“তখন স্পেনে ফ্যাসীবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চলছে। সেই লড়াইয়ের ছবি তোলার জন্য আমাকে স্পেনে যেতেই হবে, বুঝতে পারছিলাম। ঐ লড়াই সুস্পষ্টভাবে ছিল সঠিক নীতি ও ভ্রান্ত নীতির মধ্যে লড়াই, যেখানে ফ্যাসীবাদ চাইছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভিত্তিভূমি স্থাপন করতে। আমার সহকর্মী হেলেন ভন ভনজেন তখন স্পেনের যুদ্ধের ওপর তোলা সংবাদচিত্রগুলোকে সম্পাদনা করে একটা তথ্যচিত্রের রূপ দেবার দায়িত্ব পেয়েছিলেন। সেই তথ্যচিত্রের লক্ষ্য ছিল যুদ্ধের পটভূমি ও বিভিন্ন দিকগুলিকে মার্কিন জনসাধারণের কাছে তুলে ধরা। হেলেনের কাজটা ছিল কঠিন। কেন না অধিকাংশ সংবাদচিত্রই ছিল ফ্যাসীবাদের পক্ষে, ফ্রাঙ্কর দৃষ্টিকোণ থেকে তোলা। আমি তাকে প্রস্তাব দিলাম সংবাদচিত্রমালার উপর নির্ভর করে ছবি করা ঠিক নয়। কম খরচে ও সবদিক থেকে সার্থক তথ্যচিত্র নির্মাণ করতে হলে ছবির বিষয়বস্তুর ঘটনাস্থলে গিয়ে ছবি বানানো উচিত। (১)
১৯৯৪ সালে কথাগুলো বলেছিলেন চলচ্চিত্রকার ইয়োরিস ইভেন্স, (Joris Ivens) ‘তথ্যচিত্রের জনক’ অভিধায় অভিষিক্ত যে শিল্পী আজন্ম দায়বদ্ধ ও আপোষহীন ছিলেন আপন শিল্পের কাছে। দায়বদ্ধতা, সৎসাহস ও আপোষহীনতা শিল্প ও শিল্পীর এই পূর্বশর্তগুলোর কাছে আজীবন নিষ্ট শিল্পী ইভেন্স ছুটে বেড়িয়েছেন বিশ্বের নানান প্রান্তে শত প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে। চলচ্চিত্রের অপার সম্ভাবনা ও ব্যবহার উপযোগিতা সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল ইভেন্স ততোধিক সচেতন ছিলেন তার অপপ্রয়োগের বিষয়েও। উপরে সন্নিবেশিত তাঁর বক্তব্য থেকেই তা আমরা সহজে বুঝতে পারি। ‘ ‘সেকেন্ডে চব্বিশ ফ্রেম মিথ্যা’ও হতে পারে তার জঘন্য অনেক উদাহরণের একটি–গোয়েবলসের নিকৃষ্ট কান্ডকীর্তি। হিটলারের প্রচারদোসর গোয়েবলস নাৎসীদের পক্ষে প্রচারচিত্র তুলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সত্যের যে অপলাপ ঘটিয়েছিলো তা মানবতাকে চরমভাবে লাঞ্ছিত করেছিল। এ ধরনের ন্যাক্কারজনক ঘটনা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে আরো বারকয় ঘটেছে যা এই শিল্পের সততার সাথে বিশ্বাসঘাটকতা করেছে। তাই ইভেন্স কখনো চলচ্চিত্রকে মিথ্যার বেসাতি করার সুযোগ পেতে দেননি লাঞ্ছনা বঞ্চনা সহ্য করেও। তথ্যচিত্রকে তিনি তথ্যের ভার থেকে মুক্ত করে চলচ্চিত্রের নানান শৈলী ও কাব্যময়তার অসাধারণ সমন্বয়ে তাতে আরোপ করেছিলেন নতুন নতুন মাত্রা।
১৯৯৮ সালের ১৮ নভেম্বরে নেদারল্যান্ডসের নিজমেগেন শহরে এক সম্ভ্রান্ত ওলন্দাজ পরিবারে ইয়োরিস ইভেন্সের জন্ম। ১৮৯৮ চলচ্চিত্রেরও জন্মসাল। পুরো নাম জর্জ হেনরি এনটন ইয়োরিস ইভেন্স। ইয়োরিসদের ছিল দুই পুরুষের ফটোগ্রাফির পারিপার্শ্বিকতার বেড়ে ওঠা ইয়োরিসের মধ্যে স্বভাবতই গড়ে ওঠে ক্যামেরা সাথে আশৈশব সখ্য। চলচ্চিত্র নির্মাণে ইয়োরিসের হাতেখড়ি মাত্র তেরো বছর বয়সে। নিজেদের দোকানের একটি প্যাথে ক্যামেরা দিয়ে চলচ্চিত্রের এই বিস্ময় বালকটি শৈশবেই রেড ইন্ডিয়ান আর সাদা মানুষের গল্প নিয়ে একটি ছবি তৈরি করেন। পরিবারের সকলেরই এতে সোচ্চার উৎসাহ ছিল। ইভেন্স পরিবারের বিভিন্ন সদস্য কিশোর ইয়োরিসের ছবিতে অভিনয়ও করেছিলেন। তারা চেয়েছিলেন ছেলে পারিবারিক ব্যবসায়ে এতে করে আরও মনোযোগী হয়ে উঠবে।
১৯২২ সালে জার্মানির শার্লোটেনবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইয়োরিসকে পাঠানো হলো ফটোকেমিস্ট্রির ওপর পড়াশোনা করতে পারিবারিক ব্যবসার কথা ভেবে। এরপর তাঁকে ব্যবসারই প্রয়োজনে অর্থনীতি নিয়েও পড়াশোনা করানো হয়। কিন্তু ইয়োরিসের মন পড়ে থাকে সিনেমায়। বিশেষ করে ক্যামেরায়। পড়াশোনা ও কর্মসূত্রে ইয়োরিসকে নানা দেশে ঘুরে বেড়াতে হয়। সাথে থাকে ‘আশৈশবের সাথী ক্যামেরা। পরিচিত হতে থাকেন তিনি বিভিন্ন কবি, চারুশিল্পী, চলচ্চিত্রকার, নাট্যকার, কন্ঠশিল্পীদের সঙ্গে। যাঁদের মধ্যেই সের্গেই আইজেনস্টাইন, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, দিমিত্রি পোসতা কোভিচ, পল রবসন ভি. পুদভকিন, ঝিগা, ভের্তভ ছিলেন তাঁর অত্যন্ত কাছের। এরা কখনও ধারাভাষ্যকার, কখনও চিত্রনাট্যকার, কখনও সুরকার, কখনও কন্ঠশিল্পী কিংবা কখনও পরামর্শক হয়ে বন্ধু ইয়োরিসের নানান ছবিতে সাথে সাথে থেকেছেন।
শৈশব থেকেই বিচিত্র বিষয়ের প্রতি ইয়োরিসের সহজাত উৎসুক্য ছিল। ক্যামেরায় ধরে রাখতেন বিচিত্র যত দৃশ্য, বিষয়, মুহূর্ত। ১৯২৮ সালের দিকে ইয়োরিসকে পারিবারিক ব্যবসায়ের দায়িত্ব বুঝে নিতে হয় প্রযুক্তি বিভাগের প্রধান হিসেবে। এই দায়িত্ব ইয়োরিসের পক্ষে বেশ সুবিধাজনকই হয়। তিনি প্রযুক্তি বিভাগের প্রধান হয়ে তার মধ্য দিয়েই তাঁর প্রিয় মাধ্যম চলচ্চিত্রের সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। শুরু থেকেই চলচ্চিত্রের ভিন্ন ঘরানার তথ্যচিত্রের প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল বেশি। চলচ্চিত্রকে নিছক গল্প কাহিনীর মোড়কে না পুরে তিনি চাইতেন প্রামাণিক ও শিক্ষামূলক করে তুলতে। রাজনৈতিক ও সামাজিক নানা অসংলগ্নতাকে কেন্দ্র করে কেবল যে আগমন তথ্যচিত্র তিনি নির্মাণ করেছেন তাই নয়, প্রকৃতি, মানুষ কিংবা যন্ত্র কখনও মূর্ত বা কখনও বিমূর্ত হয়ে ধরা দিয়েছে ইয়োরিসের ক্যামেরায়। তাই বৃষ্টি, ঝড়, তরঙ্গ, নদী, সাগর, বলাকা যেমন উচ্ছ্বাসের নান্দনিকতায় বিমূর্ত হয়ে ওঠে ইয়োরিসের ক্যামেরার যাদুতে, তেমনি মূর্ত হয়ে ওঠে একটি সেতু, একটি কল, একটি কারখানা বা একটি গাড়ি। আর–তাই বিশ্বচলচ্চিত্রের ঝাঁপিতে সঞ্চয়িত হয় ‘সং অফ রিভার’ ‘ব্রিজ’ ‘ফিলিপস’ ‘রেইন’ ‘আ–টেল অফ দ্য উইন্ড’ ‘দ্য স্প্যানিশ আর্থ, এ ভ্যালপারাইসে’ ‘ভিয়েতনাম ইন ওয়ার’ ‘ফার ফ্রম’–এর মতো স্মরণীয় তথ্যচিত্র।
‘তথ্যচিত্রের জনক’ ইয়োরিস ইভেন্স চলচ্চিত্রের এই বিশেষ ধারা প্রতিষ্ঠিত সুনির্ধারিত এক গঠনশৈল্পীতে। আজীবন তিনি ভেবেছেন তথ্যচিত্রের বিন্যাস আঙ্গিক নিয়ে। তিনি বলতেন, “আমি একটা ব্যাপার খুব অবাক হয়ে যাই যে বেশীরভাগ লোকই এইরকম ভাবে যে, কোনো তথ্যচিত্র অবশ্যই অবজেকটিভ হবে। কিন্তু আমার কাছে তথ্য ও তথ্যমূলক এই দুই শব্দের পার্থক্য খুব পরিষ্কার। বিচারের সময় পেশ করা সাক্ষ্যে আমরা কী বৈষয়িকতা চাইবো না উদ্দেশ্যমূলকতাই সেখানে লক্ষ্য? তথ্যচিত্র নির্মাণের সময় একটা শক্তিশালী কেন্দ্রীয় বিষয় ছাড়াও রাখতে হয় এমন কিছু ঘটনা যা ঐ কেন্দ্রীয় বিষয়কে যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত করে। এইসব টুকরো ঘটনাধারা প্রায়ই অত্যন্ত মূল্যবান হয়ে ওঠে। কখনো কখনো সংবাদ চিত্রগ্রাহকের ভূমিকা গ্রহণ করতে হয় কিন্তু কোনো ঘটনাকেই কখনো শুধু তার ‘সংবাদমূল্য’ দিয়ে বিচার করা ঠিক নয়। আপাত সাধারণ সংবাদমূল্যের ঘটনাও ছবির সমগ্র কাঠামোর পক্ষে অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠতে পারে।” (২)
তথ্যচিত্রের ক্ষেত্রে বিশ্বের প্রায় সবকটি স্বীকৃতিই অর্জন করেছেন ইয়োরিস ইভেন্স। পেয়েছেন বিশ্ব শান্তি পরিষদ (World peace council) এর আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কার–চলচ্চিত্রকে বিশ্বশান্তির মাধ্যমে পরিণত করার স্বীকৃতি স্বরূপ। এই একই কারণে কার্লোভি ভ্যারি চলচ্চিত্র উৎসব পরিষদও শান্তির এই দূতকে শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করেছিল।
জীবনের শেষ দিনগুলিতেও নিজেকে নিরবচ্ছিন্ন রেখেছেন চলচ্চিত্রের সঙ্গে। হুইল চেয়ারে কিংবা পালকি চেয়ারে বসেও উপস্থিত থেকেছেন শুটিং–এ। ১৯৮৯ সালে মৃত্যুই কেবল তাঁকে বিচ্ছিন্ন করতে পেরেছিল তাঁর প্রিয় মাধ্যম চলচ্চিত্র থেকে। ইয়োরিস ইভেন্স বলতেন, “আমি তথ্যচিত্র নির্মাণ করি ও করে যাবো এই কারণে যে, আমি জানি আমি যা বিশ্বাস করি ও আমি যে কাজ করি তার মধ্যে সাদৃশ্য আছে। যেদিন আমি বুঝবো এই ঐক্য বা সাদৃশ্য হারিয়ে গেছে সেদিনই আমি আমার পেশা পরিবর্তন করবো। পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলিতে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ সম্পর্কে একজন তথ্যচিত্র নির্মাতাকে সবসময়ই সচেতন থাকতে হয়, যে চেতনা সবচেয়ে অগ্রসর স্টুডিও চিত্রনির্মাতার পক্ষেও অর্জন করা কঠিন।(৩)
বলাবাহুল্য সেই দিনটি ইয়োরিসের জীবনে আসেনি। কর্ম ও বিশ্বাসের ঐক্য কোনোদিন হারায়নি তাঁর জীবনে। শোষিত মানুষের মুক্তির পক্ষে সোচ্চার থেকেছেন। তাদের সংগ্রামে সংহতি প্রকাশ করেছেন। তাদেরকে শোষনের প্রতিবাদে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে তাঁর নির্ভীক ক্যামেরা। ঔপনিবেশিক কর্তৃত্বের প্রতিবাদে স্বদেশি প্রতিষ্ঠান ‘ফিল্ম কমিশন অব নেদারল্যান্ডস ইস্ট ইন্ডিজ’–এর মহাকর্তৃত্বময় পদ থেকে অবলীলায় পদত্যাগ করেছেন। আপোষহীন শিল্পী ইয়োরিস ১৯৮৯ সালের ২৮ জুন প্যারিসে প্রয়াত হন।
নিজের দায়িত্ব ও কর্মদর্শন সম্পর্কে আজীবন সচেতন এই নিরলস চলচ্চিত্রকর্মী একজন তথ্যচিত্র নির্মাতার দায়িত্ব সম্পর্কে বলেছিলেন, “আমি মনে করি, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে লেখকের দায়িত্ব সম্পর্কে যে কথা বলেছিলেন সেই কথা তথ্যচিত্র নির্মাতার দায়িত্ব সম্পর্কেও সমভাবে প্রযোজ্য হতে পারে ‘ লেখকের সমস্যা পালটায় না লেখক পালটালেও তাঁর সমস্যা একই থাকে। এবং তা হলো কী করে বিশ্বস্তভাবে লিখতে হয় তা জানা এবং সত্য কী তা খুঁজে পেয়ে তাকে এমনভাবে উপস্থাপিত করা যে তা পাঠকের অভিজ্ঞতার অংশবিশেষ হয়ে ওঠে।” (৪)
(১,২,৩,৪ অজয় সরকার অনূদিত)