যেকোন জাতিরাষ্ট্রের সচল অর্থনীতির মূলভিত্তি হচ্ছে সমৃদ্ধ বাজার ব্যবস্থা। আপামর জনগণের প্রয়োজন মোতাবেক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা–সরবরাহের ভারসাম্য একান্তই জরুরী। সকল প্রকার অবৈধ–অনৈতিক সিন্ডিকেট ও বাজার কারসাজি সংহার করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের ভূমিকা মুখ্য। নিয়মিত পরীক্ষণ–পর্যবেক্ষণ ও তদারকির মাধ্যমে নিশ্চিত করা যায় সাবলীল পণ্যমূল্য। দেশীয় উৎপাদনের ঘাটতি হলে আমদানি–রপ্তানির মাধ্যমে স্বাভাবিকতা বজায় রাখার গতিধারায় জনদুর্ভোগের অবসান ঘটে। শিল্পসহ যাবতীয় অত্যাবশ্যকীয় সরঞ্জাম–খাদ্যদ্রব্য আমদানি–রপ্তানিতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভই যৌক্তিক সচলতা অব্যাহত রাখে। দুঃখজনক হলেও সত্য, অর্থলিপ্সু মানবরূপী দানবেরা ওভার–আন্ডার ইনভয়েসিং এর মাধ্যমে আমদানি–রপ্তানি খাতকে করে কলুষিত। ইতিমধ্যে বিপুল প্রচারিত যে, ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধ না করে ঋণ খেলাপি সেজে অনৈতিক পন্থায় বিশাল অঙ্কের অর্থ বিদেশে পাচারের মধ্য দিয়ে দেশকে করেছে লন্ডভন্ড। বিগত সরকারের আমলে জঘন্য এসব অর্থপাচারের ঘটনাসমূহ দেশবাসীকে হতবাক করছে। অবিশ্বাস্য রকমের ব্যাংক লুটপাটে কতিপয় ব্যক্তি–প্রতিষ্ঠানকে অশুভ শক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় চাঙ্গা করেছে।
পক্ষান্তরে পুরো দেশের জনগণের পুঞ্জিভূত সঞ্চয়ে কথিত প্রায় একক ব্যক্তির মালিকানাধীন ব্যাংকসমূহ দেশের পুরো অর্থব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। ঘৃণ্য উচ্চাভিলাষী উচ্চবিত্তদের করায়ত্তে ব্যাংকগুলো পৈত্রিক–পারিবারিক সম্পত্তিরূপে ছিল পরিগণিত। নানা অনিয়ম–দুর্নীতি–অব্যবস্থাপনা ও মালিকপক্ষ–উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীনতায় দেশের ব্যাংকিং খাতের ক্রমাগত অবনতি ছিল গভীর অনুভূত। গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন পরিসংখ্যান অনুসারে, বিগত বছরগুলোতে ফসল উৎপাদন বাড়লেও পণ্যের দাম ছিল সবসময় উর্ধ্বমুখী। পণ্যের দামের অনুপাতে বাড়েনি মানুষের আয়। বাজার সিন্ডিকেট, সড়কে চাঁদাবাজি, অবৈধ মজুদদারি ও মধ্যস্বত্বভোগীদের আধিপত্য ছিল অতিশয় দৃশ্যমান। বাজারে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় মাঠ পর্যায় থেকে বাজার পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে তারা প্রভাব বিস্তার করেছিল। বাজারের সিন্ডিকেট না ভেঙে বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করেও বিগত সরকার বাজার ব্যবস্থার অরাজকতা রোধে ব্যর্থ হয়েছে। তাছাড়া দেশের আমদানির নিয়ন্ত্রণও ছিল গুটিকয়েক ব্যক্তি–প্রতিষ্ঠানের দখলে।
ফলশ্রুতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে দেশের মধ্যম ও নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনপ্রবাহ হয়েছিল ওষ্ঠাগত। সর্বোপরি নতুন করে ৬০ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে বাজারে ছাড়ায় মুদ্রাস্ফীতির মাত্রাকে অধিকতর বেগবান করেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩–২৪ অর্থবছরে বার্ষিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশে যা ২০১১–১২ অর্থবছরের পর সর্বোচ্চ। ২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে তা কিছুটা কমে হয় ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। বিগত অর্থবছরের ১২ মাসের মধ্যে সাত মাসেই খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ শতাংশের ওপরে। দেশের মুদ্রাবাজারে চরম অস্থিরতায় ব্যাংকের বাইরে খোলাবাজারে ডলারের দাম প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পেয়ে ডলারসহ অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রারও সংকট তৈরি হয়েছিল। সামগ্রিক অর্থনীতির বেশকিছু সূচকে অবনতির চিত্র ছিল অতি সুস্পষ্ট। এছাড়াও করোনা অতিক্রান্তকাল থেকে শুরু করে রাশিয়া–ইউক্রেন–গাজা–ইসরাইল যুদ্ধ, ডলার সংকট, উন্নত বিশ্বের নীতি সুদহার বৃদ্ধিসহ নানা কারণে বিশ্ব অর্থব্যবস্থা এখনও টালমাটাল। প্রতিনিয়ত বিপুল সংখ্যক অস্ত্র–জ্বালানি ব্যবহার এবং অনুৎপাদন খাতে বিশ্বব্যাপী অসম বিনিয়োগ এক ধরনের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে। একদিকে উন্নত বিশ্বে অর্থ অপচয় এবং অন্যদিকে খাদ্য সংকটে অনুন্নত বিশ্ব নিপতিত। বিশেষ করে গাজা বা ফিলিস্তিনের গণমানুষের খাদ্যের আকুতি বা দুর্ভিক্ষ অবস্থায় পুরো বিশ্বের সভ্যসমাজের হৃদয়ে কাতরতা বিরাজিত।
এটি সর্বজনবিদিত যে, একটি দেশের আমদানি ব্যয় মেটানো, বাজেট বাস্তবায়ন, বৃহৎ প্রকল্পে অর্থের জোগান, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ, আর্থিক বিপর্যয় মোকাবিলা, স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন রোধ, মুদ্রানীতি শক্তিশালীকরণসহ নানামুখী অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ খুবই গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। অর্থনীতিবিদদের মতে, কোনো দেশে তিন মাসের মোট আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো বৈদেশিক মুদ্রার মজুত থাকলে তা মোটামুটি নিরাপদ। মূলতঃ দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত হচ্ছে– রপ্তানি আয়, প্রবাসীদের রেমিট্যান্স প্রবাহ, দাতা সংস্থা বা সহযোগী রাষ্ট্রের ঋণ–অনুদান ইত্যাদি। টালমাটাল বৈশ্বিক অর্থনৈতিক দূরাবস্থায় বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান উৎস প্রবাসী আয় গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে প্রতিভাত। প্রবাসীদের অতি কষ্টার্জিত রেমিট্যান্সের উপর ভর করে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ মজবুত হয়েছে অর্থনীতির ভীত। দেশের জিডিপিতে অবদান রাখা এই রেমিট্যান্স পরিণত হয়েছে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের উল্লেখযোগ্য অংশীদার।
কিন্তু কোভিড পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক কার্যক্রমের স্বাভাবিক গতিশীলতা এবং রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানিসহ সকল ধরনের পণ্যের মূল্য কয়েক গুণ বৃদ্ধি পায়। বেশি দামে পণ্য ক্রয়ে আমদানি ব্যয় বাড়লে রিজার্ভ কমতে শুরু করে। এরপর আর উর্ধ্বমুখী হয়নি রিজার্ভের পরিমাণ।এটিও স্মরণযোগ্য যে, চলতি বছরের জুলাই মাস থেকে শুরু হওয়া ছাত্র–জনতার অভাবনীয় গণআন্দোলন সময়কালে রেমিট্যান্স যোদ্ধারা ছিল অত্যন্ত সক্রিয়। প্রচন্ড পরিশ্রমে উপার্জিত অর্থ দেশে না পাঠানোর জন্য তাদের আহ্বান ছিল যুগান্তকারী। ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে দমন–পীড়নের প্রতিবাদে বিগত সরকারের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে প্রবাসীরা বৈধপথে রেমিট্যান্স না পাঠিয়ে হুন্ডিতে পাঠানোর ঘোষণা দেন। মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপ, আমেরিকার কয়েকটি দেশে ছাত্রদের আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে প্রবাসীরা সমাবেশ ও বিক্ষোভ প্রদর্শনে সোচ্চার ছিল। ফলশ্রুতিতে রেমিট্যান্স প্রবাহের নিম্নগতি পরিলক্ষিত হয়। গণমাধ্যম সূত্রমতে, ২৪ জুলাই পর্যন্ত দেশে রেমিট্যান্স আসে মাত্র ১৫০ কোটি ডলার। এর মধ্যে প্রথম ১৩ দিনে এসেছিল প্রায় ৯৮ কোটি এবং ১৪ থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত এসেছে প্রায় ৫৩ কোটি ডলার। ধারাবাহিকতায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণও কমতে থাকে।
বর্তমানে শান্তিতে নোবেলজয়ী বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার অধিষ্ঠিত। দেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হলে নতুন সরকারকে শক্তিশালী করতে প্রবাসীরা আরও বেশি রেমিট্যান্স পাঠানোর ঘোষণা দেয়। দেশ গঠনে বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানোর বিষয়ে অনেক প্রবাসী ক্যাম্পেইন শুরু করেন। ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ গণমাধ্যমে প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন মতে, গত অর্থবছরের তুলনায় এ অর্থবছরে রেমিট্যান্সে ৬০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। আবার জুলাই মাসের রেমিট্যান্স ১৯০ কোটি ডলার সঙ্গে আগস্টের ২২২ কোটি ডলার বিবেচনায় প্রবৃদ্ধি প্রায় ৯০ শতাংশ। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, চলতি সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম ১৪ দিনে প্রবাসী আয় এসেছে ১১৬ কোটি ৭২ লাখ মার্কিন ডলার। তন্মধ্যে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ৮১ কোটি ৬৯ লাখ, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলো এনেছে ২৯ কোটি ৭২ লাখ, বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ৪ কোটি ৯৯ লাখ এবং বিদেশি ব্যাংকগুলোতে এসেছে ৩০ লাখ ডলার। উল্লেখ্য যে, দেশের ইতিহাসে এক মাসে সর্বোচ্চ ২৬০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল ২০২০ সালের জুলাই মাসে। বছরওয়ারি হিসাবে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আসে ২০২০–২১ অর্থবছরে যার পরিমাণ ছিল ২৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৪৭৮ কোটি ডলার।
প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধি বাড়ায় বেড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। সরকারের গৃহীত কার্যকর উদ্যোগের ফলেও দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমাগত সম্মুখ ভাগে অগ্রসরমান। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মূখপাত্রের তথ্যানুসারে, বর্তমানে রিজার্ভ আছে ২ হাজার ৪৩০ কোটি ডলার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বিপিএম–৬ পদ্ধতিতে এর পরিমাণ ২ হাজার কোটি ডলারের কাছাকাছি। বর্তমান পরিস্থিতিতে রিজার্ভ কীভাবে আরও বাড়ানো যায় সে বিষয়ে দাতা সংস্থা ও উন্নয়ন সহযোগী রাষ্ট্র সমূহের দ্বারস্থ হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। এরই মধ্যে আইএমএফ’র সঙ্গে চলমান ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ প্রকল্পের বাকি কিস্তিগুলো সময়মতো ছাড় করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। পাশাপাশি বিশ্বব্যাংক, এডিবি এবং জাইকার কাছ থেকেও অতিরিক্ত ৩ বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা চাওয়া হয়েছে।
আশার বিষয় হচ্ছে, বিশ্বব্যাংক চলতি অর্থবছরের বাংলাদেশের জন্য ২০০ কোটি মার্কিন ডলারের নতুন অর্থায়নের ঘোষণা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি বন্ধ করেছে। একই সাথে রেমিট্যান্স বাড়াতে ক্রলিং পেগের ব্যান্ড ১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে আড়াই শতাংশ করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আশা, এতে রিজার্ভ আরও পৃদ্ধি পাবে। মোদ্দাকথা আমদানি খাতকে পরিপূর্ণ চলমান রেখে পণ্য সামগ্রী সরবরাহের স্বাভাবিকতা নিশ্চিত করা একান্তই জরুরী। বিশেষ করে জনগণের নিত্যদিনের প্রয়োজন মিটানোর লক্ষ্যে উৎপাদন ঘাটতি পূরণে পণ্য আমদানির বিকল্প নেই। জনদুর্ভোগ লাঘবে এক্ষেত্রে রিজার্ভ বৃদ্ধি ও যথার্থ খাতে এর বিনিয়োগ সমগ্র দেশবাসীকে উপকৃত করবেই।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়