বন্দরের ৪শ কোটি টাকার জায়গা ইজারা দেওয়া নিয়ে তোলপাড়

নিয়ম না মেনে টেন্ডার ছাড়া বোর্ড মিটিংয়ের সিদ্ধান্ত । অভিযোগ বন্দরের সাবেক চেয়ারম্যান সোহায়েলের বিরুদ্ধে

আজাদী প্রতিবেদন | সোমবার , ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ at ৭:৫৮ পূর্বাহ্ণ

প্রচলিত নিয়ম না মেনে টেন্ডার আহ্বান ছাড়া শুধুমাত্র বোর্ড মিটিংয়ের সিদ্ধান্তে চট্টগ্রাম বন্দরের ৪শ কোটি টাকা দামের ৮ একর জায়গা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে গোপনে ইজারা দেওয়ার ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়েছে। গোপনীয়তার মধ্যে বন্দরের ৮শ কাঠা ভূমি ইজারা দেওয়ার ব্যাপারে অভিযোগ উঠেছে বন্দরের সাবেক চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম সোহায়েলের বিরুদ্ধে। ইনকনট্রেড নামের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটিকে এর আগেও প্রায় ২৩ একর জায়গা ৩০ বছরের জন্য ইজারা দেওয়া হয়েছিল। সেই জায়গার সাথে নতুন করে ৮ একর জায়গা ইজারা দেওয়া হয়।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বিপুল ভূসম্পত্তির মালিক। এর মধ্যে বর্তমানে বন্দরের কাজে ব্যবহৃত হয় না এমন অনেক স্থাপনা ও জায়গা বন্দর কর্তৃপক্ষ ইজারা বা ভাড়া দিয়ে থাকে। বন্দরের এস্টেট বিভাগ বিষয়গুলো দেখভাল করে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের মালিকানাধীন ১৩ ও ১৪ নম্বর খালের মধ্যবর্তী ২২.৭৭৬ একর ভূমি ২০০৫ সালের ১৩ জুলাই ইনকনট্রেড লিমিটেড নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিকট ৩০ বছরের জন্য ইজারা প্রদান করে। উক্ত ইজারা চুক্তিতে ইজারার মেয়াদ পরবর্তীতে আরো ২০ বছর বাড়ানোর সংস্থান রাখা হয়। উক্ত ভূমিতে ইনকনট্রেড লিমিটেড আইসিডি নির্মাণ করে। ব্যবসা সম্প্রসারণ করার জন্য ইনকনট্রেড গত ২ জানুয়ারি তাদের অনুকূলে আরো ৮ একর জায়গা ইজারা প্রদানের জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষের নিকট আবেদন করে।

বন্দর কর্তৃপক্ষ ইনকনট্রেডের আবেদন দ্রুত বিবেচনা করে ৯ এপ্রিল অনুষ্ঠিত বোর্ড সভায় পূর্ব পতেঙ্গা এলাকার ৬ নম্বর খতিয়ানের অন্তর্ভুক্ত বিএস দাগ নম্বর ১১৫ (অংশ) এবং ১২৪ (অংশ) দাগাদীর আন্দর ৮ একর ভূমি ইনকনট্রেড লিমিটেডের নামে ইজারা প্রদান করে। শুধুমাত্র বোর্ড সভায় নেওয়া সিদ্ধান্তে বন্দরের বিপুল পরিমাণ ভূমি ইজারা দেওয়া হয় ওই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে। কিন্তু বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রচলিত আইনে শুধুমাত্র বোর্ড সভার সিদ্ধান্তে ভূমি ইজারা প্রদানের সুযোগ নেই মন্তব্য করে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দরের ভূমি ব্যবস্থাপনা আইন অনুযায়ী, সন্নিহিত জলসীমাসহ নদীতীর ব্যতীত চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ভূসম্পত্তি, স্থাপনা ও অন্যান্য স্থাবর সম্পত্তি দরপত্র আহ্বান ছাড়া লাইসেন্স বা ইজারা প্রদান করা যাবে না।

অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, ইনকনট্রেড লিমিটেড ২০০৫ সালে নেওয়া শাহ আমানত বিমানবন্দরের সড়ক সংলগ্ন পূর্ব পতেঙ্গার প্রায় ২৩ একর জায়গার ইজারা মেয়াদ শেষ হতে ১১ বছর বাকি রয়েছে। তারা উক্ত ইজারা মেয়াদ বাড়ানোর পাশাপাশি নতুন করে আট একর খালি জায়গা তাদেরকে ইজারা দেওয়ার জন্য আবেদন করে। বন্দর কর্তৃপক্ষ ওই জায়গার মেয়াদ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ২০ বছরের জন্য বাড়ায়। একই সঙ্গে দরপত্র ছাড়াই বোর্ড মিটিংয়ের সিদ্ধান্তে ওই প্রতিষ্ঠানকে নতুন করে ৮ একর জায়গা ইজারা দেওয়া হয়। ৯ এপ্রিল বোর্ড মিটিংয়ে নেওয়া সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ২১টি শর্ত উল্লেখ করে ১৫ মে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং ইনকনট্রেডের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান, সদস্য (প্রকৌশল), ডেপুটি ম্যানেজার (এস্টেট) এবং ইনকনট্রেডের পক্ষে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান স্বাক্ষর করেন।

এই ইজারা প্রক্রিয়ায় কোটি কোটি টাকা অবৈধ লেনদেনের অভিযোগ এনে ইতোমধ্যে ইজারা বাতিলের আবেদন করা হয়েছে বন্দরের বর্তমান চেয়ারম্যান বরাবরে। বন্দরের সাবেক চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যডমিরাল এম সোহায়েলের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করে বলা হয়েছে, বোর্ড মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও তা যেন প্রকাশ না পায় সেজন্য গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়েছে। এই ধরনের ইজারার ক্ষেত্রে চুক্তি স্বাক্ষরের দুয়েকদিনের মধ্যে জায়গার দখল বুঝিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এই ৮ একর ভূমির ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। চুক্তি স্বাক্ষরের ৫ মাসের বেশি সময় পর গত ৮ আগস্ট এস্টেট বিভাগ থেকে জায়গাটি বুঝিয়ে দিয়ে কাজ করার জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়। সরকার পতনের পর তড়িঘড়ি করে কাজটি দ্রুততার সাথে সম্পন্ন করা হয় বলে অভিযোগ করা হয়েছে।

বন্দর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দরপত্রের মাধ্যমে ইজারা দিলে ৮ একর জায়গার জন্য একাধিক প্রতিষ্ঠানের দরপত্রে অংশগ্রহণের সুযোগ থাকত। সেখানে সর্বোচ্চ দরদাতাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ইজারার এককালীন অর্থসহ প্রকৃত ভাড়ার চেয়ে আরও কয়েক গুণ বেশি হারে ভাড়া আদায় করার সুযোগ ছিল। একইসঙ্গে নিয়ম পালনের ফলে প্রতিষ্ঠানটির স্বচ্ছতাও নিশ্চিত করা যেত। কিন্তু নিয়ম না মেনে ইজারা দেওয়ায় সরকার মোটা অংকের রাজস্ব হারিয়েছে বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম সোহায়েলকে চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দিয়ে ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি কারাগারে রয়েছেন।

বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ডেপুটি ম্যানেজার (এস্টেট) মুহাম্মদ শিহাব উদ্দিনকে ফোন করা হয়। তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে যুবকের মৃত্যু
পরবর্তী নিবন্ধইলিশ রপ্তানি বন্ধে আইনি নোটিশ