পাখির পালক ভাসে জলের উঠোনে
পাহাড়ের কথাগুলো বৃক্ষরা শোনে
সবুজের বুকে মেশে আকাশের নীল
রুপোর কণার মতো সব অনাবিল।
কী স্বর্গ! নিসর্গ খাই আর হাঁটি
হরিৎ টিয়ের মতো হাসে রাঙামাটি।
বাংলাদেশের এক দশমাংশ জুড়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম। পার্বত্য চট্টগ্রামের ‘রাজধানী’ বলা হয়ে থাকে রাঙামাটি জেলাকে। দেশের দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলের এই পাহাড়ি জেলাটির পর্যটন শিল্প গড়ে উঠেছে বিশেষত পাহাড় ও কাপ্তাই হ্রদ কেন্দ্রিক। রাঙামাটি জেলার পর্যটনকে সমৃদ্ধ করেছে বিশালাকার জলাশয়ের কাপ্তাই হ্রদ। পার্শ্ববর্তী পার্বত্য জেলা বান্দরবান–খাগড়াছড়িও উঁচু উঁচু পাহাড় ঘেরা হলেও একমাত্র রাঙামাটিই হলো জল, মেঘ–পাহাড় শৃঙ্খের মিতালির জেলা। বিস্তীর্ণ জলাধার কাপ্তাই হ্রদকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে এই জেলার ছোট–বড় পর্যটন ও বিনোদনকেন্দ্র। হ্রদকেন্দ্রিক যাতায়াত এখনো এ জেলার প্রান্তিকতা ধরে রেখেছে বিগত ছয় দশকের বেশি সময় ধরে। রাঙামাটিকে অনেকে বলে থাকেন হ্রদের জেলা।
’৪৭–এ দেশভাগের পর তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানের পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলায় জল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিল ষাটের দশকে। তখন পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার কাপ্তাইয়ে খরস্রোতা কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দেওয়ার ফলে বিস্তৃত এলাকাজুড়ে সৃষ্টি হয় প্রায় ৭২৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের কাপ্তাই হ্রদ। কৃত্রিম হ্রদ বলা হলেও এটি মানুষের খনন করা কোনো হ্রদ নয়। বিস্তীর্ণ জনভূমি, পাহাড়, বন জঙ্গল পানিতে তলিয়ে এই হ্রদের সৃষ্টির কারণে এটিকে বলা হয় কৃত্রিম হ্রদ। বিদ্যুৎ উৎপাদন ছাড়াও হ্রদ সৃষ্টির দরুন রাঙামাটি জেলায় কাপ্তাই হ্রদ পরিণত হয়েছে মৎস্য ভান্ডারে। রাঙামাটির পর্যটন এগিয়েছে হ্রদকে ঘিরে। তবে জেলা শহরের সঙ্গে অন্যান্য উপজেলার দুর্গমতার কারণও বিশাল জলরাশির হ্রদই।
মানুষের কাছে দেশের পর্যটনে আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্র রাঙামাটির পর্যটন। ভৌগোলিক ও আয়তনের দিক থেকে দেশের সবচেয়ে বড় জেলা রাঙামাটির বাঘাইছড়িতেই অবস্থিত সাজেক ভ্যালি উপত্যকা। এছাড়া ‘সিম্বল অব রাঙামাটি’ হিসেবে সুখ্যাতি পাওয়া ঝুলন্ত সেতু রাঙামাটির অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। রয়েছে সুবলং জলপ্রপাত বা ঝর্ণা, বিলাইছড়ির ধুমপানিসহ নাম জানা না–জানা ছোট–বড় অনেক গিরি নির্ঝর। তবুও এত কিছুর পরও পাহাড়ি এই জেলায় পর্যটকদের ‘আশানুরূপ’ আগমন না ঘটা নিয়ে হতাশা পর্যটন খাতসংশ্লিষ্টদের মনে। প্রকৃতি তার পুরো রূপ–লাবণ্য রাঙামাটিকে ছড়িয়ে দিলেও এখানকার পর্যটনে সরকারি বা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা নেই বললেই চলে। ব্যক্তিগত উদ্যোগ নির্ভর হয়ে ছোট পরিসরে বাড়ছে এই জেলার পর্যটনশিল্পের পরিসর। সরকারি প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক কয়েকটি পর্যটন ও বিনোদনকেন্দ্র গড়ে উঠলেও যা থেকে রাঙামাটির খাতসংশ্লিষ্টতার উদ্যোগ পিছিয়ে রয়েছে। মূলত পুঁজি সংকট, ব্যাংক ঋণ পেতে জটিলতাসহ বড় আর্থিক উৎসের অভাবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে পর্যটনের প্রসারে প্রধান প্রতিবন্ধকতা। এছাড়া পাহাড়ে ‘নিরাপত্তাজনিত’ কারণে বিদেশী পর্যটক আসার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার কারণে বিদেশী পর্যটক নেই বললেই চলে। বিদেশী পর্যটক টানতে এশিয়ার দেশ মালদ্বীপ, নেপাল, ভুটান, ভারত, শ্রীশঙ্কাসহ আশ–পাশের দেশগুলোর মতো বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলে নিরাপত্তাজনিত বিষয় ছাড়াও চাহিদা উপযোগি ‘বিশেষ’ কোনো উদ্যোগ নেই। নেই প্রতিবন্ধকতা নিরসনে ভাবনা–গবেষণাও।
পার্বত্য এলাকায় ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি তথা শান্তি চুক্তি সম্পাদনের পরই অনেকটা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি শুরু হওয়ার পর থেকে পাহাড় কেন্দ্রিক পর্যটন শিল্পের উদ্ভব ঘটা শুরু করে। এর আগে ভ্রমণকারীদের নিরাপত্তা ইস্যুসহ নানান প্রতিকূল পরিবেশের কারণে পাহাড়ে পর্যটন শিল্পের আর্বিভাব ঘটেনি। চুক্তি স্বাক্ষরের পর পাহাড়ের পরিস্থিতি অনেকটা স্থিতিশীলতার মধ্যে ফেরার এখানে পর্যটনে নতুন মাত্রা শুরু হয়েছে হ্রদনির্ভর একটি রেস্টুরেন্ট ঘিরে। রাঙামাটিতে কাপ্তাই হ্রদের মাঝখানে এক ছোট চরে ব্যক্তি পর্যায়ে ‘পেদা টিং টিং’ নামক একটি রেস্টুরেন্ট গড়ে তোলেন রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান গৌতম দেওয়ান। এরপর বিগত আড়াই দশকে গড়ে উঠেছে এমন রেস্টুরেন্ট নির্ভর অনেক পর্যটনকেন্দ্র। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য অনেক রেষ্টুরেন্টকেন্দ্রিক উদ্যোগ পেদা টিং টিংয়ের জনপ্রিয়তাকে ছাড়িয়ে গেছে।
রাঙামাটি শহরের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে যাতায়াতের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে নৌ–পথে ভ্রমণ। রাঙামাটি জেলা শহরে অবস্থিত পর্যটন করপোরেশনের ঝুলন্ত সেতু, পর্যটন মোটেল, নীলাঞ্জনা বোট ক্লাব, পলওয়েল পার্ক, ডিসি বাংলো পার্ক, বনরূপা সমতাঘাটের ভাসমান মৌসুমি ফলের বাগান, গাঙ সাবারাঙ, রঙ রাং, চাকমা রাজবাড়ি, রাজবন বিহার, রাঙাদ্বীপ, আরণ্যক, হিল তাজমহল, ভিভাইন লেক আইল্যান্ডসহ শহর এলাকায় অবস্থিত প্রায় সব পর্যটনকেন্দ্রে নৌ–পথে যাতায়াত করা সহজলভ্য। এছাড়া বরকল উপজেলায় অবস্থিত সুবলং ঝর্না, বিভিন্ন আদিবাসী বা পাহাড়ি গ্রাম, সুবলং বাজার, কাপ্তাই–আসামবস্তি সড়কে বিনোদনকেন্দ্র বার্গী লেকভ্যালি, বেরান্নে, বড়গাঙ, ইজোর, জুমকিং, রাইন্যা টুগুন ইকো রিসোর্টসহ কাপ্তাই হ্রদের মাঝে কিংবা ঘেঁষে গড়ে ওঠা রেস্টুরেন্ট, রিসোর্ট–কটেজ, পর্যটন ও বিনোদন কেন্দ্রে হ্রদ ভ্রমণ করে ঘুরে বেড়ানো যায় সহজেই। হ্রদকেন্দ্রিক ঘুরে বেড়ানোর রয়েছে প্রায় দুই শতাধিক ট্যুরিস্ট বোটও। এছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নতুন করে যুক্ত হয়েছে হাউজবোট। রাঙামাটি শহরকেন্দ্রিক প্রায় ১৫–২০টি হাউজবোট পর্যটকদের বুকে নিয়ে চষে বেড়ায় কাপ্তাই হ্রদে। সুবিধা আছে হ্রদের সবুজের হাউজবোটে রাত্রিযাপনেরও।
গ্রীষ্মকালীন সময়ে রাঙামাটির হাটবাজারগুলোতে সুবাস ছড়ায় পাহাড়ে উৎপাদিত মৌসুমি ফল। এছাড়া রাঙামাটি সবচেয়ে বড় ও ভাসমান মৌসুমি ফলের হাট রাঙামাটি জেলা শহরের সমতাঘাটে। এখানে জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে পাহাড়ের কৃষকরা মৌসুমি ফল নৌ–যান করে সমতাঘাটে বিক্রির জন্য নিয়ে আসেন। একই ভাবে লংগদু উপজেলার মাইনিমুখ বাজার, কাপ্তাইয়ের জেটিঘাট পরিণত হয় মৌসুমি ফলের ভাসমান আড়তে। গ্রীষ্মকালীন এই সময়টাতে পর্যটকরা ঘুরে বেড়ান পাহাড়ের এই মৌসুমি ফলের হাটগুলোতেও।
দশ উপজেলা নিয়ে গঠিত দেশের সবচেয়ে বড় জেলা রাঙামাটির কয়েকটি উপজেলায় সড়ক পথে যোগাযোগ করা যায় না। জেলার বরকল ও জুরাছড়ি এখনো সড়ক পথে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। রাঙামাটির সুন্দরতম একটি উপজেলা হলো জুরাছড়ি। জুরাছড়ির পাহাড়ি জনপদ রাঙামাটিতে বেড়াতে আসা পর্যটকদের জন্য ভ্রমণে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে নির্মোহ করে তুলবে। বিলাইছড়ি দুর্গম ফারুয়ায় ধুমপানি ঝর্ণা চোখ চক্ষুর আড়াল থেকে পর্যটকদের কাছে পরিচিত হওয়ার পর এটি দেশের মানুষের কাছে অত্যন্ত পছন্দের পর্যটন হিসেবে স্থান পেয়েছে। যদিও কেবলমাত্র বর্ষা মৌসুমের আগ–পরের সময়কেন্দ্রিক ধুমপানি ঝর্নাটি পর্যটকদের আনাগোনা থাকে। পাহাড়ের প্রত্যন্ত জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি ও বরকল উপজেলায় পর্যটকদের নিরাপদ আশ্রয়, থাকার উপযোগী ব্যবস্থা গড়ে না উঠায় এইসব প্রান্তিক উপজেলাগুলোতে পর্যটনের ছোয়া এখনো লাগেনি। তবে স্থানীয় আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে যদি ইকো–ট্যুরিজমের আওতায় আনা যেতে পারে সেজন্য পাহাড়ের মানুষ পর্যটনের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবেন এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠী পর্যটনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হলে এটি হবে টেকসই ও পরিবেশবান্ধব পর্যটন। কিন্তু ব্যক্তি পর্যায়ে বাণিজ্যিকভাবে পর্যটন গড়ে উঠার ফলে পাহাড়ের মূল স্রোতের মানুষ পর্যটনের অর্থনীতি থেকে দূরেই রয়ে গেছেন।
পর্যটনের জেলা রাঙামাটিতে বেড়াতে আসা ভ্রমণপিপাসুদের এখন গন্তব্যের অন্যতম কেন্দ্র আসামবস্তি–কাপ্তাই সংযোগ সড়কটি। প্রায় ১৮ কিলোমিটারের এই সড়কের একপাশ জুড়ে কাপ্তাই হ্রদ আরেকদিকে আছে সবুজে ঘেরা ঘন পাহাড়। পাহাড়ের বুক চিরে চলা আঁকাবাঁকা পিচঢালা সড়কের আশ ঘেঁষে গড়ে উঠেছে রেস্টুরেন্ট, কটেজ–রিসোর্ট। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই সড়কটি প্রশস্তকরণের ফলে পর্যটকদের আকর্ষণ আরও বাড়তে থাকায় শহরের পাশেই বিভিন্ন স্থাপনা বাড়ছে। এসব স্থাপনা অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠলে এই সড়কের সৌন্দর্য ম্লান হয়ে যাবে। যেন সাজেক ভ্যালির মতো ঘিঞ্জি পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত না হয় তা নিয়ে ভাবতে হবে। পাশাপাশি স্থানীয় কমিউনিটিকে ট্যুরিজম সেক্টরের মূল উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারা গেলে রাঙামাটির হ্রদ–পাহাড় কেন্দ্রিক পর্যটনের বিকাশ ঘটবেই।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক