যথাযোগ্য মর্যাদা এবং ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে গত সোমবার উদযাপিত হয়েছে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.)। এ উপলক্ষে আন্জুমান এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট ও গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনায় চট্টগ্রামে সম্পন্ন হলো বিশ্বের সর্ববৃহৎ জশনে জুলুস। ওইদিন ভোর থেকে উৎসবে রূপ নেয় চট্টগ্রামের জশনে জুলুস। আগেরদিন রাত থেকেও বহু ধর্মপ্রাণ মুসলমান অবস্থান নেয় জামেয়া এলাকায়। সকাল ৯টায় ষোলশহর আলমগীর খানকাহ্ শরীফ থেকে বের হয়ে এই জুলুস নগরীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কসমূহ প্রদক্ষিণ করে দুপুর দেড়টায় ষোলশহর জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া কামিল মাদ্রাসা ময়দানে এসে বিশাল মাহফিলে মিলাদ–কিয়াম ও মুনাজাতের মাধ্যমে শেষ হয়। এবারের জশ্নে জুলুসটি ছিল আনজুমান ট্রাস্টের ৫২তম আয়োজন। ১৯৭৪ সালে বলুয়ারদীঘি খানকাহ্ শরীফ থেকে ছিল এর সূচনা। ৫২তম বর্ষে এবারের জুলুসে যোগদান করেছে অন্তত ৬০ থেকে ৭০ লাখ মানুষ। এবারের জুলুসে নেতৃত্বে দেন আওলাদে রাসুল রাহনুমায়ে শরীয়ত ও তরিকত পীরে বাঙাল আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মম সাবির শাহ (মা.জি.আ.) ও শাহজাদা আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ কাসেম শাহ (মা.জি.আ.)।
জুলুস উপলক্ষে চট্টগ্রামের মানুষের মধ্যে ছিল বাড়তি উৎসাহ উদ্দীপনা। এ উপলক্ষে আগে থেকে সুসজ্জিত ও আলোকিত করা হয় নগরী। জশ্নে জুলুস বর্তমান সময়ে চট্টগ্রামসহ সারাদেশে আপামর জনতার উৎসবে রূপ নিয়েছে। ভোর হতে না হতেই শহরের অলি গলি হতে মাইকে নাতে রাসুলের (দ.) সমপ্রচার শুরু হয়। সুসজ্জিত গাড়িগুলো ষোলশহর জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া মাদ্রাসার দিকে ছুটছে। বিভিন্ন জেলা থেকেও জুলুসে যোগদানের জন্য গাড়ির বহর এসেছে। নগরের অসংখ্য স্পটে ছিল স্বতঃস্ফূর্ত সেবাদান কার্যক্রম। কেউ দিচ্ছিল শরবত, পানি বা কেউ দিচ্ছিল শুকনা খাবার, ফলমূল, বিরিয়ানির প্যাকেটসহ নানা কিছু। কেউ বিতরণ করছিল চকলেট, ঠাণ্ডা পানীয়, এমনকি টিস্যুও। চট্টগ্রামের এপোলো ইমপেরিয়াল হাসপাতাল, এভারকেয়ার হাসপাতালসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দিয়েছে চিকিৎসা সহায়তা। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কর্তৃপক্ষের ছিল নজিরবিহীন নিরাপত্তা সেবা। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনসহ বিভিন্ন সেবা সংস্থা নিজ নিজ অবয়বে জুলুসে অংশগ্রহণ করে। এককথায় বলা যায়, পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) এর জশ্নে জুলুস চট্টগ্রামে প্রধান উৎসবে রূপ নিয়েছে ওইদিন। বিশেষত জুলুসে অংশগ্রহণকারীদের সবার মুখে ছিল হামদ, না’ত, সালাতসালাম আর আল্লাহু আকবর এয়া রাসুলাল্লাহ্ (দ.) ধ্বনি। জুলুসে অংশগ্রহণকারীদের এই অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করতে শহরের দালান–কোটা, ফ্লাইওভার গুলোতে অসংখ্য মানুষ অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে দেখা যায়। তারা ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে অভিবাদন জানিয়েছেন জুলুস যাত্রী এবং এর নেতৃত্বদানকারী হুজুর কেবলা পীর সৈয়্যদ মুহাম্মদ সাবির শাহ্ ও শাহজাদা সৈয়্যদ মুহাম্মদ কাসেম শাহ্কে বহনকারী সুসজ্জিত গাড়িকে। যেহেতু, সকাল ৯টায় জুলুসটি বের হবার সময়েই সুন্নিয়া মাদ্রাসার সম্মুখস্থ উভয় ময়দান ছিল মুসল্লিতে পরিপূর্ণ, তাই জশ্নে জুলুসে অংশগ্রহণকারী লাখ লাখ মানুষ ময়দান পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি। সকাল ৯টার পরপরই একই সাথে হুজুর কেবলা সাবির শাহ্’র নেতৃত্বে চট্টগ্রাম শহরে জুলুস এবং জামেয়া ময়দানে চলতে থাকে দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমদের বক্তব্য। ওলামায়ে কেরাম বলেন, হযরত তৈয়্যব শাহ্ (রহ.) জশ্নে জুলুস দিয়ে ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবেদনকে যেমনি ঘরে ঘরে পৌঁছে দেন, ঠিক তেমনি গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশের মতো মানবিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশের মানুষকে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে পাশে থেকে নজিরবিহীন সেবা প্রদানের ব্যবস্থা করেছেন। জশ্নে জুলুসে পীর সাবির শাহ্কে বহনকারী গাড়িটি জোহরের সময়ে জামেয়া ময়দানে এসে পৌঁছালে প্রথমে জোহরের নামাজ আদায় করেন। রাহনুমায়ে শরিয়ত ও ত্বরিকত, আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ্ হুজুরের সভাপতিত্বে ময়দানে সমাপনী মাহফিলে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পীর সাবির শাহ্ বলেন, আল্লাহর প্রিয় হাবিব (দ.) শুধুমাত্র মানবজাতির কল্যাণের জন্য আসেননি, তাঁকে সমগ্র সৃষ্টির জন্য রহমত এবং আদর্শ হিসেবে পাঠানো হয়েছে। তিনি বিশৃঙ্খল মধ্যযুগীয় বর্বরতার বিপরীতে আরবজাতিকে সমগ্রবিশ্বে সবচেয়ে সভ্য মানুষে উন্নীত করেছিলেন। নবুয়ত প্রকাশের পূর্বে জুলুমের বিরুদ্ধে তাঁর হিলফুল ফুজুল সামাজিক কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দিয়ে গোত্রীয় দাঙ্গা হাঙ্গামার অবসান করেন এবং সবার কাছে বিশ্বস্ততার প্রতীক ‘আল আমিন’ উপাধিতে সমাদৃত হয়ে প্রমাণ করেছেন তিনি অন্য কারো মতো ছিলেন না, বরং অসাধারণ এক স্রষ্টা প্রদত্ত আদর্শের ধারক বাহক হয়ে এসেছিলেন। বিশেষত হিজরতের পর তাঁর দেখানো মদিনা সনদ এবং কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে মদিনা ছিল বিশ্বে নজীরবিহীন এক রাষ্ট্রব্যবস্থা। সামাজিক সুবিচার ও সাম্য–শান্তি প্রতিষ্ঠায় তাঁর দেখানো পথের চেয়ে সেরা কোনো পথ এ যাবত দেখাতে পারেনি। ধনী–গরীব, সাদা–কালো, মুসলিম–অমুসলিম, নারী–পুরুষ নির্বিশেষে সকলের কাছে ইসলাম হয়ে উঠেছে সবার নিরাপদ আশ্রয়। শুধু মানুষের জন্য নয়, বরং জীব–জড় নির্বিশেষে সমগ্র সৃষ্টির রক্ষায় তাঁর আদর্শ এক অব্যর্থ ব্যবস্থাপত্র হিসেবে গণ্য হচ্ছে। হুজুর কেবলা আরও বলেন, এজন্যে বিশ্ব মুসলমানদের ঐক্যের বিকল্প নেই। এসময় বিশ্বের সর্ববৃহৎ জুলুস হিসেবে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে এ জুলুস স্থান পাবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। এ জুলুস আয়োজনে সার্বিক সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। বিশাল এ মাহফিলে প্রধান মেহমান ছিলেন সিরিকোট দরবার শরীফের শাহজাদা আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ কাসেম শাহ (মা.জি.আ.)।
এতে বিশেষ অতিথি ছিলেন মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদুল্লাহ, বিএনপি নেতা ডা. শাহাদাত হোসেন। অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন আনজুমান ট্রাস্টের এডিশনাল সেক্রেটারি মোহাম্মদ সামশুদ্দিন, জয়েন্ট সেক্রেটারি মোহাম্মদ সিরাজুল হক, অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি এস এম গিয়াস উদ্দিন শাকের, অর্গানাইজিং সেক্রেটারি মাহবুবুল আলম, গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশের চেয়ারম্যান পেয়ার মোহাম্মদ, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদ্রাসার চেয়ারম্যান আবুল মহসিন মো. ইয়াহিয়া খান, আনজুমান ট্রাস্ট কার্যকরী সদস্যদের মধ্যে ছিলেন নুরুল আমিন, শাহজাদ ইবনে দিদার, লোকমান হাকিম, আবদুল হামিদ, মোনাফ সিকদার, আবদুল হাই মাসুম, কমর উদ্দিন (সবুর), মোহাম্মদ হোসেন খোকন, গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশের মধ্যে ছিলেন অ্যাডভোকেট মোছাহেব উদ্দিন বখতিয়ার, মাহবুবুল হক খান, মাহবুুবে এলাহী সিকদার, আর. ইউ চৌধুরী শাহীন প্রমুখ।
গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আনোয়ারুল হক ও মাওলানা হাফেজ আনিসুজ্জামান আলকাদেরীর সঞ্চালনায় মাহফিলে তাকরীর করেন, অধ্যক্ষ আবদুল আলিম রেজভী, অধ্যক্ষ জসিম উদ্দিন আযহারী, অধ্যক্ষ ড. হারুনুর রশিদ, মুফতি অছিয়র রহমান, কাজী আবদুল ওয়াজেদ, হাফেজ আশরাফুজ্জামান আলকাদেরী, উপাধ্যক্ষ আবুল কাশেম ফজলুল হক, ড. নাছির উদ্দিন, অধ্যক্ষ বদিউল আলম রেজভী।
বক্তারা বলেন, রাসুল পাক (দ)’র এই বিশ্বের বুকে শুভাগমনের চেয়ে বড় কোনো নিয়ামত ও রহমত এই উম্মতের জন্য নাই। ১২ রবিউল আউয়াল যে দিন আল্লাহর হাবিব (দ.) মা আমেনা (রা.)র ঘরে তশরিফ এনেছিলেন সেদিনও অদৃশ্য জগতের জান্নাতি মহিলা, হুর, ফেরেস্তারা শোভাযাত্রা সহকারে দলে দলে সেই ঐতিহাসিক গৃহে এসেছিলেন। এমনকি হিজরতের সময় মদিনাবাসীরাও নবীজি (দ.)কে তাঁদের মধ্যে পাবার পর আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েন এবং বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা সহকারে নবীজি (দ.)সহ এই হিজরতকারী শ্রেষ্ঠ মেহমানদের শহরে নিয়ে গিয়েছিলেন। অনুষ্ঠানে স্বাগত ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন– আন্জুমান ট্রাস্টের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মহসিন ও সেক্রেটারি জেনারেল আনোয়ার হোসেন। ট্রাস্টের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আলহাজ্ব মোহাম্মদ মহসিন তার বক্তব্যে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) ও জুলুসে সহযোগিতার জন্য সিটি কর্পোরেশন, বিদ্যুৎ, ওয়াসা, পুলিশ প্রশাসন, গোয়েন্দা সংস্থাসহ মিডিয়ার প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেন হুজুর কেবলা সাবির শাহ (মা.জি.আ)’র নেতৃত্বে জশনে জুলুস সফল করায় তিনি সর্বস্তরের মুসলমানদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। শেষে হুজুর কিবলা আল্ল্ল্লামা পীর সৈয়্যদ মুহাম্মদ সাবির শাহ্্ (মা.জি.আ) বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের মুসলিম উম্মাহ্র শান্তি, সমৃদ্ধি ও উন্নতি কামনা করে দোয়া ও মুনাজাত পরিচালনা করেন।