মানব সভ্যতা উত্তরণের পথে প্রথম সিঁড়ি হচ্ছে পরিবার। সাধারণ অর্থে পরিবার বলতে এমন এক সামাজিক প্রতিষ্ঠান বোঝায় যেখানে সমাজ স্বীকৃত রীতিতে নারীপুরুষের বিবাহের ভিত্তিতে একত্রে বসবাসের অধিকার প্রাপ্ত হয়ে স্বামী–স্ত্রী সন্তান জন্মদান ও লালনপালনের দায়িত্ব পেয়ে থাকে। শব্দগত অর্থে ইংরেজি ফ্যামিলি শব্দটার উৎপত্তি ল্যাটিন Famulus শব্দ থেকে। পরিবারের মুখ্য কাজ হলো সন্তান প্রজননের নীতিগত কাঠামোর ভিত্তিতে সন্তান লালনপালন, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের প্রথাগত নিশ্চয়তা প্রদান করা। পরিবারে শুধুমাত্র সন্তান জন্মদান করা নয়, তাদের লালনপালন, শিক্ষাদান ও দেখভাল করার নিয়মসিদ্ধ রীতিটি পরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্যদের ওপর বর্তায়। নানান প্রয়োজন পূরণের তাগিদে আদিম কাল থেকে মানুষ পরিবার গঠন করে আসছে। আধুনিক যুগে সভ্য মানুষদের পরিবারের বাইরে থাকার কথা ভাবা যায় না। তেমনি পরিবার ব্যতীত সমাজের অস্তিত্বের কথা কল্পনা করা যায় না। পরিবার এমন একটি প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান যার থেকে অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানের উদ্ভব ঘটেছে । তবে আবির্ভাব কাল থেকে পরিবারের আকৃতি ও বৈশিষ্ট্য এক ছিলনা। নানা পরিবর্তন ও বিবর্তনের মাধ্যমে এটি ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রবহমান। মার্কিন সমাজ বিজ্ঞানী ম্যাকাইভারের ভাষায় “পরিবর্তনশীল গোষ্ঠী রূপেই পরিবারের অবস্থান“।
বংশ পরম্পরায় পারিবারিক সুসম্পর্ক, সমৃদ্ধি ও অগ্রগতিতে পরিবারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। শিশু বড় হওয়ার সাথে সাথে শিক্ষা, সৌজন্যবোধ, ভদ্রতা, বিনয় সম্পর্কিত নানান ধারণা পরিবারের কাছ থেকে শিখে থাকে। তাই পরিবারকে সন্তানের শিক্ষাক্ষেত্রও বলা যায়। সমাজের অস্তিত্ব সৃজন ও পারিবারিক গঠন প্রক্রিয়ায় পরিবার বহুবিধ হয়ে থাকে। যেমন –
১) পিতৃশাসিত ও মাতৃশাসিত পরিবার
২) একগামী ও বহুগামী পরিবার
৩) পিতৃ বংশানুক্রমিক ও মাতৃ বংশানুক্রমিক
৪) একক, যৌথ পরিবার ও বর্ধিত পরিবার।
পরিবারের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো –আকার ও আয়তনগত অবস্থান। বংশপরম্পরায় পরিবারগুলো তাদের অস্তিত্বের ধারা প্রবহমান রাখে। তাছাড়া পরিবার আরো বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে। যেমন,
১। একপত্নী পরিবার ২। বহু পত্নী পরিবার
কর্তৃত্বের ভিত্তিতে পরিবার ২ প্রকার –
১) পিতৃতান্ত্রিক পরিবার
২) মাতৃতান্ত্রিক পরিবার
আকারের ভিত্তিতে পরিবার ৩ প্রকার –
ক) একক পরিবার।
খ) যৌথ পরিবার।
গ) বর্ধিত পরিবার।
পরিবারের দায়িত্ব যদি পিতা বা স্বামীর হাতে ন্যস্ত থাকলে তাহলে সেই পরিবার হচ্ছে পিতৃতান্ত্রিক পরিবার। আর যদি পুরুষের পরিবর্তে স্ত্রীর হাতে ন্যস্ত থাকে তাহলে সেই পরিবার হলো মাতৃতান্ত্রিক পরিবার।
একগামী: একজন পুরুষ ও একজন নারীর বৈবাহিক সম্পর্কের ভিত্তিতে যে পরিবার গড়ে উঠে তাকে একগামী পরিবার বলে।
বহুগামী: এক পতি এবং একাধিক পত্নী অথবা এক পত্নী এবং একাধিক পতিকে নিয়ে গঠিত যে পরিবার তাকে বহুগামী পরিবার বলে।
বহুপত্নীক পরিবার: একজন পুরুষ যখন একাধিক পত্নীর সাথে দাম্পত্য জীবন যাপন করে তখন সেই পরিবারকে বহুপত্নীক পরিবার বলে। ধর্মীয় সম্মতি, আর্থিক প্রাচুর্য, কুল রক্ষা ইত্যাদি কারণে বহুপত্নীক পরিবারের সৃষ্টি হয়। আরবদেশ এবং আফ্রিকার অনেক দেশে ধর্মীয় সম্মতি অনুসারে একব্যক্তি ৪ জন স্ত্রীর সাথে দাম্পত্য জীবন যাপন করতে পারে।
মাতৃবংশানুক্রমিক ও পিতৃবংশানুক্রমিক পরিবার: মাতৃকুলের পরিচয় দিয়ে যে পরিবারে সন্তানের পরিচয় নির্ধারিত হয় সেই পরিবারকে মাতৃ বংশানুক্রমিক পরিবার বলা হয়। অপরদিকে যে পরিবারে পিতৃকুলের পরিচয়ের ভিত্তিতে সন্তানের পরিচয় নির্ধারিত হয় সেই পরিবারকে পিতৃ বংশানুক্রমিক পরিবার বলে।
একক, যৌথ ও বর্ধিত পরিবার: পরিবারের আরো তিনটি বিভাগ হচ্ছে একক, যৌথ ও বর্ধিত পরিবার। যে পরিবারে স্বামী–স্ত্রী, এক বা একাধিক সন্তান নিয়ে গঠিত হয়, সেই পরিবারকে একক পরিবার বলে। রক্তের সম্পর্কের যোগসূত্রের ভিত্তিতে কয়েকটি একক পরিবারের সমষ্টিতে সৃষ্টি হয় যৌথ পরিবার। যে পরিবারে দাদা দাদী, তাদের ভাই, ভ্রাতৃবধূ, তাদের সন্তানরা, সন্তান বধূ এবং নাতি–নাতনি একই সাথে বাস করে সেটিকে বর্ধিত পরিবার বলে।
পরিবারকে বাদ দিয়ে সমাজ এবং সমাজকে বাদ দিয়ে পরিবারের কথা ভাবা যায় না। পরিবার শৈশব থেকে মানুষকে সামাজিক পরিমন্ডলের সাথে পরিচিত করে এবং বৃহত্তর সামাজিক ক্ষেত্রে প্রবেশ করার জন্য উপযুক্ত করে তোলে। একসময় বাঙালির একান্নবর্তী পরিবার বা প্রসারিত পরিবার অতীত ঐতিহ্যের ধারায় ছিল স্বর্ণোজ্জ্বল। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে বর্তমান সমাজে একান্নবর্তী পরিবারের অস্তিত্ব শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। পরিবার ভেঙে ক্রমান্বয়ে ছোট পরিবারে পরিণত হয়েছে। বিশ্বায়নের সঙ্গে সঙ্গে যৌথ পরিবার ভেঙে গঠিত হচ্ছে একক পরিবার। সৃষ্টি হচ্ছে ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসার বন্ধনহীনতা। নারীদের প্রতি সম্মান রেখে বলছি, কিছু কিছু পরিবারে এ ধরনের ভাঙনটি আসে শ্বশুর –শাশুড়ির প্রতি পুত্রবধূদের অশ্রদ্ধা ও অবহেলাজনিত কারণে। পুত্রবধূ শাশুড়িকে মায়ের দৃষ্টিতে দেখেন না কিংবা শাশুড়ি ছেলের বউকে মেয়ের দৃষ্টিতে দেখন না। যার ফলশ্রুতিতে এখনকার একক পরিবার। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় সন্তানের স্ত্রী এবং তার পিতৃপক্ষের হস্তক্ষেপ ও প্ররোচনায় সন্তান জন্মদাতা পিতা এবং জন্মদাত্রী মাতার সাথে নিষ্ঠুর অমানবিক আচরণ করে। স্বামীকে শ্বশুর –শাশুড়ির কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করার ব্যাপারে এসব পুত্রবধূরা নাটক –সিনেমার খল চরিত্রের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে, অনেক সময় মিথ্যা বানোয়াট কাহিনি সৃষ্টি করে পুত্র সন্তানের সাথে জন্মদাতা পিতা এবং জন্মদাত্রী মায়ের রক্তের সম্পর্ককে মুহূর্তেই নষ্ট করে দেয়। এসব কৃতঘ্ন সন্তানেরাও পিতৃ মাতৃ ঋণের কথা মুহূর্তেই ভুলে গিয়ে মা–বাবাকে মনোকষ্ট দেয়, অপমানিত করে, অবহেলা করে।
ঢাকার বনানীস্থ এক বনেদি পরিবারের তিন পুত্র সন্তানদের পিতামাতা অর্থ সহযোগিতা দিয়ে মানুষ করার লক্ষে সন্তানদের আমেরিকায় পাঠিয়েছিল। তিন সন্তান এখন বিবাহিত জীবনে। বড় ছেলের স্ত্রী আমেরিকান, অন্য দু‘সন্তানের স্ত্রী বাংলাদেশি। রক্তের টানে পুত্র সন্তান ও নাতি–নাতনীদের দেখার জন্য বৃদ্ধ মা–বাবা বর্তমানে আমেরিকায়। বড় ছেলের বউ আমেরিকান হলেও শ্বশুর –শাশুড়ির যথেষ্ট সেবাযত্ন করে। বড় ছেলেকে চাকুরির সুবাদে বিদেশি বৌকে নিয়ে ঢাকায় আসতে হয়েছে। উপায়ন্তর না দেখে বৃদ্ধ মা–বাবা মেজ ছেলে ও ছোট ছেলের সাথে থেকে নাতি–নাতনীদের দেখাশোনা করে যাচ্ছে। বাঙালি ঘরের দুই পুত্রবধূ শ্বশুর –শাশুড়ির উপস্থিতি সহ্য করতে পারছেনা। পল্লীকবি জসীমউদ্দিন ‘এর ভাষায় বলা যায় ” হাতেতে যদিও না মারিত তারে শত যে মারিত ঠোঁটে“। এক দুপুরে বৃদ্ধা দাদী নাকি অন্য একটি কক্ষে নাতি–নাতনীদের নিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। এরমধ্যে কোনো এক নাতি বা নাতনি নাকি ঘুমন্ত নবাবজাদী পুত্রবধূর কক্ষে ঢুকে যায়। শাশুড়ি তাকে বের করে আনতে সেই কক্ষে গিয়ে ঢুকতেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠা পুত্রবধু প্রাইভেসি নষ্টের অভিযোগ তুলে শাশুড়িকে যাচ্ছেতাই গালমন্দ করতে থাকে। বেজন্মা পুত্রবধূ এটুকু তে ক্ষান্ত হয়নি। মেজ ছেলে অফিস থেকে আসার পর ছেলেকে জন্মদাত্রী মায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ করাতে কৃতঘ্ন সন্তান মাকে তার প্রাণপ্রিয় সহধর্মিণীর কাছে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করেছিলো। ধিক শত ধিক কৃতঘ্ন সন্তানের প্রতি! মাতৃ পিতৃ ঋণের দান যেন শকুনির থাবায় ভূলুণ্ঠিত। চরম অপমানিত, লাঞ্ছিত বৃদ্ধা মা না মরে বেঁচে আছে শুধু। এখন দেশে ফেরার অপেক্ষায়। আসলে নিজের পুত্র এবং পুত্রবধূরাও একক বা যৌথ পরিবার ভাঙ্গনের জন্য অনেকাংশে দায়ী। পরিবারের ভাঙনে অবহেলা ও নিষ্ঠুর আচরণ দায়ী বিধায় বাস্তব চোখে বিষয়টি দেখার জন্য উপরের সত্য ঘটনাটির উদ্ধৃতি দিয়েছি। একান্নবর্তী পরিবার বা যৌথ পরিবার ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে অনেক আগে। এখন একক পরিবার সাধারণের ধারণার বিপরীত স্রোতে ডুবন্ত প্রায়। বৈবাহিক সম্পর্কে জড়ানোর পর–ই একক পরিবারের সন্তানেরা শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বামী –স্ত্রী দু‘জনের সংসার গড়ে তুলে। মা–বাবাকে ছেড়ে নিজেরা আলাদা থাকতে তারা বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
আলাপচারিতায় উঠে আসে, অধিকাংশ ব্যক্তি তাদের একান্নবর্তী পরিবারের স্মৃতিচারণ করেন। একান্নবর্তী বা প্রসারিত পরিবারে সুবিধা ছিল অনেক বেশি –বিপদে আপদে অনেককেই পাশে পাওয়া যেতো, সুখ–দুঃখ ভাগ করে নিতে পারতো। যান্ত্রিকতার ছোঁয়ায় সামাজিক রীতিনীতি বদলাচ্ছে, মূল্যবোধেরও পরিবর্তন ঘটছে। সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে পারিবারিক কাঠামোতে যে পরিবর্তন ঘটেছে সে তুলনায় প্রবীণদের নিরাপত্তায় উদাসীনতা ও অনিশ্চয়তা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পারিবারিক ভাঙ্গনে যৌথ, একক বা প্রসারিত পরিবার থেকে ছিটকে পড়ছেন পরিবার প্রধানরা। যারফলে বিত্তশালী বা বিত্তহীন অনেক ভাগ্যাহত মা–বাবার আশ্রয় জোটে বৃদ্ধাশ্রমে। বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নেওয়া প্রবীণদের বেশিরভাগ উচ্চ শিক্ষিত, বিত্তশালী পরিবার থেকে আসা। তাঁদের মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি উর্ধতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও রয়েছেন। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত স্বজন বিহীন জীবন কাটান তাঁরা। কেউবা মাঝেমধ্যে পারিবারিক স্মৃতি স্মরণ করে চোখের জলে সান্ত্বনা খুঁজেন। এমনকি অনেকে মারা গেলে কৃতঘ্ন সন্তানরা পিতা–মাতার লাশ নিতেও আসেনা। হায়রে নরাধম সন্তানরা! বাঙালির পরিবার কেন্দ্রিক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারায় এখন ধুলোর আস্তরণ জমেছে। পরিবারের সম্পর্ক, হৃদ্যতা এখন হৃদয়হীনতায় ঢাকা পড়ে গেছে। আত্মীয় স্বজনের মধ্যে যোগাযোগ শুধু হাই হ্যালোতে সীমাবদ্ধ। পারিবারিক সম্পর্ক এখন দুঃস্বপ্নের ছায়ায় ঢাকা। পারিবারিক সমপ্রীতি ও ভালোবাসার বন্ধন আধুনিক সভ্যতার যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে। মানবতা ও মানবিক মূল্যবোধের শোচনীয় পরাজয়। সবমিলিয়ে পরিবর্তিত সমাজ ব্যবস্থায় চরম সংকটে নিমজ্জিত যৌথ, একক ও প্রসারিত পরিবারের বন্ধন অনেকটা এখন ভাঙনের স্রোতে।
লেখক : শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও প্রাক্তন অধ্যক্ষ, রাংগুনিয়া সরকারি কলেজ।