মোকাম কালেক্টরি, চট্টগ্রামের সিরিয়াল নম্বর ছিল না। এ জন্য আদালত উক্ত নন জুডিসিয়াল স্ট্যাম্প পর্যালোচনা করেন। এতে দেখতে পান, স্ট্যাম্পে ২য় পক্ষের স্বাক্ষরটি কাটাছেঁড়া ও সিরিয়াল নম্বর উল্লেখ নাই। ফলে দাখিলকৃত স্ট্যাম্পটির ইস্যুর তারিখসহ সঠিকতা যাচাই করে প্রতিবেদন দাখিল করতে ট্রেজারি, চট্টগ্রামকে নির্দেশ প্রদান করেন বিচারক। পরবর্তীতে ট্রেজারি শাখা থেকে দাখিলকৃত প্রতিবদনে জানানো হয়, দাখিলকৃত ১০০ টাকা মূল্যমানের নন জুডিসিয়াল খঠ ০৩৯৫৮৬৫ নম্বর সিরিজের স্ট্যাম্পটি ২০২২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ট্রেজারি থেকে সরবরাহ করা হয়।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, ট্রেজারি শাখা থেকে দাখিলকৃত প্রতিবেদনে স্পষ্ট হয়েছে যে, আসামি মো. জামাল হোসেন অজ্ঞাতনামা অন্য লোকসহ পরস্পর যোগসাজশে খঠ ০৩৯৫৮৬৫ নম্বর সিরিজের স্ট্যাম্পটি ক্রয় করে জাল–জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে সেখানে গত বছরের ১৪ জানুয়ারি তারিখ উল্লেখ করে আদালতে দাখিল করেন।
আদালতসূত্র জানায়, জালিয়াত চক্রের নির্ধারিত কোনো পন্থা বা স্থান নেই। যেকোনোরকম প্রতারণা, জাল–জালিয়াতি যে কোনো স্থানে তারা কার্যকর করার চেষ্টা করে।
নানা পর্যায়ে জাল–জালিয়াতি করে প্রতারণার এসব ঘটনায় দোষীদের ছাড় দেওয়া যাবে না উল্লেখ করে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মো. নাজিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, বিচার নিশ্চিত করতে পারলে জাল–জালিয়াতির মাধ্যমে সৃষ্ট প্রতারণা হ্রাস পাবে। সবার আগে আমাদেরকে সচেতন হতে হবে।