দৈনিক আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারের আজ ৬২তম মৃত্যুবার্ষিকী। এ উপলক্ষে তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা। যে কথা প্রায় সবাই জানেন, আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন আপাদমস্তক একজন ধর্মপ্রাণ ও মানবিক মানুষ। তাঁর পবিত্র হাতের সৃষ্টি আজকের আলোকিত ও সমাজ পরিবর্তনের আলোক দিশারী ‘দৈনিক আজাদী’। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ছিল অগ্রণী। মানবিকতার দিক দিয়ে আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার গরীব ও মেহনতি মানুষের পাশে থেকে তাদের কর্মের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হওয়ার উৎসাহ যুগিয়েছেন।
মোহাম্মদ আবদুল খালেক হলেন বৃহত্তর চট্টগ্রামের প্রথম মুসলিম ইঞ্জিনিয়ার, যিনি নিজের উজ্জ্বল পেশা ছেড়ে লাইব্রেরি, প্রেস ও পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন পশ্চাদপদ মুসলিম সমাজকে শিক্ষার মাধ্যমে এগিয়ে নিতে। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনে কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী রচিত একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ কবিতাটি তিনি ছেপেছিলেন অসীম সাহসিকতায়। বায়ান্নের ২২ ফেব্রুয়ারি রাতেই তাঁর প্রতিষ্ঠিত কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসে শুরু হয়ে যায় কবিতাটি প্রকাশের কার্যক্রম। গভীর রাতে কম্পোজ ও প্রুফের কাজ যখন সমাপ্ত প্রায়, তখন সরকারের গোয়েন্দা বাহিনী হঠাৎ হামলা শুরু করে প্রেসে। কিন্তু প্রেস কর্মচারীরা অতীব দ্রুততায় সম্পূর্ণ কম্পোজ ম্যাটার এমনভাবে লুকিয়ে ফেলে যে, তন্ন তন্ন করে খোঁজাখুঁজির পরও পুলিশ তার খোঁজ পায়নি। ফলে ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’র প্রকাশনার কাজ শেষ করা যায়। পরদিন তেইশে ফেব্রুয়ারি তারিখে লালদিঘির প্রতিবাদ সভায় কবিতাটি পাঠের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। পাক–সরকার কবিতাটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারকে গ্রেফতার করতে এলে প্রেস ম্যানেজার দবির আহমদ চৌধুরী নিজ কাঁধে ছাপার দায়িত্ব তুলে নেন। তাই গ্রেফতার করা হয় প্রেস ম্যানেজার দবিরকে। অবশ্য পরে তাঁর জামিন দেয়া হয়েছিল। ভাষা ও দেশ মাতৃকার সেবায় নিবেদিত ব্যক্তিত্ব আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার পরবর্তী সময়ে আজাদী প্রকাশে ব্রত হন।
চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী রাউজান এলাকার সুলতানপুর গ্রামে জন্ম মোহাম্মদ আবদুল খালেকের। ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুলাই। সেদিন মা–বাবার কোল আলোকিত করে জন্মেছিল যে শিশুটি পরবর্তীকালে সেই চারাগাছটি মহীরূহ হয়ে উঠলো, চট্টগ্রাম অঞ্চল আলোকিত হয়েছিল তার আলোকচ্ছটায়। তাঁর জন্ম এমন একটা বিরুদ্ধ সময়ে, যখন ব্রিটিশ ভারতে এ পশ্চাদপদ চট্টগ্রামকে আগামীর পথে এগিয়ে নিতে আলোকিত মানুষের ভীষণ প্রয়োজন ছিল। তাঁর পিতার নাম মোহাম্মদ বেলায়েত আলী চৌধুরী এবং মাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা। মোহাম্মদ আবদুল খালেক মা–বাবার মুখ উজ্জ্বল করে গেছেন তাঁর কর্ম দিয়ে। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় বহু দল ও মতের ধারক–বাহক হিসেবে সরকার ও জনগণের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা করে সংবাদপত্র। এ সত্যতা অনুধাবন করে চট্টলার কৃতী পুরুষ আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারের সুযোগ্য ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে দৈনিক আজাদী আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল আজ থেকে ৬৫ বছর আগে, ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৬০ সালে। এর আগে অবশ্য তিনি কোহিনূর নামে এক সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। আজাদী প্রকাশের দুই বছরের মাথায় ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৬২ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন। আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন চট্টগ্রামের সামাজিক সাংস্কৃতিক জীবনে তথ্য প্রবাহের মাধ্যমে নতুন গতি সঞ্চার করতে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই আজাদী দৃঢ়ভাবে পালন করে এসেছে কল্যাণমুখী, মানবব্রতী ও দেশব্রতী ভূমিকা। গরিব–দুঃখীদের পাশে দাঁড়ানো এবং তাদের মুখে হাসি ফোটানো ছিল মোহাম্মদ আবদুল খালেকের আজীবনের সাধনা। বিত্ত ও চিত্ত এ দুটোকে সমন্বয় করে তিনি শিক্ষা ও সমাজ উন্নয়নে ভূমিকা রেখে গেছেন। ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবদুল খালেকের জ্যোতির্ময়ী চেতনা তরুণ সমাজে যতবেশি ছড়িয়ে দেয়া যাবে, সমাজে ততবেশি আলোকিত প্রজন্ম তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। তিনি জীবদ্দশায় নানাভাবে সমাজকে অকাতরে বিলিয়েছেন, সমাজের উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছেন। তিনি ছিলেন সৃজনশীলতায় ভাস্বর মহাপুরুষ। তাঁর বহুমুখী কর্মযজ্ঞ এই ঘুণে ধরা সমাজে আলোর পথরেখা তৈরি করতে পারে। আজকের এই দিনে মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে আমরা তাঁর রুহের মাগফেরাত কামনা করছি।