পরিবর্তনে জেন জি প্রজন্ম

ছন্দা চক্রবর্তী, প্রাবন্ধিক | মঙ্গলবার , ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ at ৯:৫৪ পূর্বাহ্ণ

বর্তমানে ‘জেন জি’ নামে একটা প্রজন্মের নাম সবার মুখে মুখে শোনা যাচ্ছে। জেন জি হলো সে প্রজন্ম যাদের বয়স বর্তমান সময়ে ১১ বছর থেকে ২৬ বছর। এ প্রজন্ম পরিবর্তনে বিশ্বাসী, যারা সৃষ্টিশীল, যারা নতুন করে জাতিকে পথ দেখায়। জেন জি মানে হলো জেনেরেশান জুমারস। যারা নাকি জুম ব্যবহারে অভ্যস্ত। কভিড১৯ চলাকালে তারা জুম ব্যবহারের মাধ্যমে যোগাযোগ রেখে চলতে অভ্যস্ত প্রজন্ম। স্মার্ট ফোনের সাথে তাদের বয়ঃসন্ধি কাল পার করা প্রজন্ম। তারা সৃষ্টি থেকে মিলেনিয়াম প্রজন্ম পর্যন্ত জনসমষ্টি থেকে আলাদা, তার কারণ তারা জন্ম থেকেই ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা ভোগ করা প্রজন্ম। জেনারেশন জেড বা জেন জি, মিলেনিয়াল পরবর্তী এবং জেনারেশন আলফার পূর্ববর্তী একটি ডেমোগ্রাফিক শ্রেণি। বিভিন্ন কালের প্রজন্ম, প্রজন্মের নামকরণ, এবং তাঁদের বৈশিষ্ট্যগুলি জানার এবং বোঝার মাধ্যমে বিশ্ব সমাজের পরিবর্তন, অগ্রগতি ও ভবিষ্যতের প্রবণতার ধারণা পাওয়া যায়।

জেন জি’ প্রজন্ম হলো ১৯৯৭ থেকে ২০১২ পর্যন্ত জন্ম নেওয়া শিশু, কিশোরকিশোরী ও তরুণ ডেমোগ্রাফিক শ্রেণি। জেনারেশন এক্স, এবং জেনারেশন ওয়াই প্রজন্ম এদের বাবামা। প্রজন্ম জেড বা ‘প্রজন্মজি’ ধারণাটি প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। মার্কিন গবেষক এবং ডেমোগ্রাফিক বিশ্লেষকগণের গবেষণা থেকে এই তরুণ প্রজন্মের প্রযুক্তি নির্ভরতার চালচলন, শিক্ষা, সাহিত্য, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বিভিন্ন তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে এদেরকে ব্রিটিশ মতে জেন জেড এবং আমেরিকান মতে জেনজি বলা হয়। এদেরকে, ডিজিটাল নেটিভ, ওঞৎঁব জেনারেশন নামেও অভিহিত করা হয়।

জেনারেশন বা প্রজন্ম একটি সামাজিক ধারণা, যা নির্দিষ্ট সময় কালে জন্ম নেওয়া মানুষের একটি গোষ্ঠিকে বোঝায়। যারা সাধারণভাবে নির্দিষ্ট সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে যেভাবে বেড়ে উঠে, সেসব বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে প্রজন্মকে ভাগ করা হয়েছে। ১৯৯১ সালে মার্কিন গবেষক ‘নিল হাও’ ও ‘উইলিয়াম স্ট্রস ‘এর লেখা বই ‘জেনারেশনস’এ প্রথম বিভিন্ন প্রজন্মের শ্রেণিবিভাগ বর্ণিত হয়েছে। প্রজন্ম অর্থাৎ জেনারেশন এর ডেমোগ্রাফিক শ্রেণি অনুযায়ী যথাক্রমে১। ‘গ্রেটেস্ট জেনারেশন’ বা ‘জি অ্যাই, প্রজন্ম’’.২।‘সাইলেন্ট জেনারেশন’ বা ‘নীরব প্রজন্ম’ ৩।‘বেবি বুমার্স’ ৪। ‘বেবি বাস্টারস’ বা জেনারেশন এক্স,’ ৫। ‘মিলেনিয়ালস বা ওয়াই জেনারেশন’এবং ৬। আলোচিত বর্তমান ‘জেনারেশন জি’ বা জুমার্স, ইত্যাদি শ্রেণিতে বর্ণিত। এবং এর পরের জেনারেশনকে আলফা জেনারেশন বলা হচ্ছে।

জেন জি’ কে চেনার আগে প্রজন্ম সমূহের বিবরণে প্রজন্মের ভিন্নতা রয়েছে। যেমন গ্রেটেস্ট জেনারেশন দের জীবনকাল ছিল ১৯০১১৯২৭ সাল। এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, তখন মহামন্দা বিরাজমান থাকায় এই প্রজন্মের সদস্যরা দেশের প্রতি অনুগত মনোভাবের জন্য পরিচিত ।

সাইলেন্ট জেনারেশন’ বা নীরব প্রজন্মের সময় কাল হলো ১৯২৮১৯৪৫ সাল। এদের সময় কালে সরকার বা সামাজিক প্রতিষ্ঠানের, বিরুদ্ধে কোনো রকম প্রতিবাদমুখর ছিলেন না। তাদের শৈশব শান্তি পূর্ণ ছিল, তারা স্থিতিশীল কর্মজীবনের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। তারা তাদের কর্মদক্ষতা দিয়ে পরিবার সমর্থন করার প্রবণতায় পরিচিত।

বেবি বুমার্স’ প্রজন্মের সময় কাল হচ্ছে ১৯৪৬১৯৬৪ সালের সময় পর্যন্ত। এদের ‘বুম’ নামটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে নির্দেশ করে। এদের প্রত্যেকের পরিবারের মধ্যে সন্তানসন্ততি ছিল অনেক। তারা প্রায় অনেক ভাইবোন নিয়ে যৌথ পরিবারে বড় হওয়া প্রজন্ম। এটা ছিল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও দ্রুত প্রযুক্তিগত অগ্রগতির যুগ। সামাজিক পরিবর্তন, অধিকারআন্দোলন, প্রগতিশীলতা,সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং উদ্দীপক মনোভাবের জন্য পরিচিত প্রজন্ম।

বেবি বাস্টার্স’ বা জেনারেশোন এক্স’হলো ১৯৬৫১৯৮০ সাল পর্যন্ত জন্ম নেওয়া জনগোষ্ঠী। এরা বেবিবুমার্স প্রজন্মকে অনুসরণকারী প্রজন্ম এদের জন্ম হার’ বেবিবুমার ‘থেকে কম। তারা প্রযুক্তিগত ও সামাজিক পরিবর্তনের সময় বড় হয়েছেন।তাদের জীবনকাল ছিল পরিবর্তনের এবং তারা নতুন প্রযুক্তির আবির্ভাবের সাক্ষী। তারা স্বনির্ভরতায় আগ্রহী মনোভাবের জন্য পরিচিত। কানাডিয়ান লেখক’’ ডগলাস কুপ্ল্যান্ড এর’ জেনারেশনস এক্স’ বই এ লেখা মতামত অনুযায়ী এই প্রজন্মকে স্যান্ড উইচ প্রজন্ম বলা হয়েছে, কারণ বেবি বুমার ও ‘মিলেনিয়ালস প্রজন্ম’ বা ‘ওয়াই জেনারেশন’ এর চারিত্রিক বৈশিষ্টের মিশেলে এদের বেড়ে ওঠা।এরা অভিভাবকদের মান্য করে, তাদের আদেশ উপদেশ নিয়ে চলে, আবার তাদের সন্তানদের সাধইচ্ছা পূরণ করার জন্য সন্তানদের সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দেয়। এই দুই প্রজন্মের চালচলন নিয়ে জীবন যাপন করা স্যান্ড উইচ পদ্ধতি হল জেনারেশন এক্স বা বেবি বাস্টার্স প্রজন্ম।

জেনারেশন ওয়াই বা মিলেনিয়াল প্রজন্ম’ এর জন্মকাল হলো ১৯৮১১৯৯৬ সাল পর্যন্ত। এদের শৈশব কৈশোর মূলত ৯০ এর দশক পার করেছে, তাই এদেরকে নাইন্টিন্স কিড বা নব্বই এর সন্তানও বলা হয়। বিশ্ব সংস্কৃতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়। ‘বেবি বুমার্স, জেনারেশন এক্স’ রা এদের মাবাবা। এই প্রজন্মকে মিলেনিয়াল প্রজন্ম বলার কারণ হলো, ২০০০ সালকে কেন্দ্র করে এদের তারুণ্য আবর্তিত হয়েছে। আবার এক্স জেনারেশনের পরের জেনারেশন বলে এদেরকে ওয়াই জেনারেশন বলা হয়েছে। তারা একটি যুগান্তকারী সময়ে বড় হয়েছে। তাদের শৈশব ছিল ডিজিটাল প্রযুক্তির সুবিধাযুক্ত। তারা প্রযুক্তি ব্যবহারে অভ্যস্ত প্রজন্ম।এরা সামাজিক ও পরিবেশগত ন্যায়বিচারের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হিসেবে পরিচিত।

মিলেনিয়াল প্রজন্মের পরের প্রজন্মের নাম জেনারেশন জুমারস, যারা আজকের আলোচিত জেনারেশন জি, বা জেনারেশনজেড, যাদের জন্ম ১৯৯৭২০১২ সালের মধ্যে। এরা ডিজিটাল যুগের প্রথম প্রজন্ম। যারা ছোটবেলা থেকেই ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, আইফোন, গুগল, ফেসবুক, এনড্রয়েড ফোন, ইত্যাদি সামাজিক সাইট, তথা ভার্চুয়াল জগত দ্বারা প্রভাবিত জীবনে অভ্যস্ত। তাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত প্রযুক্তিনির্ভর। তারা এই প্রযুক্তির সাথে এক অদ্ভুত রকমের স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করে। তারা টিভি দেখে শেখে না, তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ারিং করে শেখে, তারা নিজেদের মতো করে শেখে। তবে তারা বাস্তববাদী, সচেতন এবং সতর্ক। জেন জি দের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে একটি হলো, তাদের সামাজিক সচেতনতা এবং অন্তর্ভুক্তি। এরা আসলে বৈচিত্র্যময় প্রজন্ম।

প্রজন্ম জেড বা জেনারেশনজি নিয়ে অলোচনা ও গবেষণা শুরু হয়েছিল ২০১০ সালের দিকে, যখন মার্কিন বিশেষজ্ঞরা ও গবেষকরা ডিজিটাল যুগে বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের বৈশিষ্ট্য ও প্রবণতা বিশ্লেষণ করতে শুরু করেন তখন। মার্কিন গবেষকগণ এই প্রজন্মের বৈশিষ্ট্য, আচরণ, ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রভাব, তাদের ক্রয় প্রবণতা, বই পড়ার সময়, একাডেমিক পারফরম্যান্স ইত্যাদি বিষয়কে নিয়ে একটি ডেমোগ্রাফিক বিশ্লেষণ মূলক রিপোর্ট প্রদান করেন। রিপোর্টে ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় প্রকারের আচরণের সমাবেশ রয়েছে, তবে তা অন্যান্য প্রজন্ম থেকে আলাদা।

তারা সামাজিক প্লাটফর্মগুলো শুধু বিনোদনের জন্য ব্যবহার করে না, তথ্য সংগ্রহ, নেটওয়ার্কিং, এমনকি সক্রিয়তার জন্যও ব্যবহৃত হয়। শিক্ষা ও আত্মউন্নতি তাদের দৈনন্দিন রুটিনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অনলাইন লার্নিং প্লাটফর্মে উল্লেখযোগ্য সময় ব্যয় করে দক্ষতা অর্জন করে, যাতে তাদের ক্যারিয়ারে সাহায্য করে। নতুন ভাষা শেখা, কোডিং বা ডিজিটাল মার্কেটিংযেটাই শেখা হোক না কেন, জেন জি, রা নিজেদের উন্নত করার উপায় খোঁজে। পুরানো প্রজন্মের মতো শুধুমাত্র কাজকে অগ্রাধিকার না দিয়ে, তারা বিশ্রাম ও শখের জন্যও সময় দেয়, তারা বন্ধুদের জন্যও সময় দেয়। ব্যক্তিগত জীবনে জেন জি অভিজ্ঞতাকে সম্পদ রূপে মুল্য দিতে পছন্দ করে। তারা সম্পদ সঞ্চয়ের পরিবর্তে ভ্রমণ, খাবার, এবং প্রযুক্তিতে অর্থ ব্যয় করতে চায়। তাদের মূল্যবোধের এই পরিবর্তন অন্য সব প্রজন্ম থেকে ভিন্ন

প্রকৃতির।

আন্তর্জাতিক রিপোর্ট মতে, তারা সমাজের বিভিন্ন অংশের সমস্যা এবং চ্যালেঞ্জগুলো বোঝে এবং সামাজিক ন্যায় বিচারের জন্য কাজ করে। তারা পরিবেশবান্ধব ধারণাও ধারণ করে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে সচেতন, তাদের জীবন ধারায় পরিবেশ সংরক্ষণ, টেকসই উন্নয়ন এর চিন্তাও সংপৃক্ত থাকে।

অনেক দেশের জেনারেশন জি সদস্যদের বুদ্ধিবৃত্তিক অক্ষমতা এবং মনস্তাত্ত্বিক ব্যাধি নির্ণয়ের সম্ভাবনা পুরোনো প্রজন্মের তুলনায় বেশি। বিশ্বজুড়ে জেনারেশন জি সদস্যদের পূর্বের তুলনায় ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসগুলো তে বেশি সময় ব্যয় করছে, বই পড়ার জন্য কম সময় দিচ্ছে, যার প্রভাবে তাদের মনোযোগের স্থায়িত্ব, শব্দভাণ্ডার, একাডেমিক পারফরম্যান্স হ্রাস পাচ্ছে। বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়েছে, তবে জেন জি সদস্যদের বৈচিত্র্যময় ধারণা ও সাংগঠনিক দক্ষতা, সামাজিক আন্দোলন রাজনৈতিক বিষয় সম্পর্ক, পরিবর্তনে উদ্ভাবনী মনোভাব, ডিজিটাল দক্ষতা এসব এর সম্মিলিত প্রচেষ্টা বিগত অন্য সব প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করার ক্ষমতা রয়েছে।

বাংলাদেশের জেন জি সদস্যদেরও রয়েছে বৈচিত্র্যময় বিভিন্নতা ও পরিবর্তনের অভিনব কৌশল। তারাও বিশ্বজেন জি দের সাথে তাল মিলিয়ে গত ৫ আগস্ট সৃষ্টি করে দেখালো জুলাই বিপ্লব। নানা অন্যায় অত্যাচার, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিনব কৌশলে জনতাসহ সব শ্রেণির মানুষকে একমতে এনে সৃষ্টি করলো যুবকম্প বা যুববিদ্রোহ। ঝড়ের গতিতে ঝরে পড়লো অনেক তাজা প্রাণ। ঘটালো সরকার পতনের মতো বিশাল পরিবর্তন। পরিবর্তন চলছে বিভিন্ন অফিসআদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পাড়া মহল্লা প্রায় সবখানে। এখন অপেক্ষায় থাকা সব ভালো হবে তো! আবার সামপ্রতিক ভয়াবহ বন্যা মোকাবেলায়ও জেন জি দের সাংগঠনিক দক্ষতার প্রশংসা করতেই হয়। এখন সামনের দিন গুলোতে জেন জি, রা মানবজাতির বেঁচে বর্তে থাকা তাদের পূর্ববর্তী জেনারেশনদের কীভাবে আগলে রাখে তাই দেখার অপেক্ষা, এই এক্স জেনারেশন ও ওয়াই জেনারেশনের। আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ সোনার বাংলাদেশ হয়ে উঠুক এই প্রত্যাশা জেন জি দের কাছে।

লেখক: প্রাবন্ধিক, প্রাক্তন অধ্যক্ষহুলাইন ছালেহনূর কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআজাদী চট্টগ্রামের ঐতিহ্য
পরবর্তী নিবন্ধজাতীয় অর্থনীতিতে কক্সবাজারের চিংড়ি-শিল্প