পত্রিকা পড়তে পড়তে কোনো খবরে চোখ আটকে গেলে পড়ার পর পত্রিকাটি আলাদা করে রাখি। পরে সময় করে বিষয়টি নিয়ে একটু চিন্তা ভাবনা করে একটা লেখা দাঁড় করানোর চেষ্টা করি। কিন্তু বিষয়টা আমার কাজের সহকারীদের একেবারেই পছন্দ নয়। আমার অজান্তে সেই পত্রিকাগুলো নিয়ে তারা রুটি বানানোর সময় পীড়ার নীচে পেতে দেবে, আধা–পাকা পেঁপে মুড়িয়ে রাখবে, বারান্দার স্লাইড মুছবে আরও কতকি কাজে ব্যবহার করে। এমনিতেই তারা আমার উপর মহা বিরক্ত, আমি পুরো ডাইনিং টেবিল জুড়ে বইখাতা বিছিয়ে বসে থাকি বলে। মাঝেমধ্যে ডাইনিং থেকে রান্না ঘরের দিকে চোখ তুলে তাকাই, জানতে চাই তারা কি করে! এসব তাদের মোটেই পছন্দ হয় না। আহা ভার্জিনিয়া উলফ সার্ধশতবর্ষ বা তারও বেশি আগে লিখে গিয়েছেন অ ৎড়ড়স ড়হবং ড়হি. নারী লেখকদের কি প্রয়োজন তিনি এই বইতে লিখে গিয়েছেন। যদিও আমি নিজেকে লেখক হিসেবে দাবি করছি না। আজকে সেইরকম সংগৃহীত ১৪–৩–২০২৪–এর পত্রিকাটি উদ্ধার হলো, তাও রান্নাঘর থেকে! হাতে নিতেই চোখে পড়লো শ্যামল বরণী, মুক্তাঝরা হাসিতে দুই গালে টোলপড়া মিষ্টি একটা মেয়ের ছবি! মনটা ভারী হয়ে ওঠে। আসলে আমরা আমাদের অর্জনের কোনো কিছুই কি ধরে রাখতে পারি?
রাজিয়া সুলতানা। তার নামটাও ভুলে যেতে বসেছি এতদিনে! অনেকেই হয়তো মনে করতে পারছেন না তার নাম বা পরিচয়। অপ্রতিরোধ্য একটি নাম। দাপিয়ে খেলেছেন মৃত্যুর কিছুদিন আগ পর্যন্ত। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় উভাকুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্ট খেলে তার শুরু এরপর টানা অনূর্ধ্ব ১৩ থেকে অনূর্ধ্ব ১৯ ও জাতীয় দলে। ২০১৮ সালে ভুটানে সাফ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপের অপরাজিত সদস্য। দেশের ভেতর ও বাইরে খেলেছেন। খেলেছেন ভারত, ভুটান, নেপাল মালদ্বীপ ও সিঙ্গাপুরে। আমরা জানি সাফজয়ী মেয়েদের আর খেলতে দেওয়া হয়নি নানা অজুহাতে। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন মেয়েদের খেলতে দিতে পারেনি, বেতন দিতে পারেনি, এমনকি খেতেও দিতে পারেনি। মেয়েদের দলকে কখনো গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। অথচ এই অবহেলিত মেয়েদের দল কি অভাবনীয় সাফল্য নিয়ে এসেছে দেশের জন্য! নারী খেলোয়াড়েরা বাফুফের বেতনভুক্ত হলেও ক্লাব পর্যায়ে খুবই কম পারিশ্রমিক পান। আশা করছি এই পরিবর্তিত সময়ে নারী খেলোয়াড়দের যথাযথ দৃষ্টি দেওয়া হবে। তাদের ফিটনেস, তাদের খাওয়াদাওয়া, তাদের স্বাস্থ্য, বিয়ে, সন্তান নেওয়া এসব ব্যাপারে যথেষ্ট কাউন্সিলিং প্রয়োজন। এসব মেয়েরা একবারে হতদরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসে। আমরা জানি একজন নারী যেখানে যেই জায়গা থেকে উঠে আসুক তার উঠে আসার পথটা মোটেও মসৃণ থাকে না। রক্তাক্ত পায়ে দাঁড়াবার একটা অবস্থান তৈরি করতে পারলেও তার ভিত্তিটা যে খুব শক্ত হয় তাও না। খেলতে আসা মেয়েদের তো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত লড়াই করে যেতে হয়। তার নিজের পরিবারের সাথে, সমাজের সাথে, ধর্মের সাথে, দরিদ্রতার সাথে এমন কি তার শরীরের সাথেও। রাজিয়া সুলতানা গরু চড়াতে চড়াতে জাম্বুরা কিংবা হাওয়া যাওয়া বল কুড়িয়ে নিয়ে ভাই বোনদের সাথে খেলতো। তার খেলার সাথীরা অবাক বিস্ময়ে বলে “তার হাডুটা কি দে যে বানায়েছিল তা কেবল আল্লাহ পাকই জানে! যে জোর ছিল বাপরে বাপ! বসন্তপুরে যেবার খেলতে গেছিল সে একাই সাতটা গোল করিছে!” আমাদের দুর্ভাগ্য অকালে ঝরে পড়লো এমন মেধাবী ফুটবল তারকাটি! মাত্র একুশ বছর বয়স। মেয়েদের বিয়ে নিয়ে চিরাচরিত চিন্তার বাইরে আমাদের সমাজ এখনো ভাবতে পারে না। বিয়ে হলো। সন্তান হওয়ার সময় সিদ্ধান্ত নিলো ঘরেই সন্তান প্রসব করবে। হাসপাতালে গেলে তার অস্ত্রোপচার হতে পারে। অস্ত্রোপচার হলে তাকে বছরখানেক খেলার বাইরে থাকতে হবে নিয়ম অনুযায়ী। তাহলে চলবে কিভাবে! ঘরে স্বাভাবিক প্রসব হলে সে তাড়াতাড়ি খেলতে পারবে। বাচ্চা পালার জন্য টাকা পয়সা হাতে থাকবে! নিষ্ঠুর নিয়তি! বাচ্চা হওয়ার পাঁচ ঘন্টা পরে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে সুলতানার মৃত্যু হয়। তার পরিবার সচেতন ছিল না। কর্তৃপক্ষেরও কি কিছুই করার ছিল না সাফ জয়ী এই কন্যাটির জন্য? বাফুফের নারী শাখার প্রধান মাহফুজা আক্তারের ভাষায়, বাফুফে অনেকটা ধরে বেধে নারী ফুটবল দলের জন্য স্পন্সর জোগাড় করেন। সরকারের কোনো অর্থ বরাদ্দ নেই! ক্লাবগুলোও দরিদ্র! নারীদের যখন কেউ খেলেন তখন তারা টাকা দেয়। অন্য কোনো সুবিধা তাদের জন্য নেই। সুলতানা রাজিয়ার মতো আর কোনো যুদ্ধজয়ী খেলোয়াড় যেন অবহেলায় এভাবে চিরবিদায় না নেন। নারী খেলোয়াড়দের জন্য সুযোগ–সুবিধা বাড়ানো প্রয়োজন। সম্ভাবনাময় জীবনগুলোকে যেন আমরা আমাদের ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখি। বাংলাদেশের নারীদের সংগ্রাম তো অন্তহীন। ঘরে বাইরে জীবনের সর্বত্রই বাধার পাহাড় ডিঙিয়ে তাদের সামনে এগুতে হয়। নতুন সরকারের কর্মকাণ্ড নারী বান্ধব হোক। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসুক। এটাই প্রত্যাশা।
সমপ্রতি একটি খবর আমাদের আশান্বিত করে, নারীদের ক্রিকেটকে এগিয়ে নিতে আইসিসি আসন্ন নারী টি–টুয়েন্টি বিশ্বকাপে পুরুষদের সমান প্রাইজমানি নারী ক্রিকেটারদেরও দেওয়া হবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। ক্রমান্বয়ে সব খেলায় নারী খেলোয়াড়দের জন্য এমন সিদ্ধান্ত আসবে বলে প্রত্যাশা করি সেটা বাইরে থেকে হোক বা নিজ দেশের ক্রীড়াঙ্গনে হোক।