বিশ্বের অন্যতম গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব এবং নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস উদ্যোগ না নিলে আমার ডেডবডি হয়তো দেশে আসত, আমি আসতে পারতাম না। বৃদ্ধ বাবা–মাকে শেষ দেখাও দেখতে পেতাম না। আজ যে আমি এদেশে বাবা–মায়ের বুকে ফিরে এসেছি সেটা একমাত্র প্রফেসর ইউনূস স্যারের জন্যই সম্ভব হয়েছে। অন্যথায় আমিরাতের কড়া কানুন ভেদ করে আমাদের দেশে ফেরা সম্ভব হতো না। উনি না হলে আমরা পচে মরতাম। এভাবে বলছিলেন আমিরাতের কারাগার থেকে সাধারণ ক্ষমা পেয়ে দেশে ফেরা সাইদুল হক। আমিরাতের ধনাঢ্য এই ব্যবসায়ী সর্বস্ব হারিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। অন্যদের মতো তাদের পাসপোর্টেও ‘নো এন্ট্রি’ সিল দেওয়া হয়েছে বলে শুনেছেন। ‘নো এন্ট্রি’ সিল দেওয়া হলে তারা আর আরব আমিরাতে ফিরে যেতে পারবেন না। অথচ ওখানে তার স্ত্রী–সন্তান এবং কয়েক কোটি টাকার সম্পদ রেখে আসতে হয়েছে।
সাইদুল হক দুঃখ করে বলেন, ১৫ দিন আগে আমার একটি কন্যাসন্তান হয়েছে। আমার বাচ্চাটিকে আমি কোলে নিতে পারিনি। এক কাপড়ে এবং স্যান্ডেল পরে দেশে এসেছি। তবুও সান্ত্বনা এই যে, বাবা–মায়ের বুকে ফিরে আসতে পেরেছি। গতকাল রোববার নগরীর রহমান নগরের বাসভবনে বসে সাইদুল আজাদীকে বলেন, আমাদের জন্য ড. ইউনূস যা করেছেন তার ঋণ এই জীবনে শোধ করা সম্ভব নয়। তার জন্য শুধু অন্তর থেকে দোয়া করছি। এখন যদি তিনি উদ্যোগ নেন, ‘নো এন্ট্রি’র অভিশাপ যেন আমাদের পাসপোর্টে না পড়ে তার ব্যবস্থা করলে আমাদের শেষ রক্ষা হয়। আমাদের বিশ্বাস, প্রফেসর ইউনূস সাহেব চাইলেই সেটা সম্ভব।
সাইদুল হক কারাগারের স্মৃতি বর্ণনা করে বলেন, কোটাবিরোধী আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করে আমরা মিছিল করেছিলাম। অনেকেই মিছিলে ছিলেন। আমাদের আটক করা হয়। আটকের পর আমাদেরকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়ে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ছোট্ট একটি রুমে ৩২ জনকে রাখা হয়েছিল। অন্য কোনো নির্যাতন না করলেও ছোট্ট একটি রুমে একসঙ্গে ৩২ জনের বসবাস আমাদের অতিষ্ঠ করে তুলেছিল।
২২ বছর ধরে আমিরাতে বসবাস এবং ব্যবসা করার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমিরাতের কানুন খুবই কড়া। আমাদের যখন বিভিন্ন মেয়াদের জেল দেওয়া হলো, তখন আমরা নিশ্চিত ছিলাম সাজা শেষ হওয়ার আগে মুক্তি জুটছে না। তিনি বলেন, মা–বাবার দোয়া ছিল, আল্লাহর রহমত ছিল। প্রফেসর ইউনূস ক্ষমতায় বসার পর আমাদের মুক্ত করার ব্যবস্থা করলেন। তিনি উদ্যোগ না নিলে অন্য কারো পক্ষে আমাদের মুক্ত করা সম্ভব ছিল না। প্রফেসর ইউনূসের গ্রহণযোগ্যতাই তাদের মুক্তির পথ সুগম করেছে করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন আমাদেরকে আবার সেখানে ফেরত যাওয়ার ব্যবস্থাও একমাত্র তিনি করতে পারেন।
পূর্ব রাউজানের হরিশখাইন পাড়ার আবদুল আজিজ মুন্সি বাড়ির সাইদুল হক আমিরাতে ব্যবসা করেন। ২০১০ সাল থেকে গত ১৪ বছর পরিবার নিয়ে বসবাস করেন সেখানে। তিনি বলেন, ওখানে আমার স্ত্রী এবং তিন সন্তান রয়েছে। আমার বড় মেয়ে ইন্ডিয়ান স্কুলে ক্লাস সেভেনে পড়ে। ছেলে ক্লাস ওয়ানে পড়ে, বয়স ৭ বছর। ১৫ দিন আগে আরেকটি মেয়ে হয়েছে। ওকে কোলেও নিতে পারিনি।
আরব আমিরাতের আল আইনে দুটি স্টিল ওয়ার্কশপ, গাড়ি এবং ফ্ল্যাটের ব্যবসা থাকার কথা উল্লেখ করে সাইদুল বলেন, আমাকে সবকিছু ফেলে আসতে হয়েছে। যদি ফিরে যেতে না পারি তাহলে আমার সবকিছুই শেষ হয়ে যাবে।
হাটহাজারীর তিন প্রবাসীর কথা : হাটহাজারী প্রতিনিধি জানান, আমিরাতের কারাগার থেকে বিশেষ ক্ষমায় মুক্তি পাওয়া হাটহাজারীর তিন প্রবাসী ঘরে গিয়ে দেখা যায়, স্বজন ফিরে আসায় তিন বাড়িতেই ঈদের আনন্দ চলছে। শনিবার রাতে তারা নিজ বাড়িতে ফিরে আসার পর থেকে স্বজনেরা আনন্দে আত্মহারা। গতকাল ভোর থেকে প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজন দলে দলে তাদের বাড়িতে ভিড় করছেন।
হাটহাজারীর ৩ নং মির্জাপুর ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ডের চতরপাড় এলাকার মোহাম্মদ জসিম উদ্দিনের পুত্র মেহেরাজ উদ্দীন রাসেল (২৪) জানান, তিনি আমিরাতের সারজাহ এলাকায় একটি হার্ডওয়্যারের দোকানে চাকরি করতেন। তিন বছর আগে আমিরাতে যান। সাত মাস পূর্বে ছুটি কাটিয়ে বাড়ি থেকে যান। ১৯ জুলাই কর্মস্থল থেকে বাসায় এসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেশে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহতদের রক্ত দেখে ক্ষোভে ফেটে পড়েন এবং বেশ কিছু বাংলাদেশি রাস্তায় বিক্ষোভ করেন। বিক্ষোভের ছবি সামাজিক মাধ্যমে প্রচার হলে সে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের আটক করে। আটকের পর তাদেরকে আবুধাবির হালু হাজতা কারাগারে নিয়ে যায়। প্রথম দিন তাদের ওপর শারীরিক নির্যাতন করা হয়। তারা ভাবতে পারেননি আন্দোলনকারীদের সাথে সংহতি প্রকাশ করলে তাদের এই করুণ পরিণতি হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস উদ্যোগ না নিলে আমাদের মুক্তি পাওয়া কোনোদিনই সম্ভব হতো না। এই সহযোগিতার জন্য তিনি সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি পুনরায় যাতে সেখানে যেতে পারেন তার ব্যবস্থা করার জন্যও সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
মো. হারুন (৪৪) বলছিলেন কীভাবে কী হয়েছিল। ৮ নং মেখল ইউনিয়নের ৪ নং ওয়ার্ডের রহমত কাজী বাড়ির মৃত শরীফ উদ্দিনের পুত্র মো. হারুন পুলিশের হাতে আটক হওয়ার কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, দেশ থেকে ছুটি কাটিয়ে নিজ কর্মস্থল আল–আইনের সানাইয়া এলাকায় ফিরে যাই। সেখানে ছোটখাটো ঠিকাদারির কাজ করি। ১৯ জুলাই মাগরিবের পর প্রবাসী কিছু বাংলাদেশি জড়ো হয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমর্থনে মিছিল করলে পুলিশ আসার সাথে সাথে সবাই যে যার মতো নিরাপদ স্থানে সরে যাই। পরে রাত তিনটার দিকে হারুনের মোবাইলে আরব আমিরাতের সিআইডি ফোন করে। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরে তা দেখেন তিনি। পরে সকালে পুনরায় ফোন আসে একই নম্বর থেকে। কথা হলে সিআইডি পরিচয় দিয়ে তাকে অফিসে যেতে বলেন। অফিসে গেলে নাম–ঠিকানা জেনে বিদায় দেয়। ২১ জুলাই তাকে পুনরায় সিআইডি অফিসে যেতে বলে। ওইদিন গেলে গ্রেপ্তার করা হয়। সেখানে গিয়ে একই অপরাধে আটক আরো কযেকজন বাংলাদেশির সাথে দেখা হয়। পরে আরব আমিরাতের আইন বিরোধী কাজ করার অপরাধে তার দশ বছর সাজা হয়। খবরটি শোনার পর জেলে সবাই কান্নাকাটি করে।
তিনি বলেন, ওই জেলে আসা এক সৌদি নাগরিকের কাছে দেশে সরকার পতনের খবর পাই। ওই ব্যক্তি জানান, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়া ড. মুহাম্মদ ইউনুস তাদের মুক্ত করার জন্য কাজ করছেন। তিনি সেদিন বলেছিলেন, আমরা সবাই দ্রুত মুক্ত হয়ে যাব। তার কথাই সত্যি হয়েছে। আমাদের দেশের গর্ব ড. ইউনুস স্যার আমাদের নতুন জীবন দিয়েছেন। আমরা তার কাছে চির কৃতজ্ঞ। এই ঋণ আমি কখনো শোধ করতে পারব না।
হাটহাজারীর গড়দুয়ারা ইউনিয়নের প্রবাসী জাহাঙ্গীর বলেন, সেদিন আমি আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ছিলাম। আমাকেও ১০ বছরের সাজা দিয়েছিল আমিরাত সরকার। যদি ড. ইউনুস স্যার আমাদের মুক্ত করার ব্যবস্থা না করতেন তাহলে আমার জীবন থেকে দশটি বছর হারিয়ে যেত।
উল্লেখ্য, ১৯ জুলাই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিক্ষোভ মিছিল করার অপরাধে ৫৭ জন বাংলাদেশিকে আটক করে দেশটির পুলিশ। দেশটিতে বিক্ষোভ করা অবৈধ হওয়ায় তাদেরকে আটকের পর বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে তিনজনকে যাবজ্জীবন, ৫৩ জনকে ১০ বছর এবং বাকি একজনকে ১১ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
২৮ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে টেলিফোনে অভিনন্দন জানান সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান। তখন টেলিফোনে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত বাংলাদেশিদের মুক্তির অনুরোধ জানিয়েছিলেন ড. ইউনূস। তার অনুরোধের প্রেক্ষিতে ৩ সেপ্টেম্বর সকালে কারাবন্দি ৫৭ বাংলাদেশির সাজা মওকুফ করে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। মুক্তি পাওয়ার পর শনিবার রাতে ৫৭ জনের মধ্যে ১২ জন দেশে ফিরে আসেন। এদের মধ্যে একজন ছাড়া বাকি সবার বাড়ি চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায়।