ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে চোর সন্দেহে তোফাজ্জল হোসেন নামে মানসিক ভারসাম্যহীন এক যুবককে পিটিয়ে হত্যার পর ছয় ছাত্রকে পুলিশে দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এর আগে বৃহস্পতিবার দুপুরে শাহবাগ থানায় বিশ্ববিদ্যালয়ের এস্টেট অফিসের সুপারভাইজার মোহাম্মদ আমানুল্লাহ বাদী হয়ে এ ঘটনায় একটি মামলা দায়ের করেন।
এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম সিন্ডিকেটের জরুরি সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র, শিক্ষক ও কর্মকর্তা–কর্মচারীদের সব ধরনের দলীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। খবর বিডিনিউজের।
জানা যায়, নিহত তোফাজ্জলের বাড়ি বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলার কাঁঠালতলি ইউনিয়নে। বরিশাল বিএম কলেজ থেকে হিসাব বিজ্ঞানে মাস্টার্স করলেও মানসিক সমস্যার কারণে তিনি কোনো কাজকর্ম করছিলেন না। গত ৩–৪ বছর ধরে তার এই মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। এরপর থেকে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ভবঘুরের মত বেড়াতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশেও থাকতেন অনেক সময়।
তাকে মারধর ও হত্যার অভিযোগে গতকাল রাত ১২টা পর্যন্ত আটক ৬ ঢাবি ছাত্র হলেন, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের জালাল আহমেদ, মৃত্তিকা পানি ও পরিবেশ বিভাগের মোহাম্মদ সুমন, পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের মোত্তাকিন সাকিন, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের আল হোসেন সাজ্জাদ, গণিত বিভাগের আহসান উল্লাহ এবং ওয়াজিবুল আলম। তাদেরকে হেফাজতে নেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন শাহবাগ থানার এসআই আল আমীন।
মামলার এজাহারে বাদী উল্লেখ করেছেন, ১৮ সেপ্টেম্বর রাত পৌনে ৮টার সময় একজন যুবক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের গেটে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরা করছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র তাকে আটক করে প্রথমে ফজলুল হক মুসলিম হলের মূল ভবনের গেস্ট রুমে নিয়ে যান। মোবাইল চুরির অভিযোগ করে তারা তাকে এলোপাতাড়ি চড়–থাপ্পড় ও কিলঘুষি মারেন।
এ সময় পিটুনির শিকার যুবক নিজের নাম তোফাজ্জাল বলে জানান। তিনি মানসিক রোগী বুঝতে পেরে তাকে হলের ক্যান্টিনে নিয়ে খাবার খাওয়ান। পরে তাকে হলের দক্ষিণ ভবনের গেস্টরুমে নিয়ে জানলার সঙ্গে হাত বেঁধে স্ট্যাম্প, হকিস্টিক ও লাঠি দিয়ে বেধরক মারধর করলে তিনি অচেতন হয়ে পড়েন।
বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন আবাসিক শিক্ষককে জানানো হলে তাদের সহায়তায় অচেতন তোফাজ্জলকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক রাত পৌনে ১টার সময় তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এই ঘটনার তদন্তে ফজলুল হক মুসলিম হলের আবাসিক শিক্ষক অধ্যাপক আলমগীর কবীরকে আহ্বায়ক করে ৭ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে হল কর্তৃপক্ষ। বৃহস্পতিবার সকালে গঠন করা এই কমিটিকে সন্ধ্যার মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে অনুরোধ করা হয়।
তোফাজ্জলকে হত্যার ঘটনাটি অনাকাক্সিক্ষত উল্লেখ করে দুঃখ প্রকাশ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সংঘটিত অমানবিক ও অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাটির জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দুঃখিত ও মর্মাহত। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দ্রুততার সঙ্গে প্রয়োজনীয় আইনগত ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ক্যাম্পাসের মধ্যে এ ধরনের ঘটনা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যাবে না। কেউ চুরি করতে আসলেও তাকে পিটিয়ে হত্যার অধিকার কারও নেই। ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ দেখে দায়ীদের শনাক্তের চেষ্টা করা হচ্ছে।
উপাচার্য নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, এ ঘটনাটি আমরা ন্যায্যতার সাথে সমাধান করার চেষ্টা করছি।
দলীয় রাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্ত : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র, শিক্ষক ও কর্মকর্তা–কর্মচারীদের সব ধরনের দলীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত কার্যকর থাকবে বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুই সিন্ডিকেট সদস্য। তাদের একজন বলেন, জরুরি সিন্ডিকেট সভায় কেবল ক্যাম্পাসে রাজনীতি নিষিদ্ধের এজেন্ডাই ছিল। আলোচনার পর ক্যাম্পাসের ভেতরে পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত ছাত্র–শিক্ষক–কর্মকর্তা–কর্মচারীদের সকল প্রকার রাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত হয়।
সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানোর কথা বলেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মুখপাত্র ও উপ–উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা। তিনি বলেন, সভায় সার্বিক বিষয় নিয়ে সিন্ডিকেট সদস্যরা তাদের বিস্তারিত মতামত দিয়েছেন। সেই আলোকে আমরা একটা সিদ্ধান্ত পৌঁছেছি, যা একটি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আমরা বিস্তারিত প্রকাশ করব। তবে সিদ্ধান্তটা কি, সে বিষয়ে প্রশ্নের উত্তর দেননি তিনি।