বুলেটবিদ্ধ শিশু

নাসের রহমান | শুক্রবার , ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ at ৫:২৬ পূর্বাহ্ণ

আহাদের সময় কাটে সাবুর সাথে। সাবু কখন স্কুলে থেকে ফিরে আসবে অপেক্ষায় থাকে। স্কুলে যাওয়ার সময় সেও বায়না ধরে। সাবুর সাথে স্কুলে যেতে চায়। এখনো আহাদ স্কুলে ভর্তি হয়নি। জুনে চার বছরে পা দিয়েছে। বাবা মার ইচ্ছে আগামী বছরের শুরুতে স্কুলে দিবে। বাবা যে সকালে কাজে বের হয়ে যায় রাতে ফিরে আসে। আহাদ বাবাকে একেবারে কাছে পায় না। মা ছোট বোনটিকে নিয়ে থাকে। আহাদকে আর সময় দিতে পারে না। সে দাদীর কাছে থাকে। দাদী তার সব আবদার পূরণ করতে পারে না। এটা সেটা বলে ভোলাতে চায়। কিন্তু নাতির মন ফেরাতে পারে না। দশ টাকার বায়না তার আর শেষ হয় না। প্রতিদিন দশ টাকার একটা নোট দিতে হয়। এ নোটটা সে ভাল করে চিনে। অন্য কোনো নোট দিলে নেয় না। দাদী পাঁচ টাকার নোট দিয়ে দেখে। ‘না এটা হবে না, এটাতো ছোট’ বলে নেয় না। আবার বিশ টাকার নোটও দিয়ে দেখেছে। ‘এটাতো বড়,এটা নিয়ে কি করব?’ দাদী বলে, এটা দিয়া দুইটা পাবে। নাতি মানে না, ‘দুইটার দরকার নাই, আমি একটাই নিবো’। দাদী খানিকটা বিরক্ত হয়। তার জন্য দশ টাকার নোট জোগাড় করে রাখতে হয়।

দশ টাকা পেয়ে আহাদ ঘর থেকে বের হয়। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যায়। রাস্তার পাশের দোকান থেকে দশ টাকার একটা চকলেট কিনে। চকলেটটা লম্বা, ঝলমলে রেপিং পেপার দিয়ে মোড়ানো। চকলেট নিয়ে সে আর দাঁড়ায় না। দাদী বেলকনিতে দাঁড়িয়ে তাকে দেখে। সে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আবার ঘরে চলে আসে। দাদীকে বলে, ‘দেখ কি এনেছি’। চকলেটটা দেখতে খুব সুন্দর দেখায়। সে দাদীকে খুলে দিতে বলে। দাদী এক পাশে একটু ছিঁড়ে দিয়ে তার হাতে দেয়। সে চুষে চুষে খুব মজা করে খেতে থাকে। দাদীর তখন খুব ভালো লাগে। নাতির দিকে চোখের পলক না ফেলে তাকিয়ে থাকে। দাদীর এরকম অপলক চাহনিতে আহাদও আনন্দ পায়। সে চকলেট চুষতে চুষতে বলে, ‘দাদী তুমি একটু খেয়ে দেখনা, ভারী মজা’। ‘তাতো বুঝতে পারছি, এতো মজা না হলে পাঁচ তলা থেকে নেমে কিনে এনে এতো আয়েশ করে চুষতে না’। সে এবার চকলেটটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘দাদী তুমি একটু মুখে দিয়ে দেখ’। ‘আমি যে মুখে পান দিয়েছি, পান খেলে আর কিছুর স্বাদ পাওয়া যায় না’। ‘তুমি শুধু শুধু পান খাও কেন?’ ‘তুমি যে চকলেট খাও’। ‘চকলেটতো অনেক মজা।’ এবার সে জানতে চায়, ‘দাদী পান কি মজা’? ‘তেমন মজা নেই, তবে পান না খেলে মুখের ভেতর কেমন যেন লাগে’। আহাদ দাদীর কথা ঠিক বুঝতে পারে না। দাদীর মুখ থেকে একবার পান খেয়ে দেখেছে। তার ঝাঁজ লেগেছে, এরপর থেকে আর মুখে দেয় না।

সাবু স্কুল থেকে ফিরে এলে আহাদের আনন্দ কে দেখে সে খুশীতে লাফাতে শুরু করে। ব্যাগ রাখার সময় দেয় না। স্কুলের ড্রেস না খুলে তাকে সময় দিতে হয়। তার এটা সেটা নানা কিছু শুনতে হয়। দাদীর সাথে কি করেছে, মা কি বলছে, ছোট বোনটি কেমন করেছে এসব বলতে চেষ্টা করে। কোনটাই ঠিকমতো বলতে পারে না। এদের ওপর তার অভিমানেরও শেষ নেই। এরা কেউ তার সাথে কথা বলে না। তার কথাও শুনে না। দাদী খানিকটা শুনলেও মার সাথে ঘরের কাজ করতে হয়। সাবু কথা শুনতে শুনতে কোন এক ফাঁকে ড্রেস বদলে নেয়। তাকে সহজে ফাঁকি দেয়া যায় না। ওয়াশ রুমে ঢুকে হাত মুখ ধুয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে তাকে নিয়ে খেতে বসে। খাওয়ার পরে সাবুকে আর দাঁড়াতে দেয় না। সে একটু বিশ্রাম নিতে চায়। কিন্তু আহাদের মন মানে না। বাইরে যাবার জন্য অস্থির হয়ে যায়। এমনিতে সে সিঁড়ি দিয়ে একা নামতে উঠতে পারে। এখন সাবুর হাত ছাড়ে না। বাইরে যাওয়ার আনন্দ আলাদা। বাইরে গেলে সাবু তার হাত ধরে রাখে। যেভাবে ছুটাছুটি করতে চায় আবার কোন দিকে ছুটে যায়। তবে কুকুরকে সে খুব ভয় পায়। কুকুর দেখলে সাবুর কোমর ঘেষে ঘেষে হাঁটে। কুকুরের লেজ কেন বাঁকা জানতে চায়। সাবু তেমন কিছু বলতে পারে না। শুধু বলে ‘এমনিতে’। কুকুরটি লেজ নেড়ে নেড়ে আহাদের দিকে তাকায়। সে বাম হাত নেড়ে বলে, ‘যাও যাও, আমার দিকে কি দেখছো।’ সাবু বলে, ‘তুমি ছোটাতো তাই তোমার দিকে তাকাচ্ছে।’ ‘আমি কি ওর বন্ধু নাকি’? ‘তুমি চাইলে বন্ধুও হতে পার’। ‘আমি কুকুরের বন্ধু হতে চাই না’। ‘কেন’? ‘আমার বন্ধুতো তুমি’। ‘আমিতো তোমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়। আর আমি তোমার চাচ্চু’। ‘চাচু হলে কি বন্ধু হওয়া যায় না’। সাবু মাথা নেড়ে সায় দেয়, ‘তা হওয়া যায়, মনের মিল থাকলে বন্ধু হওয়া যায়’। সে এবার জানতে চায়, ‘আচ্ছা কুকুরের কি মন আছে’? ‘মনতো সবার আছে, কুকুরের কেন থাকবে না’। ‘কুকুরতো ইচ্ছা মতো ঘুরতে পারে, যেখানে খুশি সেখানে চলে যেতে পারে’। ‘তা অবশ্য পারে। তবে এলাকা ছেড়ে কোথাও যেতে চায় না। ‘কেন যেতে চায় না’। ‘এলাকাটাকে সে নিজের মনে করে। আবার অন্য এলাকায় গেলে সেখানকার কুকুরেরা তাকে তাড়াতে পারে’। এসময় কুকুরটি আরেকটা কুকুর দেখে ঘেউ ঘেউ করে ওঠে। তখন আহাদ লাফ দিয়ে সাবুর কোলে উঠে গলা জড়িয়ে ধরে।

কয়েক দিন থেকে আহাদ বাইরে যেতে পারেনি। অনেকটা ঘরের ভেতর আটকে আছে। সাবুও স্কুলে যায়নি। স্কুলে ক্লাস হয় না। রাস্তায় মিছিল হয়। ছাত্রদের মিছিল। হঠাৎ করে পরিস্থতি কেমন যেন হয়ে গেল। সাবুকে আর এ কয়দিন স্কুলে যেতে দেয়নি। সেও ঘরে থাকে। বাইরে যেতে পারে না। সারাদিন ঘরে বসে থাকতে মন চায় না। জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। মাঝে মাঝে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। আহাদও তার সাথে সাথে থাকে। ব্যালকনি থেকে রাস্তাটা দেখা যায়। রাস্তায় লোকজনের চলাফেরা রিক্সা আর যানবনহনের ছুটে চলা আহাদের দেখতে ভাল লাগে। রিক্সার টুং টুং শব্দ আর গাড়ির হর্নের আওয়াজে সে একধরণের আনন্দ খুঁজে পায়। এ কয়দিন থেকে মানুষের ছুটাছুটি অনেক বেড়ে গিয়েছে। বড় রাস্তা দিয়ে ছাত্রদের মিছিল যায়। অনেক বড় মিছিল। মিছিল শেষ হয় না। কলেজ ভাসির্টির ছাত্ররা শ্লোগানে শ্লোগানে চারিদিক মুখরিত করে তুলছে। সব ছাত্র যেন রাস্তায় নেমে এসেছে। দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তারা নাকি ঘরে ফিরে যাবে না। এরা কোটা সংস্কারের আন্দোলনে নেমেছে। এসবের কিছুই বুঝে না সাবু। তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে। ছাত্রদের মিছিল দেখে, ছোটাছুটি দেখে, দৌড়াদৌড়ি দেখে। পরিস্থিতি অন্যরকম হয়ে যায়। হঠাৎ গুলির শব্দ শোনা যায়। সাবু আহাদকে নিয়ে তাড়াতাড়ি ঘরের ভেতর চলে আসে। গোলাগুলির শব্দ আর থামে না। কিছুক্ষণ পরপর বিকট আওয়াজ হয় যেন পুরো এলাকা কেঁপে ওঠে। এরা ভয় পেয়ে যায়। ঘরের ভেতর চুপচাপ বসে থাকে।

পরের দিন সকাল থেকে ছাত্রছাত্রীরা রাস্তার ওপর জড়ো হতে থাকে। ভেতরের অলিগলি পথ ধরে ছাত্ররা মেইন রোডের দিকে আসতে থাকে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে ছাত্রদের ভিড়ও বেড়ে যায়। রাস্তায় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ছাত্রদের অনেকের হাতে লাঠিসোটা। গতকাল গুলিতে অনেক ছাত্র মারা গেছে। এরপর থেকে তারা বিক্ষুদ্ধ হয়ে পড়েছে। এতদিন যারা রাস্তায় নামেনি, তারাও নেমে এসেছে। সাথে কারো কারো বাবা মাও। ছেলেরা রাস্তায় মারা যাচ্ছে। বাবা মা তো আর ঘরে বসে থাকতে পারে না। দুপুর হতে না হতে মেইন রোড, আশেপাশের রাস্তা আর গলিপথ ছাত্রজনতার পদভারে কম্পিত হতে থাকে। রাজপথের স্লোগান গলিপথে এসে ধ্বনি প্রতিধ্বনি তোলে। ঘরের ভেতর থেকেও সাবুর মুখ থেকে প্রতিধ্বনি বেরিয়ে আসে। সাথে সাথে আহাদও সুর মিলায়। ভয়ভীতি কোথায় যেন উড়ে যায়। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দুজনে স্লোগানের তালে তালে ভেসে বেড়ায়। কিছুক্ষণের মধ্যে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। আকাশে হেলিক্যাপ্টারের আনাগোনা দেয়া যায়। মাঝেমধ্যে হেলিকাপ্টার বহুতল ভবনের ঠিক ওপর দিয়ে যেন উড়ে চলে যায়। পুরো জায়গাটা টিয়ার গ্যাসে ধোঁয়াটে হয়ে যায়। জলকামানের পানির স্রোত কাউকে যেন সরাতে পারে না। বৃষ্টির মতো রবার বুলেট এসে পড়তে থাকে। এতক্ষনের স্লোগানের শব্দটা গুলির শব্দের ভেতর হারিয়ে যায়।

এরা ব্যালকনিতে না থেকে ঘরের ভেতরে এসে জানালার কাছে দাঁড়ায়। আহাদ নিচে থেকে দেখতে পায় না। সে বিছানার ওপর ওঠে দাঁড়ায়। রবার বুলেট কখন মানুষ মারার বুলেট হয়ে যায় কেউ টের পায় না। কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন জায়গাটিতে বিকট শব্দ হতে থাকে। সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দে চারিদিক কেঁপে উঠে। ছাত্র জনতা এ শব্দকে উপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে থাকে। এরপর বুলেটের পর বুলেট আসতে থাকে। কারো বক্ষ বিদীর্ন করে চলে যায়। কারো বাহু বিচ্ছিন্ন করে ফেলে, কারো পা যুগল ছিন্ন ভিন্ন করে দেয়। আবার কারো মাথার খুলি উড়িয়ে নেয়। তারপরও বুলেট থামে না। দূর থেকে বুলেট আসে, কাছ থেকে বুলেট আসে। পেছন থেকে আসে, সামনে থেকে বুলেট আসতে থাকে। আকাশ থেকেও বৃষ্টির মত বুলেট ঝরে পড়ে। এতক্ষণ বুলেট রাস্তায় পড়েছে, জনস্রোতে পড়েছে, বাড়ির ছাদের ওপর পড়েছে। বুলেট এবার জানালার কাচ ভেদ করে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে। সাবুর কাঁধের ওপর দিয়ে ঘাতক বুলেট আহাদের ছোট্ট মাথাটির খুলি উড়িয়ে নিয়ে যায়, তৎক্ষনাৎ শিশু আহাদ বিছানায় লুটিয়ে পড়ে। সাবু মুহুর্তের মধ্যে কি হয়ে গেল বুঝে উঠতে পারে না। তার কাঁধ থেকে রক্ত ঝরে পড়ে। মা আর দাদী হতবাক হয়ে যায়। খানিক বাকরুদ্ধ হয়ে থাকে। হঠাৎ মা হাউমাউ করে চিৎকার করে ওঠে। সাথে সাথে দাদীও উচ্চস্বরে বিলাপ করতে থাকে। এদের কান্নার রোল গুলি থামাতে পারে না। এমনকি শিশু আহাদের মর্মান্তিক মৃত্যুও। এরপরও গুলি ছাত্রদের বুক বিদীর্ণ করে শিশু কিশোরদের মাথা ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে যায়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিএনপির সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ান হাই কমিশনের প্রতিনিধি দলের বৈঠক
পরবর্তী নিবন্ধজ্ঞানতাপস যোগেশ চন্দ্র সিংহ এবং তাঁর রাবীন্দ্রিক ভাবনা