(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
নানা পদের চীনা খাবার খাচ্ছিলাম। একটির পর একটি। এতো খাবারের অর্ডার কেন যে দিয়েছে কে জানে! চীনে গতবারও খেয়াল করেছিলাম যে, এরা ভাত খুবই কম খায়। খাওয়ার শেষদিকে একটু নিলো কি নিলো না টাইপে দুয়েক কাঠি মুখে দেয়। তবে মাছ মাংস এবং তরকারি খায় প্রচুর। সাথে গ্রীণ টি চলতে থাকে হরদম। গল্প করতে করতে তারা দীর্ঘ সময় নিয়ে লাঞ্চ বা ডিনার করে। আমাদের লায়ন ফজলে করিম ভাই এবং ডালিয়া ভাবী অনেকটা চীনা ধাঁচের মানুষ। তাদের বড়পুত্র ধ্রুব তো চীনেই থাকে। অতএব চীনা স্টাইলে যে লাঞ্চ হবে সেটা বুঝে গেলাম শুরুতে।
আট দশ পদের তরকারি খেলাম। মাছ, মাংস, শাক–সবজি কিছুই বাদ গেলো না। লতাপাতার পদও রয়েছে দুয়েকটি। দেয়া হয়েছে নুডলস স্যুপ। নুডলসের কাহিনী আবার ভিন্ন। বাটিভর্তি সেদ্ধ নুডলস, সাথে আলাদা বাটিতে টলটলে স্যুপ। আচার টাচার দেয়া, প্রচুর ঝাল। চপস্টিক দিয়ে নুডলস নিজের বাটিতে নিয়ে তাতে স্যুপ ঢেলে চুকচুক করে খাওয়া। আমি চপস্টিক দিয়ে খাবারের চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। অবস্থা বেগতিক দেখে ডালিয়া ভাবী পরামর্শ দিলেন যে, আপনি চামচ দিয়ে খান। চপস্টিকে পারবেন না, জামা নষ্ট করে ফেলবেন। আমি চামচ দিয়ে খেলেও সাথের তিনজনই দিব্যি চপস্টিকে কাজ সারছিলেন। এক আজব জিনিস এই চপস্টিক। দুইটি কাঠি দিয়ে মাছ, মাংস, ভাতসহ যাবতীয় খাবার মুখের ভিতরে ঠিকঠাকভাবে পৌঁছে দেয়া শুধু বিরাটই নয়, কঠিন এক শিল্প! লতাপাতা না হয় ‘পেছিয়ে–টেছিয়ে’ খাওয়া যায়, কিন্তু মাংস থেকে হাঁড় কিংবা মাছের কাঁটা বেছে নেয়া সত্যিই বিস্ময়কর ব্যাপার। অথচ চীনা শিশুরাও দিব্যি এই শিল্প রপ্ত করে দিব্যি খাওয়া দাওয়া করে।
পালং শাক টাইপের ঝোলে ভাসা একটি পাতাজাতীয় খাবার আমি আবারো চপস্টিকে চেষ্টা করলাম। করিম ভাই আমাকে শিখানোর চেষ্টা করলেন যে, দুইটি কাঠির একটি হাতের আঙ্গুলে ফিক্সড থাকবে, অপরটি খাবার ধরার সময় আঙ্গুলের ইশারায় খেলা করবে। ধরা শেষ হলে ওই আঙ্গুলটিও ফিক্সড হয়ে যাবে। খাবার উঠে যাবে মুখে। চেষ্টা করলাম, দুয়েকবার সফলও হলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফলতা ধরা দিলো না। আমি আবারো কাঁটা চামচে ফিরে গেলাম।
আমার কান্ড দেখে রেস্টুরেন্টের তরুণী বধূ এবং তাদের ছোট্ট শিশুটি বেশ মজা পাচ্ছিলো। শিশুটি কি কি যেনো বলছিল। আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম যে, পুতুলের মতো সুন্দর বাচ্চাটি আমাকে নিয়েই কথা বলছে। হয়তো বলছে যে, এতো বুড়ো মানুষ, অথচ খাবার খেতে জানে না!
বিলম্বিত লাঞ্চ শেষ করে আমরা বের হয়ে সাংহাই শহর দর্শনে বের হলাম। সাংহাই তো সাংহাই। মোড়ে মোড়ে বিস্ময়, পদে পদে চোখ কপালে উঠার আয়োজন। আমরা ঘুরছিলাম। গাড়িতে ঘুরে ঘুরে শহরের রাস্তা, মানুষ, আকাশছোঁয়া সব ভবন দেখছিলাম। সাংহাইতে আগেও ঘুরেছিলাম। হয়তো আগের রাস্তা দিয়েই যাচ্ছি। কিন্তু চেনার কোন উপায় নেই। প্রতিবছর যে শহর চেহারা পাল্টায় সেই শহরকে ঠিকঠাকভাবে চিনে রাখা সম্ভবও না। সাংহাই শহরে যে পরিমাণ উন্নয়ন গত বছর কয়েকে হয়েছে তা আধুনিক বিশ্বেও বড় বিস্ময়। এই শহরে লায়ন ফজলে করিম ভাইয়ের অতি আপনজন এক তরুণী স্বামী সন্তানসহ বসবাস করেন। চট্টগ্রামেও তিনি একসময় জ্যাক টেকনোলজির প্রতিনিধি হয়ে কাজ করতেন। জ্যাক থেকে চাকরি ছেড়ে দিলেও করিম ভাইয়ের সাথে সেই আত্মীক সম্পর্ক রয়ে গেছে। মেয়েটির চাইনিজ নাম লিও লি জঁইন, আন্তর্জাতিক নাম ‘বেটি’। এই বেটি মানে মেয়ে নয়। চাইনিজ লোকজন যারা চীনের বাইরে গিয়ে কাজ করে, তাদের প্রত্যেকেই একটা ইংরেজী টাইপের ‘ডাকনাম’ নেয়। এই নাম পাসপোর্টে থাকে না। বাইরের দেশের মানুষ চাইনিজ নামগুলো ঠিকঠাকভাবে উচ্চারণ করতে পারে না বিধায় তারা সহজে উচ্চারণ করা যায় এমন এক একটি নাম ধারণ করে। ডালিয়া ভাবী বেটির জন্য টুকটাক উপহার সামগ্রি চট্টগ্রাম থেকে নিয়ে গেছেন। বেটি করিম ভাইকে দাওয়াত দিয়েছে। আমিও সেই দাওয়াতে সামিল হতে বেড়ানোর আমেজে ঘুরতে যাচ্ছি।
এই দাওয়াত আমার ভিতরে অন্যরকমের একটি ভালো লাগা তৈরি করলো। রথ দেখা এবং কলা বেচার কারবার আর কি! দাওয়াতে যাওয়ার নামে সাংহাই শহরে ব্যাপক ঘোরাঘুরি হবে, দেখা হবে শহর বন্দর থেকে শুরু করে নানাকিছু। আবার দাওয়াতও রক্ষা হবে। একই সাথে একটি চীনা পরিবারের অন্তরমহলে ঢুকে তাদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যাবে।
বাইদো ম্যাপ ধরে এগুচ্ছিল আমাদের গাড়ি। গুগল ম্যাপের মতো। তবে চীনারা গুগল এ্যালাউ করেনি, নিজেরাই এ্যাপস বানিয়ে তা কাজে লাগিয়েছে। এটাও গুগল ম্যাপের মতোই কার্যকর। কোন অচিন জায়গা আর অচিন রাখেনি, সবই মোবাইলের ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে। এক তরুণী ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে, ফ্রন্ট সিটে আমি। পেছনে করিম ভাই ডালিয়া ভাবী এবং ধ্রুবকে নিয়ে বসেছেন। আমি শারীরিকভাবে একটু হৃষ্টপুষ্ট হওয়ায় প্রায় জার্ণিতে আমার আসন ড্রাইভারের পাশেই হয়ে থাকে। এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
গাড়ি ছুটছে। সাংহাই শহরের ১২–১৪ লেনের বিশাল রাস্তা ধরে ছুটছে আমাদের গাড়ি। চীনা গাড়ি। রাস্তায় হাজার হাজার চীনা গাড়ি ঝড়ের গতিতে ছুটছে। লেন ভাগ করা আছে, যে যার লেন ধরে ছুটছে, কেউ কারো লেনে ঠোক্কর মারতে যাচ্ছে না। লেটেস্ট মডেলের এসব গাড়ির সব কী চীনারা বানায়! কিছুটা ভিমড়ি খাওয়ার মতো অবস্থা আমার। অটোমোবাইল শিল্পে চীনের উত্থান কী জাপান, ব্রিটিশ কিংবা জার্মানির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে! অবশ্য চীনের রাস্তায় ভিনদেশী গাড়িও রয়েছে।
চীনে অটোমোবাইল শিল্পে গত দশ বছরে নাকি বিপ্লব ঘটে গেছে। তাদের ১০০টিরও বেশি গাড়ি প্রস্তুতকারক কোম্পানি রয়েছে। এরমধ্যে গত ১০ বছরে বাজারে গাড়ি এনেছে অন্তত ৫০টি কোম্পানি! বলে কি! দশ বছরে ৫০টি গাড়ি প্রস্তুতকারক কোম্পানি! আমাদের যেনো কয়টি আছে? আঙ্গুলের ডগা গুনে দেখলাম যে, ছয় সাতটির বেশি নয়। তাও মোটর সাইকেল প্রস্তুত করে এমন কোম্পানিও রয়েছে। বাংলাদেশের কোম্পানিগুলো বিদেশ থেকে খোলা গাড়ি এনে দেশে সংযোজন করে বাজারে ছাড়ে। অথচ চীনের শতাধিক কোম্পানি গাড়ি প্রস্তুত করে।
বিশ্বের গাড়ি বাজারের নিয়ন্ত্রক দেশগুলোর কোনটিতে দশটির বেশি কোম্পানি নেই। চীনের একাই এতোগুলো। আগামী বিশ্বে চীন যে গাড়ির রাজ্যে একচেটিয়া একটি বাজার ধরতে যাচ্ছে তা যেনো আমি দিব্যি দেখতে পাচ্ছিলাম। কী দুর্দান্ত সব গাড়ির মডেল, ডিজাইন। নেটে একটু ঘাটাঘাটি করে পিলে চমকানো তথ্য পেলাম যে, চীনা কোম্পানি বিওয়াইডি বাজারমাত করতে শুরু করেছে। গত বছর তারা ৩২ লাখ ইউনিট গাড়ি বিক্রি করেছে। যা বিশ্বের বহু নামজাদা কোম্পানিগুলোর তুলনায় বেশ বেশি। আমার মনে হলো, চীনের অনেক বড় একটি সম্পদ হচ্ছে তাদের বিশাল দেশের বিপুল জনগোষ্ঠী। বিশাল বাজার। যেখানে পুরো বছরে আমাদের দেশে মাত্র ৩২ হাজার ইউনিট গাড়ি বিক্রি হয়, সেখানে চীনের মাত্র একটি কোম্পানিই বিক্রি করেছে ৩২ লাখ! বিশ্বের মোট উৎপাদিত গাড়ির ২৮ শতাংশই চীনারা বানাচ্ছে, পৃথিবীর দেশে দেশে সেই গাড়ি বিক্রিও করছে। চীনের গাড়ি উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ৩৮ শতাংশ! তথ্যগুলো লিখে ফেললাম সহজে, কিন্তু এটা কি আসলেই এতো সহজ! একটি শিল্পের ৩৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি কী ভাবা যায়!!
নেট দুনিয়া থেকে খবর যা জানা গেলো, তাতে চীনের এই শিল্পটিতে বিকাশের প্রথম কারণই হচ্ছে কারিগরি সক্ষমতা। বছরে ৫ লাখের বেশি তরুণ প্রকৌশলী বের হয় চীনের বাজারে। যাদের অধিকাংশই নিজের মেধা মননের সবটুকু দিয়েই স্বদেশে কাজ করে। দ্বিতীয় সুবিধাটি হচ্ছে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। চীনা সরকার শিল্পোন্নয়নে অকাতরে সহায়তা প্রদান করে। অটোমোবাইল সেক্টরকেও একইভাবে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ট্যাক্স সাবসিডি দিচ্ছে। স্বল্প সুদে ঋণ দিচ্ছে উদ্যোক্তাদের। টাকা মেরে দেয়া বা পাচার করার সংস্কৃতি চীনে এখনো গড়ে উঠেনি। তাই তারা মাটি ধরলেও সোনা হচ্ছে। এছাড়া নিজেদের বিশাল বাজারের কথাতো আগেই বললাম।
আমাদের গাড়ি ছুটছিল, নিঃশব্দে। চীনা গাড়ি, কোন আওয়াজ নেই। রাস্তা যেনো বেডরুমের টাইলস করা ফ্লোর, একেবারে মসৃণ। এমন রাস্তায় এমন গাড়িতে আয়েশ করে বসে আছি। সানরুফ খোলা থাকায় আমি শুধু শহরই নয়, আকাশও দেখতে পাচ্ছিলাম। একই আকাশ, আমাদেরই মতো। সাদা সাদা মেঘের মিছিল হয়তো ঘুরতে ঘুরতে আমাদের দেশের উপর দিয়েই যাবে। একই আকাশের নিচে আমরা, অথচ কত শত অমিল তাদের আর আমাদের মাঝে! (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।