বাংলাদেশে জুলাইয়ের ছাত্র–অভ্যুত্থানের সাথে গ্রাফিতি বা দেয়ালচিত্র ব্যাপক পরিচিত লাভ করে। প্রত্যেকটা শহরের গলি থেকে রাজপথের দেয়াল অঙ্কিত হয় আন্দোলনের বিভিন্ন অধ্যায়। প্রায় প্রতিটা শহরে শিক্ষার্থীদের সাথে সাধারণ লোকজন গ্রাফিতি কিংবা দেয়ালচিত্রে অঙ্কনে অংশ নেয়। এমনকি গ্রামও এর বাইরে ছিল না। প্রতিবাদের অন্যতম ভাষা এই গ্রাফিতি, আন্দোলন–সংগ্রামে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।
গ্রাফিতির রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। অ্যানসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটেনিকা বলছে, গ্রাফিতি হচ্ছে ভিজ্যুয়াল যোগাযোগের ফর্ম। সাধারণত বেআইনি, কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী দ্বারা সর্বজনীন স্থানের অননুমোদিত চিহ্নিতকরণ জড়িত। যদিও গ্রাফিতির সাধারণ চিত্রটি একটি স্টাইলিস্টিক প্রতীক বা শব্দগুচ্ছ একটি রাস্তার একজন সদস্যের দেয়ালে স্প্রে–অঙ্কিত। তবে এটি একটি অভিব্যক্তিপূর্ণ শিল্প ফর্ম হিসেবেও বোঝা যায়।
ইতালীয় শব্দ গ্রাফিও (স্ক্র্যাচ) থেকে উদ্ভূত, গ্রাফিতি (ছেঁড়া শিলালিপি, বহুবচন কিন্তু প্রায়শই একবচনে ব্যবহৃত হয়) এর একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। প্রাচীন রোমান ধ্বংসাবশেষে, মধ্য আমেরিকার মায়ান শহর টিকালের ধ্বংসাবশেষে, ষোড়শ শতকের স্পেনের পাথরে এবং মধ্যযুগীয় ইংরেজ গির্জাগুলিতে চিহ্নগুলি পাওয়া গেছে। বিংশ শতাব্দীতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপে গ্রাফিতিগুলি সংঘবদ্ধ দলের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিল, যারা এটিকে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছিল। অঞ্চল সনাক্তকরণ বা দাবি করার জন্য, মৃত দলীয় সদস্যদের একটি অনানুষ্ঠানিক স্মৃতিচারণ করার জন্য, কাজ সম্পর্কে গর্ব করার জন্য, দলের সদস্যদের দ্বারা সংঘটিত এবং হিংসাত্মক সংঘর্ষের ভূমিকা হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বী দল বা গোষ্ঠীকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য। বিশ্বের প্রধান নগর কেন্দ্রগুলিতে বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপে গ্রাফিতির সাধারণ লক্ষ্য ছিল– সাবওয়ে, বিলবোর্ড এবং দেয়াল। ১৯৯০ এর দশকে গ্রাফিতির একটি নতুন রূপ আবির্ভূত হয়েছিল, যা ট্যাগিং, যা অঞ্চল চিহ্নিত করার জন্য একটি একক চিহ্ন বা চিহ্নের সিরিজের বারবার ব্যবহার করে। সর্বাধিক মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য, এই ধরনের গ্রাফিতি সাধারণত কৌশলগতভাবে বা কেন্দ্রীয়ভাবে অবস্থিত আশেপাশে প্রদর্শিত হয়।
অনেকের কাছে গ্রাফিতি হল পাবলিক আর্টের একটি রূপ, যা ঐতিহ্যকে অব্যাহত রাখে। যেমন–মহামন্দার সময় মার্কিন ওয়ার্কস প্রোগ্রেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ফেডারেল আর্ট প্রজেক্ট এবং মেক্সিকোতে ডিয়েগো রিভারার কাজের ম্যুরালগুলি। এই শিল্পীদের ম্যুরালগুলির মতো, গ্রাফিতির দুর্দান্ত কাজগুলি একটি প্রতিবেশীকে সুন্দর করতে পারে এবং একটি নির্দিষ্ট সমপ্রদায়ের স্বার্থের কথা বলতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক হিস্পানিক পাড়ায় গ্রাফিতি বেশ বিস্তৃত এবং অনেকে এটিকে শহুরে শিল্পের একটি রূপ হিসাবে বিবেচনা করে।
গ্রাফিতি আরো পরিচিতি লাভ করে বিংশ শতকের শেষের দিকে নিউইয়র্ক সিটিতে। ভবনের দেয়াল এবং পাতাল রেলে স্প্রে পেইন্ট দিয়ে তৈরি বড় বিস্তৃত বহু রঙের গ্রাফিতি শহুরে ল্যান্ডস্কেপকে সংজ্ঞায়িত করতে এসেছে। ঐতিহ্যবাহী গ্যালারি চ্যানেলের বাইরে কাজ করা শিল্পীদের প্রতি শিল্প জগতের মুগ্ধতা এই ধরনের আত্ম–প্রকাশের প্রতি আগ্রহকে উদ্দীপিত করে। ১৯৮০ এর দশকে নিউইয়র্কের শিল্পীরা যেমন কিথ হারিং এবং জিন–মিশেল বাস্কিয়েট তাদের গ্রাফিতির জন্য খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। আশি ও নব্বই দশকে সিঙ্গাপুরসহ কয়েকটি দেশে পরিচ্ছন্নতার নামে গ্রাফিতি নির্মূলের প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল।
বাংলদেশে গ্রাফিতি নতুন নয়। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে শুরু করে পরবর্তীতে যে কোনো আন্দোলনে পোস্টার, দেয়াল লিখনের মতো বর্তমান সময়ে গ্রাফিতি হয়ে উঠেছে আন্দোলনের অন্যতম অনুষঙ্গ। শিল্পীরা বলছেন, দেয়ালে যা কিছু উপস্থাপিত হয়, তা আকর্ষণ করে বেশি, ফলে এটি সবসময়ই ছিল। ২০১৭ সালে হঠাৎ ‘সুবোধ’ নামে একটি চরিত্রের মধ্য দিয়ে বাংলাদশে গ্রাফিতি ব্যাপক পরিচিতি পায়। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলের সামনে ‘শামসুন্নাহার হল নির্যাতন’ উপলক্ষে ড্রাগন গ্রাফিতি, সুন্দরবন রক্ষা আন্দোলনের সময় কিছু বার্তা নিয়ে করা দেয়ালচিত্র, আর হালে নিজেদের আবাসের অধিকার নিয়ে করা গ্রাফিতিসহ একের পর এক দেখা যায়। গ্রাফিতি কী বলতে গিয়ে শিল্পীরা বলছেন, জনসাধারণের অভিমতকে শিল্পী যখন দেয়ালে হাজির করেন এবং বিশেষ পদ্ধতিতে তা উপস্থাপন করেন।
গ্রাফিতি আন্দোলন–বিপ্লবের সঙ্গে জড়িত হবে, বিষয়টি তেমনও না। তবে এই শিল্পকর্মগুলোর মূল উপজীব্য সমসাময়িক বিভিন্ন রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক ঘটনা। প্রাচীন মিসর, গ্রিস ও রোমান সাম্রাজ্যেও এর নিদর্শন পাওয়া যায়। দেয়ালের শক্তি হলো চট করে দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম। একাত্তরে কামরুল হাসান থেকে শুরু করে নব্বইয়ের গণ–আন্দোলন ও সমপ্রতি পরপর বেশকিছু আন্দোলনে এর দেখা মেলে। সুবোধ গ্রাফিতি বেশ পরিচিতি লাভ করেছে বাংলাদেশে। এখন চিকার (দেয়াল লিখন) স্থান করে নিয়েছে গ্রাফিতি।
জার্মান গ্রাফিতি শিল্পী লুকাস চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেনের চেহারা পাল্টে দিয়েছেন। সব বগি চিত্রকর্মে রঙিন হয়ে ওঠে। তুলির আঁচড়ে মূর্ত হয়ে উঠেছে বাংলার চিরায়ত সৌন্দর্য। একসময় বিবর্ণ শাটলের ভিন্ন এই রূপ নজর কাড়ছে সবার। ব্যতিক্রমী শিল্পকর্মে মুগ্ধ শিক্ষার্থীরাও। লুকাসকে সহায়তা করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষক–শিক্ষার্থীরা। ১৯৮০ সালে চালু হওয়া শাটল ট্রেনে প্রতিদিন শহর থেকে ক্যাম্পাসে আসা যাওয়া করে অন্তত ১৫ হাজার শিক্ষার্থী।
ছাত্র–জনতার গণ–অভুত্থান গ্রাফিতি শিল্পে ভিন্ন দ্যোতনা এনে দিয়েছে। ‘বুকের ভিতর দারুণ ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’, ‘পানি লাগবে পানি’, ‘আমিই বাংলাদেশ’–এরকম স্লোগানে চিত্রসহ ভেসে ওঠে বাংলাদেশের প্রতিটি দেয়াল। গ্রাফিতিতে ফুটে উঠেছে স্বাধীনতার কথা, স্বীয় অধিকারের কথা, রাষ্ট্র সংস্কারের কথা, ফ্যাসিস্ট ও দুর্নীতিবাজদের রুখে দেয়ার কথা। যুগে যুগে গ্রাফিতি আন্দোলন–সংগ্রামকে বেগবান করে তুলতে সক্ষম হয়েছে।