জ্ঞান অন্বেষণের এক বিরল সাধক

আবুল কালাম বেলাল | সোমবার , ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ at ৮:৪৫ পূর্বাহ্ণ

. মাহবুবুল হক ছিলেন একাধারে বীর মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষাবিদ, সুসাহিত্যিক, গবেষক, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সংগঠক। শিশুসাহিত্যিক। প্রায়োগিক বাংলা ও ফোকলোর চর্চাবিদ। পাঠ্যবই রচয়িতা ও সংকলক। জ্ঞান অন্বেষণের এক বিরল সাধক। সর্বোপরি ভাষাবিজ্ঞানী।

১৯৯১ সালে ‘বাংলা বানানের নিয়ম’ বই লিখে এপার বাংলা ওপার বাংলায় দারুণ সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। পাঠক ও বোদ্ধা মহলে বেশ আলোড়িত ও সমাদৃত গ্রন্থটি তাঁর পরিচিতির গণ্ডি আন্তর্জাতিক মাত্রায় পরিব্যাপ্ত করে। তিনি কেবল প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম প্রণয়নে সক্রিয় ছিলেন না পাশাপাশি বিভিন্ন গবেষণাগ্রন্থ রচনায়ও কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘নজরুল তারিখ অভিধান’ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে তাঁকে স্বীকৃতি এনে দিয়েছিলেন। এসব গ্রন্থ ছাড়াও বাংলাদেশ, ভারত ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে তাঁর আশিটির বেশি বই প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থা থেকে। তাঁর উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে : রবীন্দ্র সাহিত্য রবীন্দ্র ভাবনা, ইতিহাস ও সাহিত্য, ভাষার লড়াই থেকে মুক্তিযুদ্ধ, ফোকলোর ও অন্যান্য, বাংলার লোকসাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতি, বাংলা ভাষা : কয়েকটি প্রসঙ্গ, তিনজন আধুনিক কবি, চট্টগ্রামে শেখ মুজিব, বাংলা সাহিত্যের দিকবিদিক প্রভৃতি। তিনি বেশ কিছু মৌলিক কাজও করেছিলেন যা তাঁকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। যেমনবাংলা সাহিত্য: কয়েকটি প্রসঙ্গ, বাংলা সাহিত্য: নানা নিবন্ধ, লোকসংস্কৃতি : কয়েকটি প্রসঙ্গ, বাংলার লোকসাহিত্য : সমাজ ও সংস্কৃতি এবং বিদেশি সাহিত্যের বঙ্গানুবাদ গ্রন্থ সোভিয়েত রাশিয়ায় গমন এবং রুশ ভাষার পাঠগ্রহণ ইত্যাদি। তিনি আশুতোষ চৌধুরী, লোকমান খান শেরওয়ানীর মতো ব্যক্তিত্বের জীবনীও রচনা করেছিলেন। তাঁর আরেকটি অসাধারণ কাজ দৈনিক আজাদীর বিশেষ সংকলন ‘হাজার বছরের চট্টগ্রাম’। এটি সম্পাদনা করে তিনি ইতিহাসঐতিহ্যে, শুদ্ধ শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে তাঁর অকৃত্রিম ও নিখাদ ভালোবাসার প্রমাণ রেখে যান। এ ছাড়া তিনি শিশুকিশোরদের জন্যও কলম ধরেছিলেন। একে একে রচনা করেন গল্প, প্রবন্ধ, অনুবাদসহ বিভিন্ন স্বাদের বই। এক্ষেত্রেও তাঁর ‘ছড়ায় ছড়ায় বাংলা বানান’ গ্রন্থটি সাড়া জাগিয়েছে। এ গ্রন্থের মধ্য দিয়ে তিনি শিশুদের যুক্তাক্ষর বানানভীতি দূর করতে সচেষ্ট হন। তাদের মন জয় করতে সক্ষম হন। মূলত তিনি ছিলেন একজন কঠোর নির্মাণসাধক। সমকালকে ধারণ করে অতীত ঐতিহ্যের চিত্রকথন পাঠকসমুখে উপস্থাপনে তিনি ছিলেন নিরলস শ্রমিক। তাঁর যাপিত কর্মময় জীবন ছিল নিয়মশৃঙ্খলাধীন। সারা জীবন কেবল শিক্ষার্থীদের মাঝে আলো বিতরণ করেননি, সাধারণ মানুষের কল্যাণেও জ্ঞানালোক, দেশপ্রেম এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ফেরি করেন। তাই তিনি সাধারণ্যে অসাধারণ। পশ্চিমবঙ্গের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. পবিত্র সরকারের ভাষায়, ‘. মাহবুবুল হক বাংলাদেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সাহিত্য অঙ্গনের এক কীর্তিমান ব্যক্তি।’ তাঁর সান্নিধ্য যিনি পেয়েছিলেন তিনিই জানেন ড. মাহবুবুল হক কত বিনয়ী, বন্ধুবৎসল, অতিথিপরায়ণ সর্বোপরি আমাদের লোক ছিলেন। তাঁর পাণ্ডিত্য আর দূরদর্শিতা এবং সাংগঠনিক দক্ষতাও ছিল অতুলনীয়।

.

. মাহবুবুল হক ছিলেন অনন্য এক শিক্ষক। শিক্ষকজীবন প্রসঙ্গে একুশে পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তিত্ব আবুল মোমেন বলেন, ‘সবাই শিক্ষক নন, কেউ কেউ শিক্ষক। যিনি অকাতরে ধর্মবর্ণ নির্বিচারে জ্ঞান বিতরণ করেন তিনিই প্রকৃত শিক্ষক।’ কথাগুলো ড. হকের জন্যও প্রযোজ্য। সত্যিই, সবাই শিক্ষক নন, কেউ কেউ শিক্ষক। আর এ শিক্ষকরা কখনো মরেন না। একুশের পদকপ্রাপ্ত আরেক ব্যক্তিত্ব খ্যাতিমান সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন বলেন, ‘শিক্ষকরা অবিনাশী। প্রকৃত শিক্ষকরা কখনো মৃত্যুবরণ করেন না। তারা শিক্ষার্থীদের মাঝে বেঁচে থাকেন।’ এ দুজনের কথা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে তার যথার্থ প্রমাণ পাওয়া যায়। কেবল শিক্ষার্থীদের কাছে নন তাঁর বহুমাত্রিক সাহিত্য প্রতিভার দ্যুতিতে আলোকিত হয়েছেন এবং হচ্ছেন সমাজের সব শ্রেণির মানুষ। খ্যাতিমান সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যখন বলেন, ‘সাহিত্য রচনা আসলে চব্বিশ ঘন্টার কাজএকজন লেখক দিনের পর দিন বা মাসের পর মাস এক লাইনও না লিখলেও তিনি আসলে সর্বক্ষণই সাহিত্য নিয়েই ব্যাপৃত থাকেন। তাঁর গতিবিধি ও ব্যবহারিক স্বাধীনতা অত্যন্ত জরুরি।’ ড. মাহবুবুল হকও সাহিত্যের ঘরসংসারে সারাজীবনই কাটিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, ‘ক্লান্তি মোরে ক্ষমা করো।’ হয়েছেন দেশবিদেশে খ্যাত। পেয়েছেন দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদক, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ফিলিপস পুরস্কার, নজরুল পদক, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন পুরস্কার, চট্টগ্রাম একাডেমি পুরস্কার, মুক্তিযুদ্ধ পদক, মধুসূদন স্বর্ণপদকসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মান।

ফরিদপুরের মধুখালিতে ১৯৪৮ সালের ৩ নভেম্বর জন্মগ্রহণকারী ড. মাহবুবুল হক শৈশব থেকেই বেড়ে ওঠেছেন চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৯ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৭০ সালে একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৯৭ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শেষে কুমিল্লার কোটবাড়িতে অবস্থিত সিসিএন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে আসীন ছিলেন তিনি।

আমাদের প্রিয় এ মানুষ, প্রিয় সাহিত্যিক, প্রিয় গবেষক, দেশের অন্যতম অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্ব, জীবনদর্শন ও চিন্তাধারায় মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারী, অসাম্প্রদায়িকউদার ও আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির ধারক ড. মাহবুবুল হক গত ২৪ জুলাই নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে শারীরিকভাবে চলে গেছেন বটে। কিন্তু রেখে গেছেন তাঁর বর্ণিল সৃষ্টিসম্ভার যার আলো দেশ ও সমাজ বিনির্মাণে, আলোকিত পথ তৈরিতে ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখবে। আমরা তাঁর সৃষ্টিকর্ম তর্পন, ধারণ ও চর্চার মাধ্যমে তাঁকে চিরঞ্জীব রাখবো।

স্যার, আপনি আমাদেরই প্রিয় লোক ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। আপনাকে গভীর শ্রদ্ধা জানাই। মহান সৃষ্টিকর্তা আপনাকে জান্নাতবাসী করুন। আমিন।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাংলাদেশের ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়নের স্বার্থে ব্রিটেনের আদলে অনু্‌করণীয় কিছু প্রস্তাবনা
পরবর্তী নিবন্ধযানবাহনের ক্রমবিবর্তন