ছয় বছরে ব্যাংকের ২৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ

অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান । দুজন ব্যাংকারসহ চারজনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

হাসান আকবর | বুধবার , ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ at ৬:৩৬ পূর্বাহ্ণ

অভিনব পন্থায় অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংকে যৌথ হিসাব খোলাসহ নানা কৌশলে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের প্রায় ২৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করার ঘটনায় দুজন ব্যাংকারসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক। ৬ বছরে ১০টি হিসাবের বিপরীতে বেসরকারি স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের প্রায় ২৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম১ এর উপসহকারী পরিচালক সবুজ হোসেন বাদী হয়ে গতকাল মঙ্গলবার নিজ কার্যালয়ে মামলাটি দায়ের করেন।

মামলার আসামিরা হলেন স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেড চট্টগ্রাম সিডিএ এভিনিউ শাখার সাবেক এভিপি ও ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী (৫৭), একই শাখার সাবেক এসইও এভিপি কাঞ্চন কুমার দে (৫৭), সাতকানিয়া উপজেলার চরখাগরিয়া গ্রামের ইব্রাহিম চৌধুরীর ছেলে সাইফুল ইসলাম চৌধুরী (৫১) এবং নগরের ডবলমুরিং থানার বাংলাবাজার স্ট্র্যান্ড রোড এলাকার মৃত আমির হোসেন দোভাষের ছেলে ইকবাল হোসেন দোভাষ (৬৯)। তাদের বিরুদ্ধে ২০০৭ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ১০টি হিসাবের মাধ্যমে মোট ২৪ কোটি ৭১ লাখ ৪২ হাজার ৪০৬ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দণ্ডবিধির ৪০৯/১০৯/৪২০/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১ ধারা এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫() ধারায় মামলা রেকর্ড করা হয়।

দুদকের মামলায় উল্লেখ করা হয়, চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতের একটি মামলার অনুসন্ধানকালে দেখা যায়, ১ নং আসামি তাজুল ইসলাম চৌধুরী ও ২ নং আসামি কাঞ্চন কুমার দে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লি. সিডিএ এভিনিউ শাখায় দায়িত্ব পালনকালে মেসার্স এইচ এন্ড কর্পোরেশনের নামে ব্যাংকের শাখায় বিগত ২০০৭ সালের ১৭ এপ্রিল একটি চলতি হিসাব খোলেন। হিসাব নং ৩৩০০০৯৭৬। আসামি মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম চৌধুরী ও আসামি ইকবাল হোসেন দোভাষের ছেলে মো. জাহিদ দোভাষকে উক্ত চলতি হিসাবের নমিনি উল্লেখ করা হয়। ব্যাংক কর্মকর্তা আসামি মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী উক্ত হিসাবের শনাক্তকারী ছিলেন। মোহাম্মদ আবদুস সবুর চৌধুরী ও আসামি ইকবাল হোসেন দোভাষকে অ্যাকাউন্ট ওপেনিং ফরমে মেসার্স এইচ এন্ড কর্পোরেশন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক উল্লেখ করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির অফিসের ঠিকানা দেখানো হয় কোতোয়ালী থানাধীন ৮২ আছদগঞ্জ। কিন্তু উক্ত ঠিকানায় এই নামের কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব কখনো ছিল না।

২০০৮ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর মেসার্স এইচ এন্ড কর্পোরেশনের নামে একটি সিসি (হাইপো) ঋণ হিসাব নং ২৭০০০০১৬৯ খোলা হয়। মেসার্স এইচ এন্ড এইচ কর্পোরেশন নামে পার্টনারশিপ দলিল তৈরি করা হয় ২০০৮ সালের ৩ জুন। অংশীদারী চুক্তিপত্র ২০০৮ সালের ১ জুলাই থেকে কার্যকর হবে বলে উল্লেখ করা হয়। মেসার্স এইচ এন্ড এইচ কর্পোরেশন নামে অংশীদারী চুক্তিপত্র একই বছরের ৩ জুন তৈরি করা হলেও উক্ত প্রতিষ্ঠানের নামে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক সিডিএ শাখায় চলতি হিসাব নং ৩৩০০০৯৭৬ খোলা হয়েছে ২০০৮ সালের ১৭ এপ্রিল। অংশীদারী চুক্তিপত্রে পার্টনারদ্বয়ের যৌথ স্বাক্ষরে ব্যাংক হিসাব পরিচালনার কথা উল্লেখ থাকলেও হিসাব নং ৩৩০০০৯৭৬এর অ্যাকাউন্ট ওপেনিং ফরমে অংশীদারদের যেকোনো একজন হিসাব পরিচালনা করবেন মর্মে উল্লেখ রয়েছে। এতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, ব্যাংকের টাকা আত্মসাতের উদ্দেশ্যে আসামিগণ সহযোগিতা ও পরস্পর যোগসাজশে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক সিডিএ শাখায় মেসার্স এইচ এন্ড এইচ কর্পোরেশন নামে ভুয়া ও মিথ্যা অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন।

এজাহারে বলা হয়, মেসার্স এইচ এন্ড এইচ কর্পোরেশন নামে পার্টনারশিপ দলিল সৃজন করার পূর্বেই মেসার্স এইচ এন্ড এইচ কর্পোরেশন নামে ব্যাংকে হিসাব খোলা হয়েছে এবং হিসাব নং ৩৩০০০৯৭৬এ লেনদেন করা হয়েছে। ৪ নং আসামি ইকবাল হোসেন দোভাষ মেসার্স এইচ এন্ড কর্পোরেশনের অনুকূলে ঋণ গ্রহণের উদ্দেশ্যে তার মালিকানাধীন ভূমিসহ চারতলা বিশিষ্ট ভবন বন্ধক রাখেন। প্রথমবার স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক সিডিএ শাখা ২০০৮ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর মেসার্স এইচ এইচ কর্পোরেশন বরাবর ৮ কোটি টাকা কম্পোজিট ঋণের সুবিধা প্রদান করলেও প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে একাধিকবার ঋণের লিমিট নবায়ন করে সর্বশেষ স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক প্রধান কার্যালয় ২০১০ সালের ১০ অক্টোবর ১৮ কোটি ৫০ লাখ টাকায় ঋণ সুবিধা মঞ্জুর করে। এভাবে আসামি মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী, কাঞ্চন কুমার দে ও সাইফুল ইসলাম চৌধুরী প্রতারণা করে মোহাম্মদ আবদুস সবুর চৌধুরীর নাম ব্যবহার করে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি এবং তা ব্যবহার করে কৌশলে ঋণের লিমিট বৃদ্ধি করে এবং লোকাল ও ফরেন এলসি খোলে। পরবর্তীতে এলসিসমূহকে এলটিআর ও পিএডিতে রূপান্তর দেখিয়ে ঋণের টাকা ডিসভার্সড করে ব্যাংকের মোট ২৪,৭১,৪২,৪০৬ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক প্রধান কার্যালয় কর্তৃক ব্যাংক কর্মকর্তা ১ নং আসামি তাজুল ইসলাম চৌধুরী ও ২ নং আসামি কাঞ্চন কুমার দে’র বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ বিষয়ে তদন্ত করে বিগত ২০১৩ সালের ৯ জুন তাদেরকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে।

মামলার এজাহারে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, আসামিরা প্রতারণা করে ব্যাংকের টাকা আত্মসাতের উদ্দেশ্যে ২০০৮ সালের ২৮ মে বন্ধক দেওয়া সম্পত্তির মূল্য ৪ কোটি ২৪ লাখ ৪২ হাজার হাজার টাকা দেখালেও সেই সম্পত্তির মূল্য ২০১০ সালের ১৯ আগস্ট ৭ কোটি ১০ লাখ টাকা দেখান। এছাড়া আসামিরা প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাথের উদ্দেশ্যে ২০০৮ সালের ৭ জুলাই গোডাউনে স্টক পণ্য প্রাথমিক সিকিউরিটি বাবদ মূল্য উল্লেখ করেন ১০ কোটি ৬ লাখ টাকা এবং ২০১০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সিকিউরিটি বাবদ স্টক পণ্যের ২৪ কোটি ৮ লাখ টাকা মূল্য দেখানো হয়।

মামলার এজাহারে বলা হয়, আসামিরা প্রতারণা করে বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা ও জাল ডকুমেন্টস তৈরি এবং ব্যবহার করে জামানতের মূল্য বৃদ্ধি করে প্রধান কার্যালয়ে ঋণের লিমিট বৃদ্ধি এবং ঋণ নিয়ে ২৪ কোটি ৭১ লাখ ৪২ হাজার ৪০৬ টাকা আত্মসাৎ করেন।

স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেড সিডিএ এভিনিউ শাখা ২০১০ সালের ১২ অক্টোবর ১৮ কোটি ৫০ লাখ টাকার কম্পোজিট ঋণ সুবিধা প্রদান করলেও রেকর্ডপত্রের আলোকে ২০১১ সালের ৮ মার্চ পর্যন্ত সিডিএ এভিনিউ শাখা মেসার্স এইচ এন্ড এইচ কর্পোরেশন নামে ৩টি লোন এগেইনস্ট ট্রাস্ট রিসিট (এলটিআর) হিসাব যথাক্রমে ০২৩৮৬৮০০১০১, ০২৩৮৬৮০০১০২, ০২৩৮৬৮০০১০৩; ৬টি পেইড এগেইনস্ট ডকুমেন্টস (পিএডি) হিসাব যথাক্রমে ০২৩৮৭৩০২৪৯৫, ০২৩৭৩০২৫২০, ০২৩৮৭৩০২৫২২, ০২৩৮৭৩০২৫২৩, ০২৩৮৭৩০২৫৪২, ০২৩৮৭৩০২৫৪৫ ও একটি ক্যাশ ক্রেডিট (সিসি) (হাইপো) হিসাব নং ১৫০০০১৬৯; মোট ১০টি হিসাবের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা গ্রহণ করেন, কিন্তু তা পরিশোধ না করে পুরো টাকাই আত্মসাৎ করেছেন বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়। ৩ নং আসামি সাইফুল ইসলাম চৌধুরী মেসার্স এইচ এন্ড এইচ কর্পোরেশন নামীয় প্রতিষ্ঠানের ব্যাংকের সমস্ত দায় দেনার ব্যক্তিগত জামিনদার ছিলেন। তিনি ২০১০ সালের ১২ অক্টোবর ব্যাংকের লেটার অব গ্রান্টিতে জামিনদার হিসেবে স্বাক্ষর করেন। মেসার্স এইচ এন্ড এইচ কর্পোরেশন নামে বাস্তবে কোনো প্রতিষ্ঠান না থাকা সত্ত্বেও আসামিগণ মেসার্স এইচ এন্ড এইচ কর্পোরেশন নামে ভুয়া একাউন্ট সৃজন করে এবং আসামি ইকবাল হোসেন দোভাষের সম্পত্তিকে ব্যবহার করে ভ্যালুয়েশন প্রতিবেদনে বারবার মূল্য বৃদ্ধি করে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক সিডিএ শাখা থেকে নানা অপকৌশলে টাকা আত্মসাৎ করেন।

ঘটনাটির ব্যাপারে মামলা রুজুর বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুমোদন চাওয়া হলে দুদক প্রধান কার্যালয় থেকে স্মারক নং০০.০১.১৫০০.৬২২.০২.০৩৯.২০.চট্টগ্রাম/৩৩৬৬৬ মূলে গত ১৯ সেপ্টেম্বর অনুমোদন প্রদান করা হয়। গতকাল মামলাটি করা হয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধতিন ক্যাটাগরিতে চারটি কাগজ হলেই নতুন ভোটার
পরবর্তী নিবন্ধচকরিয়ায় ডাকাতের ছুরিকাঘাতে সেনা কর্মকর্তা নিহত