নাহিদ ইসলাম, দুই বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। কেন বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলন কখনো লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি– এ নিয়ে তার একটি গবেষণা প্রবন্ধ রয়েছে। এর উপসংহার তিনি ভুলে গেলেও তা বড় কোনো বিষয় নয়, ২৬ বছর বয়সী এ তরুণ যে ইতিহাসটাই পাল্টে দিলেন। গত জুলাই–আগস্টে ছাত্র আন্দোলন দেশব্যাপী জনতার আন্দোলনে রূপ নিলে ক্ষমতাচ্যুত হন বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যাকে এক সময় পৃথিবীর অন্যতম ক্ষমতাধর নারী হিসেবে বিবেচনা করা হতো। ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম পরিচিত মুখ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র নাহিদ ইসলাম। নাহিদ ইসলামের সাক্ষাৎকার নিয়েছে মার্কিন সাময়িকী টাইম। শেখ হাসিনার পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। চলতি সেপ্টেম্বরে এক রোববার সন্ধ্যায় তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে নিজ দপ্তরে টাইমকে সাক্ষাৎকার দেন নাহিদ। কাঠের প্যানেলে সাজানো কক্ষে অভিজাত এক কালো চামড়ার চেয়ারে বসে শান্ত কণ্ঠে টাইমকে তিনি বললেন, হাসিনা রক্তচোষা ও সাইকোপ্যাথ (মানসিকভাবে অসুস্থ)। খবর বাংলানিউজের।
গত জুন মাসে মুষ্টিমেয় কয়েকজন ছাত্রের সঙ্গে নাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে যান। সেখানে প্ল্যাকার্ড হাতে ছাত্র রাস্তায় নামার আহ্বান জানান। এর আগেই হাইকোর্ট বিতর্কিত কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহাল করেন। এর মাধ্যমে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদান রাখা মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থায় বিশেষ সুবিধা রাখা হয়। বিপরীতে নাহিদ ও তার সহযোদ্ধারা সবার জন্য ন্যায্য সুযোগ দাবি করেন। কোটা ব্যবস্থা নিয়ে প্রথম দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে ২০১৮ সালে। তখন সরকার শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে গেলে বিক্ষোভেরও ইতি ঘটে। এ বছরও সরকার পিছিয়ে গেলে কোটা ব্যবস্থা নিয়ে বিক্ষোভ–আন্দোলন শেষ হয়ে যেতে পারত, বলেন নাহিদ ইসলাম। তবে নিরাপত্তা বাহিনী কোটা আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালাতে শুরু করে। ১৬ জুলাই আবু সাঈদ নামে এক ছাত্রনেতা নিহত হন। পুলিশের সামনে দুই হাত খুলে বুক সামনে দিয়ে দাঁড়ালে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি মারা মান।
নাহিদ বলেন, সেই হত্যাকাণ্ড আন্দোলনের জন্য গেম–চেঞ্জিং মুহূর্তে পরিণত হয়। ছাত্র আন্দোলন দ্রুত দেশজুড়ে জনসংখ্যার একটি বড় অংশকে আচ্ছন্ন করে। এ আন্দোলন দেশের মানুষকে দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার, ক্রমবর্ধমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং ক্রমবর্ধমান স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে তাদের ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ প্রকাশ করার একটি সুযোগ করে দেয়।
দ্রুতই আন্দোলনকারীদের দৃষ্টি পড়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর। ৩ আগস্ট ছাত্ররা তার পদত্যাগের এক দফা দাবি তোলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে সেই দাবির ঘোষণা দেন নাহিদ ইসলাম। ৫ আগস্ট লাখো ছাত্র–জনতা ঢাকায় শেখ হাসিনার বাসভবনের দিকে যাত্রা শুরু করলে তিনি হেলিকপ্টারে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পালিয়ে যান। তিনি এখনো সেখানে নির্বাসিত। চেয়ারে বসে সামনে–পেছনে দুলতে দুলতে নাহিদ ইসলাম বলেন, কেউ ভাবেনি তার (শেখ হাসিনার) উৎখাত হবে।
সামরিক বাহিনীর সমর্থন নিয়ে, শিক্ষার্থীরা শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ৮৪ বছর বয়সী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ১৭ কোটি মানুষের দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান করার প্রস্তাব দেয়। ক্ষুদ্রঋণ ধারণার জন্য খ্যাতি পাওয়া এ অর্থনীতিবিদ হাসিনা সরকারের আনা আইনি অভিযোগের কারণে হেনস্থার শিকার ছিলেন। দায়িত্ব নেওয়ার সময় থেকে তিনি অভিযোগ থেকে খালাস পান।
সরকারের বিরুদ্ধে যারা দাঁড়িয়েছিলেন, সবসময়ই তাদের মধ্যে ছিলেন সমাজবিজ্ঞানে এ স্নাতক সম্পন্নকারী তরুণ। বাবা পেশায় শিক্ষক, ঢাকায় জন্ম নেওয়া নাহিদ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রথম সপ্তাহেই সুন্দরবনে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে অংশ নেন। ২০১৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচনে লড়েন। পরে তিনি সহপাঠীদের নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি– নামে একটি ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।
তবে নাহিদ এতটা পরিচিতি পান চলতি বছরের জুলাইয়ে গোয়েন্দা বাহিনীর হাতে অপহরণ ও নির্যাতনের শিকার হয়ে। আগের সরকারের গোয়েন্দা বাহিনীর বিরুদ্ধে সরকারের সমালোচকদের জোরপূর্বক গুম করার অভিযোগ রয়েছে। গ্রেপ্তার এড়াতে এক বন্ধুর বাসায় লুকিয়ে ছিলেন নাহিদ। এক রাতে সাদা পোশাকে প্রায় ৩০ গোয়েন্দা কর্মকর্তা সেখানে উপস্থিত হন। নাহিদ বলেন, তাদের মাথায় কালো কাপড় পরিয়ে দেওয়া হয়। পরে তাদের বলা হয়, পৃথিবী আর কোনো দিন তোমাদের দেখতে পাবে না।
নাহিদের বিশ্বাস, গোপন কারাগারে তাকে রাখা হয়েছিল। তাকে পেটানো হয়। তার মনে হচ্ছিল, লোহার রড দিয়ে পেটানো হয়েছিল। হাতের বাহু ও পায়ে পেটানোর দাগও ছিল। ব্যথা, যন্ত্রণাদায়ক শব্দ এবং তাক করা উজ্জ্বল আলোর তীব্রতায় তার মাথা ঘোরাচ্ছিল পাশাপাশি তিনি মাঝে মাঝেই অচেতন হয়ে যাচ্ছিলেন।
নাহিদ বলেন, কর্মকর্তারা তার কাছে জানতে চাচ্ছিলেন, মাস্টারমাইন্ড কে? টাকা কোত্থেকে আসছে? তুলে নেওয়ার একদিন পর তিনি নিজেকে একটি ব্রিজের পাশে আবিষ্কার করেন। তার শরীরে আঘাতের চিহ্নের ছবি স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে এবং জনগণের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দেয়। গোয়েন্দা বাহিনী কেবল পরিচিত মুখদের, বিশেষ করে আমাদের আন্দোলনের নেতার খোঁজ করছিল। তবে আমরা কেবল একজন ছিলাম না। এটিই ছিল আমাদের প্রধান শক্তি, বলেন নাহিদ ইসলাম।
হাসিনা সরকারের পতনের পর ক্ষমতার শূন্যতা পূরণ জরুরি ছিল, বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. সামিনা লুৎফা। ছাত্রদের অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষণার দিন নাহিদ ইসলামের সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল। এ অধ্যাপক বলেন, তার বয়স কম, দায়িত্ব বিশাল।
নাহিদ ইসলাম বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ হলো, দুর্নীতির মূলোৎপাটন করে নির্বাচনের আগে দেশকে গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে আনা। আমরা এখানে আছি খুব অল্প সময়ের জন্য। দুর্নীতি ও সহিংসতা– লোকজন আর চায় না, বলেন তিনি। আমাদের নতুন প্রজন্মের পালস বুঝতে হবে। আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।