সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের পরিচিত মুখ ছিলেন আশীষ কুমার বড়ুয়া। ২৮ সেপ্টেম্বর সাঁঝ গমনের কিছু সময়ের পর ইহজীবনের অবসান ঘটে। এই ক’দিন হাসপাতালে শোয়া অবস্থায়ও মানুষ, মানবতা এবং জীবনের নানা অনুসঙ্গ নিয়ে কত ভাবনা, লেখালেখি, গল্প, আড্ডা বসিয়েছিল। সেই হাসিখুশি প্রাণচাঞ্চল্যে সদা উচ্ছ্বসিত মানুষটির হঠাৎ জীবনাবসান হবে বন্ধু–স্বজন কারো কল্পনাতেও ছিল না। না থাকারই কথা; কারণ যিনি এত মনোবল, এত প্রেরণার অফুরন্ত শক্তি ধারণ করে চলেন, তিনি যে এভাবে ফাঁকি দিয়ে অচিনপুরের বাসিন্ধা হবেন কেউ গুণাক্ষরেও সেদিন বুঝতে পারেনি। ২০২০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ছিল তাঁর মানব জীবনের শেষ দিন। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর মুখে পতিত হন। সেদিন অবিশ্বাস্য মৃত্যু সংবাদে চট্টগ্রামের বাতাস ভারী হয়ে ওঠেছিল। আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক পরিবর্তশীল জীবনধারার–মুক্তবুদ্ধি চর্চার এক আলোকিত জীবনের নাম আশীষ কুমার বড়ুয়া। জীবনের পরতে পরতে তিনি লেখায়, কথায়, পোশাক–পরিচ্ছদে প্রতিনিয়ত পরিবর্তনকে খুঁজে ফিরতেন। পুঁজিবাদ, ফ্যাসিবাদ বিরুদ্ধ ছিল তাঁর সংগ্রাম। অবিরত সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চায় শেকড়ের সন্ধানে পৌঁছাতে চেষ্টা করতেন। ছিলেন একজন অসাধারণ ভ্রমণপ্রিয় মানুষ। দেশে–বিদেশে ছুটে বেড়াতেন অনবরত। সাহিত্যসংস্কৃতি ও সাংগঠনিক কাজ করতে গিয়ে তাঁর কাছে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। মুক্তবুদ্ধি চর্চার এক অনবদ্ধ ঋদ্ধজন ছিলেন তিনি। অবলীলায় বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের সাথে সহজে মেশার শক্তি ছিল তাঁর মধ্যে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী থেকে উঁচু তলার মানুষের সাথে ছিল নিবিড় হৃদ্যতা। তাঁর কাছে বয়স কোনো বিষয় ছিল না। ছোট বড় সব বয়সীদের সাথে সহজে মিশে যেতেন। আড্ডা, গল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির যেকোনো আসরের তিনি ছিলেন মধ্যমণি। কথায় কথায় হাসাতেন, আনন্দ দিতে পারতেন। মানুষকে বোঝানোর ব্যাপারে এত বাকশক্তি ছিল যে, রীতিমতো বিস্মিত হতাম! তাঁর সাহচর্য যত লাভ করেছি ততই ধন্য হয়েছি, মুগ্ধ হয়েছি, প্রাণিত হয়েছি, অন্ধকারাচ্ছন্ন মনোজগতে আলোর শিখা প্রজ্বলিত করতে চেষ্টা করেছি। তিনি ছিলেন একজন বাস্তববাদী, সহজ সরল সংস্কৃতি গুণসম্পন্ন আদর্শবান পুরুষ। আনন্দময় জীবন কাটানো ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তিনি এত বছরেও চিন্তা চৈতন্যের প্রতিটি ক্ষণে বাসা বেঁধে আছেন আমাদের সামগ্রিক জীবনবোধে। কারণ আদর্শবান, কীর্তিমান মানুষের কখনো মৃত্যু হয় না।
আশীষ কুমার বড়ুয়া দীর্ঘ ৮ বছরেরও বেশি সময় মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত অনোমা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী’র মহাসচিব ও একই সাথে সাহিত্য পত্রিকা অনোমা’র সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এছাড়া তিনি আরো অসংখ্য সমিয়িকী, মুখপত্র সম্পাদনা করেন। চট্টগ্রাম একাডেমি ও দেশের বহু সামাজিক–সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন অনন্য এক সাংগঠনিক প্রতিভা ও বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী। জীবনকে উপভোগ করেছেন আনন্দ মুখরতায়। হতাশা তার জীবনের কোনো অংশে চিড় ধরাতে পারেনি। তিনি কাউকে হতাশায় পর্যবসিত হতে দেখলে আনন্দ দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে স্বাভাবিকতায় ফিরিয়ে নিয়ে আসতেন। উদীচী চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সকল কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত ছিলেন। সংগঠনের সকল প্রতিবাদী কর্মসূচিতে
অংশ নিতেন। শিল্পীদের সাথে গণ সংগীতে গলা মেলাতেন। শ্লোগানে শ্লোগানে রাজপথ কাঁপাতেন। জাতীয় দিবসে প্রভাত ফেরী করে আমরা যখন শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে যেতাম তখন তাঁর মধ্যে যে কী পরিমাণ বাঙালি জাতীয়তাবাদ চেতনা ধারণ করতো, তা বলাবাহুল্য। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ ‘ছালাম ছালাম হাজার ছালাম’ প্রভৃতি দেশ জাগানিয়া গানের সাথে গলা ফাটিয়ে কণ্ঠ মেলাতেন। গান গাওয়ার জন্য সবাইকে উৎসাহ যোগাতেন। শহীদ মিনারের বেদিতে ফুলেল শ্রদ্ধা জানানোর পর জম্পেস খাওয়া–দাওয়ার আয়োজন থাকতো। তারপর রাস্তায় ফটোসেশনে মিলিত হতেন চেনা–অচেনা কতো শত মানুষের সাথে। ফেরিওয়ালাদের ফসরা ধরে ছবি উঠাও বাদ যেতো না। এভাবেই প্রিয় মানুষটির সাথে দিন কাটাতাম বয়সের তারতম্য ভুলে।
আশীষ কুমার বড়ুয়া’র জন্ম চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি উপজেলাধীন জাঁহানপুর (কোঠের পাড়) গ্রামের এক ঐতিহ্যবাহী সভ্রান্ত বৌদ্ধ পরিবারে। পিতার নাম ডা. চিত্ত রঞ্জন বড়ুয়া, মাতার নাম প্রতিমা বড়ুয়া। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে আশীষ কুমার বড়ুয়া ছিলেন তৃতীয়। ছোটবেলা থেকে বেশ দুরন্তপনা ছিলেন। গ্রামের সবকিছুতে ছিল তাঁর সরব পদচারণা। গ্রামের মাঠে ঘাটে, খালে বিলে সুনীল সুনির্মল আলো ছায়ায় মিলেমিশে তিনি বেড়ে উঠেছেন। গ্রামকে স্বপ্নের মতো ভালোবাসতেন। গ্রামের কৃষকের কথা ভাবতেন, শ্রমজীবীর কথা ভাবতেন। ছোটবেলা থেকে লেখাপড়ায় মেধাবী ছিলেন। চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজ থেকে ১৯৭৯ সালে কৃতিত্বের সাথে এইচএসসি পাস করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। অনার্স মাস্টার্স শেষ করে ১৯৮৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রির সনদ লাভ করেন। তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫ তম ব্যাচের কীর্তিমান ছাত্র। দীর্ঘ ৩২ বছর মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় বীমা কোম্পানী প্রগতি ইন্সুর্যান্স–এ চাকরিরত ছিলেন। সর্বশেষ তিনি ঐ কোম্পানীর সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্টের গুরত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সারাদেশে কোম্পানির কয়েক হাজার কর্মকর্তা–কর্মচারীর মধ্যে তিনি ছিলেন সকলের প্রিয়ভাজন ও মধ্যমণি। কোম্পানির এমন কোনো মানুষ নেই তাঁকে ভালোবাসতেন না। কোম্পানীর পিকনিক আর বড় কোনো আয়োজনে আশীষ কুমার বড়ুয়া’র উপস্থিতি ছিল লক্ষ্যণীয়। তিনি এতবেশি বিশ্বস্ত ছিলেন যে, তাঁর ওপর অর্পিত হতো আয়োজনের সমস্ত দায়িত্ব।
তিনি ছিলেন খুব বেশি বন্ধু প্রিয়। যখনি সুযোগ পেতেন তিনি কোথাও না কোথাও বন্ধুদের নিয়ে পাখির মতো ঘুরে বেড়াতেন। ‘ভ্রমণ মানুষকে প্রশান্তি দেয়’ একটি লেখায় লিখেন– ভ্রমণকে অনেকেই ঘুরোঘুরি বলে। যারা প্রায়ই দিকবিদিক ঘুরে বেড়ায় তাদেরকে বলে পর্যটক। অনেকের কাছে ঘুরোঘুরিটা নেশা। অনেকের কাছে সখ। কেউ টাকা জমিয়ে গাড়ি, বাড়ি, দামি দামি আসবাবপত্র, ঘড়ি, মোবাইল কেনে। আবার অনেকে টাকা জমিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে দেশ–বিদেশ ভ্রমণ করতে। বরাবরই তিনি প্রতিটি লেখার মধ্যে একটি ম্যাসেজ দিয়ে যেতেন। তাঁর লেখা পড়ে সত্যিই অভিভূত হতো যে কেউ। তিনি একটি প্রবন্ধে লিখেন– ‘মানুষের জীবন অনেকটা গল্পের বইয়ের মতো। প্রতিটি বইয়ের পাতায় থাকে আনন্দ–খুশি, দুঃখ–বেদনা, প্রাপ্তি–অপ্রাপ্তি, আশা–নিরাশা। আছে বেঁচে থাকার সংগ্রাম আর ব্যর্থতার গল্প। বড় হতে গেলে জীবনের কোন কাজকে খাটো করে দেখতে নেই। একটা কাজ নতুন করে জানা মানে অন্য একজন থেকে একধাপ এগিয়ে যাওয়া।’ আরেকটি লেখায় তিনি উল্লেখ করেন– ‘ধর্ম কখনো মানুষ কিংবা রাষ্ট্রের চেয়ে বড় হতে পারবে না। এমনকি সমানও হতে পারবে না। পৃথিবীতে আগে মানুষ এসেছে, পরে এসেছে ধর্ম। মানুষকে নিয়েই ধর্মের প্রবর্তন। ধর্ম হচ্ছে সংস্কৃতির একটি অংশ। জাতিগোষ্ঠীকে প্রগতির ধারায় এগিয়ে নিতে হলে প্রজন্মকে ধর্ম নয় অবশ্যই সংস্কৃতি মনস্ক হয়ে এগুতে হবে।
আর না হলে সে জাতি উন্নত জাতি হিসেবে মর্যাদা হারাবে।’ তাঁর লেখায় ছিল সমাজ বদলের অফুরন্ত শক্তির উৎস। ভরাট কণ্ঠের মন ভোলানো সঞ্চালনা। সৃজনশীল–মননশীল জ্ঞানগর্ব বক্তৃতা। সংস্কৃতির অফুরন্ত প্রাণভ্রোমরা এই গুণী বিদগ্ধজন ছিলেন আমার মতো আরো অনেকের আনন্দময় জীবন গড়ে তোলার অক্সিজেন। তাঁর চলে যাওয়ার আজ পূর্ণ হলো চার বছর। সংস্কৃতিজনের ৪র্থ প্রয়াণ দিবসে রইলো অনন্ত শ্রদ্ধা।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও সংবাদকর্মী