দেশ পুনর্গঠন, গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনা এবং চুরি হওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধারে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন চেয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল রোববার উচ্চ পর্যায়ের মার্কিন প্রতিনিধিদল রাষ্ট্রীয় অতিথিশালা যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। এরপর তার প্রেস উইং থেকে পাঠানো বার্তায় এসব তথ্য জানানো হয়। সাক্ষাতে দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়।
ছাত্র–জনতার গণআন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকারের পতনের তিন দিনের মাথায় মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে শপথ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। সংবিধান অনুযায়ী সংসদ ভেঙে দেওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে ভোটের আয়োজন করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও অন্তর্বর্তী সরকার প্রশাসন ও নির্বাচন ব্যবস্থা, এমনকি সাংবিধানিক সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। খবর বিডিনিউজের।
সরকারের চ্যালেঞ্জ তুলে ধরে ইউনূস বলেন, তার প্রশাসন দ্রুততার সঙ্গে আর্থিক খাতে সংস্কার শুরু করেছে এবং বিচার বিভাগ ও পুলিশসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঠিক করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, এটি আমাদের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময় এবং আমাদের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য মুহূর্ত। শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে বিপ্লবের কথা তুলে ধরে বলেন, যা বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন আশার যুগের সূচনা করেছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরে ইউনূস বলেন, দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ছয়টি কমিশন গঠন করা হয়েছে, যা ভোটে কারচুপি প্রতিরোধ, বিচার বিভাগ, পুলিশ, প্রশাসন, দেশের দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা সংস্কার এবং সংবিধান সংশোধনের কাজ করছে। তিনি বলেন, পূর্ববর্তী স্বৈরশাসনের সঙ্গে যুক্ত দুর্নীতিবাজদের চুরি করা সম্পদ তার সরকার ফিরিয়ে আনতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। দুর্নীতি মোকাবিলার চ্যালেঞ্জ বর্ণনা করতে গিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা দুর্নীতির এক বিশাল সমুদ্রে ছিলাম।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব ও অর্থ দপ্তরের আন্তর্জাতিক অর্থায়ন বিষয়ক সহকারী আন্ডার সেক্রেটারি ব্রেন্ট নেইম্যানের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদল ইউনূসের নেতৃত্বের প্রশংসা করেন এবং তার সংস্কার পরিকল্পনায় ওয়াশিংটন ডিসি সমর্থন করতে পেরে আনন্দিত বলে জানান।
মার্কিন কর্মকর্তারা জানান, তারা অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার জন্য প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সহায়তা প্রদানে আগ্রহী। ঘণ্টাব্যাপী চলা আলোচনায় আর্থিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার, বিনিয়োগ, শ্রম বিষয়ক, রোহিঙ্গা সংকট এবং প্রধান উপদেষ্টার জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনের জন্য আসন্ন নিউইয়র্ক সফর নিয়েও আলোচনা হয়।
যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধিদলে ছিলেন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু, সহকারী বাণিজ্য প্রতিনিধি ব্রেন্ডন লিঞ্চ, আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার (ইউএসএআইডি) উপসহকারী প্রশাসক অঞ্জলি কাউর, ট্রেজারি বিভাগের পরিচালক জেরোড ম্যাসন।
সংস্কার পরিকল্পনা জানতে চাইল যুক্তরাষ্ট্র : আর্থিকসহ অন্যান্য খাতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কার পরিকল্পনা জানার পাশাপাশি এক্ষেত্রে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। গতকাল প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিদের সঙ্গে সফররত মার্কিন প্রতিনিধিদলের বৈঠকে এ আলোচনা হওয়ার কথা জানিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিন। বৈঠকের পর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় এক ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, প্রথম আশ্বাস, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাথে তারা কাজ করতে চান, সেটার প্রতিফলন হিসাবে সরকার গঠনের দ্বিতীয় মাসের প্রথমেই তারা এ প্রতিনিধিদলটি পাঠিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, আমরা আর্থিক সংস্কারের জন্য যে সমস্ত খাতকে চিহ্নিত করেছি, এই সবগুলো বিষয়ে তারা সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে।
মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম উচ্চ পর্যায়ের সফরে যুক্তরাষ্ট্রের ছয় সদস্যের এই প্রতিনিধিদল শনিবার ঢাকায় এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ দপ্তরের আন্তর্জাতিক অর্থায়ন বিষয়ক সহকারী মন্ত্রী ব্রেন্ট নেইম্যানের নেতৃত্বে এই প্রতিনিধিদলে রয়েছেন দেশটির দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু।
গতকাল সকালে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের পর অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে বৈঠক করে মার্কিন প্রতিনিধিদল। এরপর প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তারা।
অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর বাংলাদেশের উন্নয়নে অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকার খাতে ২০ কোটি ডলারের সহায়তার বিষয়ে চুক্তি সই হয়। দুপুরে মার্কিন প্রতিনিধিদলের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ সেরে ব্রিফিংয়ে এসে আলোচনার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন পররাষ্ট্র। পররাষ্ট্র সচিব বলেন, সরকারের সংস্কার পরিকল্পনা সম্পর্কে তারা জানার আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে অর্থনৈতিক সংস্কারের বিষয়টি এই সরকারের বিশেষ অগ্রাধিকার বিবেচনায় আর্থিক খাত ও রাজস্ব খাতের সংস্কার, এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার ক্ষেত্র, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি, শ্রমপরিবেশ, মানবাধিকার সুরক্ষা, রোহিঙ্গা মানবিক সহায়তাসহ নানা বিষয়ে আমরা আলাপ আলোচনা করেছি।
পাচার হওয়া অর্থ ফেরানোর কৌশল নিয়ে আলোচনার বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, আমরা ব্রডলি আর্থিক খাতের সংস্কারের ব্যাপারে কথাবার্তা বলেছি এবং যে বিষয়টা আপনি উল্লেখ করেছেন, অর্থ পাচার সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কথাবার্তা হয়েছে। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের যে এঙপার্টিজ আছে, সেটা হয়ত আমরা ব্যবহার করব। আলাপ আলোচনাটা শুধুমাত্র শুরু হয়েছে, এটার চূড়ান্ত হতে কিছুটা সময় লাগতে পারে।
পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধিদলের মধ্যাহ্নভোজ সভায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান, বাণিজ্য সচিব, শ্রম সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধিসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। এসব আলোচনাকে নিকট ভবিষ্যতে অর্থবহ সম্পৃক্ততার ভিত্তি হিসাবে বর্ণনা করে পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিন বলেন, সামনে আমরা বিভিন্ন পর্যায়ে হয়ত এই আলোচনাটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব।
ইউএসএআইডির পক্ষ থেকে ২০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা ছাড়া সরকারের সঙ্গে আলোচনার অন্য কোনো বিষয়ে গণমাধ্যমে বক্তব্য দেননি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের কোনো সদস্য। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের বিষয়বস্তু তুলে ধরে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস এক ফেইসবুক পোস্টে বলেছে, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে সাক্ষাৎকালে বাংলাদেশের মানুষের কল্যাণে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, প্রতিষ্ঠান গঠন ও উন্নয়ন সহযোগিতার বিষয়ে নিশ্চিত করেছেন আমাদের প্রতিনিধিদল। যেহেতু বাংলাদেশ আরও ন্যায্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে চাইছে, যুক্তরাষ্ট্র সেই প্রচেষ্টায় সহায়তা করতে প্রস্তুত।
অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে দূতাবাস বলেছে, বাংলাদেশের নব উদ্যমে প্রবৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়াকে আমরা পৃষ্ঠপোষকতা করব। এ লক্ষ্যে শীর্ষ অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারকদের সাথে আলাপে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও টেকসই উন্নয়নকে ঘিরে তাদের উদ্যোগ ও প্রচেষ্টাকে সহায়তা করার ক্ষেত্রে আমাদের সম্পৃক্ততার বিষয়গুলো আলোচনায় গুরুত্ব পেয়েছে।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে তাদের আরেকটি পোস্টে বলা হয়, আমরা আমাদের অংশীদার বাংলাদেশের সাথে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্প্রসারণ, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, মানবাধিকার সমুন্নত রাখা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় সহায়তা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
শিডিউল মিললে দেখা হতে পারে ইউনূস–বাইডেনের : সময় মিললে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাক্ষাতের সম্ভাবনার কথা বলেছেন পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে তাদের মধ্যে কোনো বৈঠকের বিষয় চূড়ান্ত হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট যখন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যান, সাধারণত তিনি কোনো দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মিলিত হন না, এখন পর্যন্ত সেটা আমরা জানি। সেক্ষেত্রে আমি যতটুকু জানি, রিসেপশন ধরনের হয়ে থাকে। যদি দুপক্ষের শিডিউল মেলে তাহলে হয়ত সেখানে দেখা হওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে।
প্রতিরক্ষা সহযোগিতার আলোচনার বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা নিয়ে আজকে আমার সাথে এই বৈঠকে আলোচনা হয়নি। শ্রম আইন সংশোধনের বিষয়ে শেখ হাসিনা সরকারের দেওয়া প্রতিশ্রুতির বিষয় টেনে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, শ্রম আইন নিয়ে আমরা যে সমস্ত পদক্ষেপ নিয়েছি, সে পদক্ষেপ সম্পর্কে তাদেরকে বলেছি এবং যে পদক্ষেপগুলো সম্পর্কে তারা নোট নিয়েছেন। এগুলোকে তারা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হিসাবে স্বীকৃতি দেন। তবে এক্ষেত্রে আলোচনা অব্যাহত থাকবে।