বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রায় মাস ফুরালো। তারুণ্যের উচ্ছ্বাসের এই নব–আন্দোলনে চট্টগ্রামের মেয়েরা পালন করেছে অগ্রণী ভূমিকা। চট্টগ্রামকে আমরা যতোই রক্ষণশীলতার চাদরে মুড়িয়ে রাখি না কেন, বীরকন্যা প্রীতিলতার উত্তসুরীরাই এই কঠিন কাজটি সাহসের সাথে করেছেন, এবং ভবিষ্যতেও করবেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। এই আন্দোলনে যুক্ত প্রথম সারির কয়েকজন ফ্রন্টলাইন যোদ্ধার গল্প থাকবে আজকের এই লেখায়।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে একেবারে প্রথমদিক থেকেই যুক্ত চিটাগাং ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী পুষ্পিতা নাথ। আমি নিউজ কভার করতে গিয়ে পুষ্পিতার সাথে দেখাও হয়েছিল। দেখেছি অন্যান্য বিভিন্ন স্থানে সমস্যা আর সংকটকালে দায়িত্বপালনকারী সমন্বয়কদের সাথে পুষ্পিতা ছুটে চলেছেন রাতে বিরাতে। আন্দোলনে তার দৃপ্ত পদচারণা এবং অবিনাশী প্রত্যয়ের গল্প শুনতে চাইলে, পুষ্পিতা বলেন, আমি একেবারে শুরুর দিকে এই আন্দোলনের সাথে যুক্ত হই। প্রথম দিকে একটু দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলাম। কিন্তু পরে নামার পরে সে দ্বন্দ্ব কেটে যায়। আন্দোলনে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ দেখে সাহসী হয়েছি। সব শ্রেণি–পেশার মানুষ যেভাবে আমাদেরকে সমর্থন দিয়েছে, এতে আমাদের আগ্রহ ও উদ্দীপনাকে অনেকাংশে বাড়িয়ে তুলেছে। রাস্তার কর্মসূচি নির্ধারণ করা হতো আগের দিনেই অনলাইন মিটিং–এর মাধ্যমে। ঢাকার সমন্বয়করা দিনের যে কর্মসূচি দিতেন, সেগুলো কে কিভাবে পালন করবে, স্থান নির্ধারণ থেকে শুরু করে কার কি দায়িত্ব পালন সেগুলো ঠিক করতেন। প্রথম দিকে সিডিএ এভিনিউতে স্থান নির্ধারণ করা হলেও পরে বিভিন্ন পয়েন্টে কর্মসূচিগুলো পালন করা হতো। চবি শিক্ষার্থীদের কথা মাথায় রেখে শাটল ট্রেন–এর শিক্ষার্থীরা যাতে কর্মসূচিতে অংশ নিতে পারে তাই মুরাদপুর, ষোলশহর, ২ নম্বর গেট পয়েন্টগুলোকে নির্বাচন করা হয়েছিল। পরে কোতোয়ালি, নিউমার্কেট এবং লালদিঘির মাঠে এই আন্দোলনের অভূতপূর্ব সাফল্য দেখতে পেয়েছি।
চট্টগ্রাম কলেজের বাংলা অনার্সের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী নেভী দে। নেভী জানায়, শুরু থেকেই নেভী যুক্ত হন কোটা আন্দোলনে। মাঠে ময়দানে ছিলেন। একদিকে পরিবারের বাধা, অন্যদিকে জীবনের ঝুঁকি সব মিলিয়ে একটি আতঙ্কের মধ্য দিয়েই সময় পার করছিলাম। প্রথমদিনে টাইগারপাসে পুলিশের বাধার সম্মুখীন হলেন। সেই পুলিশ দলে নেভীর বোন ছিলেন। তিনি বার বার তাকে নিরাপদে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নেভী সিদ্ধান্তে অটল থেকে পুলিশের বেষ্টনির মাঝেও তাদের ব্যানার রক্ষা করেছিলেন। এক পর্যায়ে পুলিশ আন্দোলনকারীদের উপর আক্রমণ শুরু করে। তখনো নেভীর বোন নেভীকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে চেয়েছিল । কিন্তু পারেননি। এক সময় পুলিশের ধাক্কায় মেয়েরা হতাহত হয়। এরপর পর থেকে পরিবারের সাথে দ্বন্দ্ব আর অশান্তি বেড়ে যায়। তবুও যৌক্তিক আন্দোলন থেকে পিছিয়ে যাননি। ৫ আগস্ট পর্যন্ত নেভী আন্দোলনে যুক্ত ছিল। টিউশন করতে পারেননি। কারফিউতে শিক্ষার্থীদেরকে অতর্কিতভাবে তুলে নিয়ে যাচ্ছিল। সে সময় নিজের বাসায়ও থাকতে পারেননি। সর্বক্ষণ শঙ্কা আর আতংকে দিন কেটেছিল। নিউ মার্কেটের সামনে টিয়ারসেলের আঘাত থেকে কোনোরকমে প্রাণে বেঁচে এসেছিলেন নেভী ।
কোটাবিরোধী আন্দোলনের আরেক সারথী লাবণী আকতার। লাবণী চট্টগ্রাম সরকারি হাজী মুহসীন কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষ অনার্সের শিক্ষার্থী। আন্দোলন যখন একেবারে তুঙ্গে, লাবণী তখন আন্দোলন দেখার জন্য রাস্তায় বেরিয়েছিলেন। শুনেছিলেন ৫ জুলাই এই আন্দোলন শহরকেন্দ্রিক হবে ষোলশহরে। তাই আন্দোলন দেখার জন্য ষোলশহরে গিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬/৭ জন শিক্ষার্থীকে এক জাগায় দেখে তাদের পাশে গিয়ে বসেন। আলাচারিতাশেষে তাদের মোবাইল নম্বর নেন আপডেট জানার উদ্দেশ্যে। মূলতঃ সেদিন থেকে লাবণীর দীর্ঘ এক মাসের আন্দোলনের সূচনা। বিকালে টিউশন থাকলে সারাদিন রাস্তায় থেকে সন্ধ্যায় টিউশনে যেতাম। সেখানেও সময় ঠিক রাখার চাপ আসে। তারপরেও অনেক কর্মসূচি । প্রথমে বিকালে রাস্তা ব্লকট , এতে রেলপথ এবং সড়ক পথ দুটোই ছিল। একদল রেলপথে গেলে আরেকদল থাকতাম সড়কপথে। এরপর কমপ্লিট শাটডাউন, পুলিশের তাড়া, পুরাতন রেল স্টেশন থেকে মিছিল কওে টাইগারপাসে এলে পুলিশের বাধায় পড়ি। পুলিশ ব্যানার কেড়ে নিতে চাইলে আমরা তা প্রতিরোধ করি অত্যন্ত সাহসের সাথে। পুলিশ আমাদের ভাইদেরকে ছত্রভঙ্গ করেছে, কিন্তু মেয়েদেরকে পারেনি। আমরা মিছিল নিয়ে ২ নম্বর গেটে যাই। সেখানে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। অনেকজনকে হাসপাতালে নিয়েছি। বাসার সবাইকে বলেছি বান্ধবীর বাসায় আছি, ওদিকে তারা টিভিতে পুলিশের সাথে ধ্বস্তাধস্তির ভিডিও দেখে ফেলে। বাসা থেকে ফোনের উপর ফোন আসে। ফোন ধরার সুযোগ পাচ্ছিলাম না। বার বার বলেছে পরিবার থেকে , এসব ভিডিও দেখলে, আমরা বাইরে মুখ দেখাতে পারবো না। এর মাঝে বিয়ে ঠিক করে ফেলে। এবার সিদ্ধান্ত নিলাম, আর ফোন ধরবো না , বাসায় গেলে যা হবার হবে।। ১৫ জুলাই ষোলশহরে আমরা কর্মসূচিতে ছিলাম। আগেই শুনেছি , ছাত্রলীগ ঝামেলা করবে। তা্ ই হলো । ইট পাথর ঢিল ছুঁড়তে লাগলো। একটি বিশাল ঢল এস আমাদের গায়ের উপর পড়লো। আমি সবার নীচে ছিলাম, দুই পা গুরুতর জখম হলো। আমাকে ফার্মেসিতে নিয়ে ব্যান্ডেজ দেয়া হলো। এরপর দু’সপ্তাহ আর যেতে পারিনি। তবে প্রতিদিন খবর শুনছি , ভায়েরা মারা যাচ্ছে, আহত হচ্ছে। বাসায় প্রতিটি মুহূর্ত শঙ্কা আর আতঙ্কের মধ্যে কাটিয়েছি। পা সামান্য ভালো হলেই ৪ আগস্ট নিউমার্কেটের দিকে গিয়ে টিয়ারসেলের মুখে পড়ে হকার মার্কেটের দিকে যাই। মুখে কাপড় বেধে, পেস্ট লাগিয়ে আবার নিউমার্কেটের সামনে আসি। এদিকে সিটি কলেজের সামনে থেকে রাবার বুলেট ছুঁড়ছে, ধোঁয়ায় পুরো এলাকা ছেয়ে গেছে। সেখান থেকে ধাওয়া খেয়ে এক অচেনা বাড়িতে ঢুকে আমরা কয়েকজন জীবন বাঁচিয়েছি। সেদিনের ঘটনা ছিল এক বিভীষিকার মতো। পরের দিন বিজয় এলো। তখন আনন্দে আমরা একজন অপর জনকে জড়িয়ে ধরে খুশিতে কেঁদেছি অনেক।
নীলা আফরোজও হাজী মুহাম্মদ মুহসীন কলেজের ইংরেজি অনার্সের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী। নীলা জানান, তাঁকে সবচেয়ে বেশি আলোড়িত করেছে এই আন্দোলনে যখন নির্বিচারে শিশু ও নারীদের উপর অত্যাচার হচ্ছিল। একের পরে এক নারী ও শিশু মারা যাচ্ছিল, তখন আর ঘরে বসে থাকতে পারলেন না নীলা। তিনি ১৬ জুলাই থেকে আন্দোলনে যুক্ত হন। রাস্তায় প্রচুর গোলাগুলি হচ্ছিল। নীলা এই অবস্থায় আন্দোলনে যোগ দেন। সবাই তাকে ঘরে ফিরে যেতে বলে। কিন্তু তিনি পিছপা হননি । নীলা বলেন, আমি দেখেছি , বাংলাদেশী জার্সিপড়া একটি ছেলেকে ধাওয়া করছিল, সে রেল লাইনের ব্যারিকেড পেরিয়ে কোন দিকে চলে গেলো। পরে সদর রাস্তায় এসে শুনলাম, কাকে যেন কুপিয়ে পা বিচ্ছিন্ন করেছে সন্ত্রাসীরা। তখনো জানতাম না সেই ছেলেটি আমার পাশের কলেজের ছাত্র ওয়াসীম আকরাম। আমি তাকে জীবিত অবস্থায় দেখেছিলাম। নীলার মাথায় ঘুরপাক করছিল আবরার, ফাহাদ এর কথা। হামলাকারীরা ছাত্রদেরকে একা পেয়ে মারধর করছিল, মোবাইল চেক করছিল। এসময় দেখলাম একটি মেয়ে হামলাকারীদের বাকবিতণ্ডায় লিপ্ত হয়ে জানতে চাচ্ছিলেন, কেন তারা এভাবে ছাত্রদের পেটাচ্ছে? পরে মেয়েটির পরিচয় জানলাম, তিনি সমন্বয়ক পুষ্পিতা নাথ। এরপর থেকে প্রতিটি কর্মসূচির সাথে যুক্ত থেকেছি। রোড ব্লকেট, মিছিল, পুলিশের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ, নগরীর প্রতিটি পয়েন্টেই বিক্ষোভ কর্মসূচিতে জানের পরোয়া না করেই পুলিশী ও সন্ত্রাসীদের হামলা মোকাবেলা করেছি। জীবনে প্রথম টিয়ারসেলের সাথে পরিচিত হয়েছি। মুখ পুড়ে ছাই হয়েছে, তারপরেও সহযোদ্ধাদের নিরাপত্তা দেয়ার চেষ্টা করেছি। পুলিশের কাছ থেকে আমাদের একজনকে ছিনিয়ে এনেছি। এক সময় গোলাবারুদের মুখে পড়ে প্রাণ যায় যায় অবস্থা , কে যেনো এসে ধাক্কা দিয়ে কোনো একটা বাসায় ঢুকিয়ে দিয়ে রক্ষা করে। এক পর্যায়ে আমাদের বাসার বাড়িওয়ালা তাদের নিরাপত্তার জন্য আমাকে স্থান পরিবর্তন করতে বলেন। পরে এক আন্টির বাসায় আশ্রয় নেই। এভাবে পুরো সময়ে আন্দোলনের যাবতীয় কর্মসূচিতে নিজেকে যুক্ত রেখে অবশেষে বিজয় ছিনিয়ে আনতে পেরেছি।