আমরা কি এগিয়েছি নাকি পিছিয়ে?

চট্টগ্রামে বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণা

ড. আদনান মান্নান | রবিবার , ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ at ৮:২৪ পূর্বাহ্ণ

কোভিডের সময় কেন চট্টগ্রামের এরকম ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল? ডেঙ্গু কেন প্রতি বছর চট্টগ্রামে ফিরে আসে? কেন ডেঙ্গুর প্রকোপ কমানো যাচ্ছে না? জলাবদ্ধতা নিরসনে কেন কার্যকর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি উঠে আসছে না? কেন ট্রাফিক জ্যাম নিয়ন্ত্রণে নেই ডিজিটাল সমাধান? এর উত্তর হল, চট্টগ্রামের বেশিরভাগ সমস্যা নিয়েই পর্যাপ্ত গবেষণা নেই, নেই যথার্থ পৃষ্ঠপোষকতা। কারণ বিজ্ঞান চর্চায় চট্টগ্রামে যতদূর এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল ততদূর যেতে পারেনি আমাদের এই শহর। এখান থেকে নেই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উদ্ভাবন, হচ্ছে না বিজ্ঞানভিত্তিক পণ্যের বাণিজ্যিকীকরণ। এর মাঝেও আছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা এবং প্রকাশনা। একটি দেশের এবং একইসাথে একটি শহরের এগিয়ে যাওয়া অনেকটুকু নির্ভর করে তার নিজস্ব প্রযুক্তি, উদ্ভাবন ও সমস্যা সমাধানের সক্ষমতার ওপর। এজন্যই প্রয়োজন বিজ্ঞান চর্চা, বিজ্ঞান গবেষণায় পৃষ্ঠপোষকতা এবং বিজ্ঞানীদের মূল্যায়ন।

স্কুপাস এর তথ্য অনুযায়ী, বিগত তিন বছরে চট্টগ্রাম থেকে সবচেয়ে বেশি বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (প্রতি বছর পাঁচ শতাধিক)। এর পরে রয়েছে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং চুয়েট। এর পরেই রয়েছে আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, বিজিসি ট্রাস্ট বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইউএসটিসি। গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) থেকে বেশ কিছু মানসম্পন্ন প্রকাশনা দেখা গেছে সামপ্রতিক সময়গুলোতে। এক্ষেত্রে কিছুটা পিছিয়ে আছে বন গবেষণা ইন্সটিটিউট, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিকাল এন্ড ইনফেকসিয়াস ডিজিসেস (বিআইটিআইডি) এবং পরমাণুশক্তিকেন্দ্র,-চট্টগ্রাম। তবে তাদের ল্যাবরেটরির সামপ্রতিক উন্নয়ন সক্ষমতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।

চট্টগ্রাম এগিয়ে রয়েছে সমুদ্র বিষয়ক গবেষণায়। সাগরে বিভিন্ন নতুন প্রজাতির উদ্ভিদ, প্রাণী ও মাছ সনাক্তকরণ, সাগরে প্লাস্টিক দূষণ ও সেন্ট মার্টিনে জীববৈচিত্র্য নিয়ে গবেষণা হয়েছ প্রশংসিত। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন সায়েন্স অনুষদ এই ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। পরিবেশ বিষয়ক গবেষণায় চট্টগ্রামের গবেষকগণ বেশ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছেন। কার্বন নিঃসরণ হ্রাস, উদ্ভিদের বিভিন্ন চারিত্রিক পরিবর্তন, মাটির গুণগত মান নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অফ ফরেস্ট্রি, হালদা রিসার্চ ল্যাব, মৃত্তিকাবিজ্ঞান ও ভূগোল বিভাগের গবেষণা চলমান। চট্টগ্রামে ঔষধি উদ্ভিদ নিয়ে প্রচুর গবেষণা হয় এবং সবচেয়ে বেশি প্রকাশনা এই ক্ষেত্রে। এছাড়াও রয়েছে উদ্ভিদের বৈচিত্র্য ও বৃদ্ধি নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা। চট্টগ্রামের রসায়নবিদরাও অনেক গবেষণা করছেন। তার মাঝে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ন্যানোপার্টিকল বা ক্ষুদ্র কণা উদ্ভাবন যা ঔষধশিল্পে কাজে লাগবে। রোবটিক্স নিয়েও গবেষণা করছেন চুয়েট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা, তবে বাণিজ্যিকভাবে এখনও কোনো রোবট চট্টগ্রাম থেকে দেখা যায়নি।

গবাদি পশুর রোগ নির্ণয়, উৎসস্থল অনুসন্ধান, চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বেশ প্রশংসিত হয়েছে। তারা একদিকে যেমন সেবা দিচ্ছে, অন্যদিকে খ্যাতনামা সব আন্তর্জাতিক প্রকাশনা হচ্ছে নিয়মিতভাবেই। তরুণদের মাঝে ভীষণ জনপ্রিয় কম্পিউটারভিত্তিক গবেষণার ক্ষেত্র বায়োইনফরমেটিক্স। তথ্যপ্রযুক্তিকে ব্যাবহার করে ঔষধের নকশা প্রস্তুত করণের অনেক গবেষণা করছে এ সময়ে তরুণ গবেষকেরা।

স্বাস্থ্য বিষয়ক গবেষণা অনেক হচ্ছে চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছে। পিছিয়ে নেই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল, এবং চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল। কোভিডে বেশ কিছু গবেষণা হয়েছে চট্টগ্রামে, ডেঙ্গু নিয়ে খুব বেশি গবেষণা আগে না হলেও গত বছর এ যাবতকালের বৃহত্তম গবেষণা প্রকল্প দেখা যায়, যাতে সাতটি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে কাজ করে। এছাড়াও এক্টিবায়োটিক এর অকার্যকারিতা, অটিজম, সংক্রামক ব্যাধি, ডায়বেটিস, ক্যানসার, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি সমস্যা, স্থুলতা, শিশু স্বাস্থ্য নিয়ে বেশ কিছু গবেষণা প্রকল্প চলমান।

বেসরকারি ভাবে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে কিছু গবেষণার উদ্যোগ সামপ্রতিক সময়ে দেখা গেলেও সংখ্যায় খুব কম। নিরাপত্তা ডিভাইস, কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা, আইওটি নিয়ে কাজ করে “স্টেলার”, স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে কাজ করছে “এসপেরিয়া হেলথ রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট ফাউণ্ডেশন”, সামাজিক সমস্যা নিয়ে কাজ করছে ”ইপসা”।

তথ্য প্রযুক্তি গবেষনণয় চট্টগ্রাম অনেক অনেকদূর এগিয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও অতটা আগায়নি। অনেক বেশি এপস, ডিজিটাল সেবা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য প্রযুক্তি গবেষণাগার থেকে প্রত্যাশিত ছিল।

চট্টগ্রামের আঞ্চলিক সমস্যাগুলো নিয়ে কারো কোন মাথা ব্যথা নেই। জলাবদ্ধতা থেকে উত্তরণ, যানজট, প্লাস্টিক দূষণ, মশক নিধন, নারীদের নিরাপত্তা, আয়োডিন সমস্যা ও চট্টগ্রামে অত্যধিক থাইরয়েড এবং গলগণ্ডের রোগী কেন বেশি, পানির মান, খাবারে বিষক্রিয়া, ভূমিধস, নদীর নাব্যতা এসব নিয়ে অনেক বেশি গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। দুঃখের জায়গাটা হল, উদ্ভাবনে অনেক পিছিয়ে চট্টগ্রাম। এখন পর্যন্ত টেকসই তেমন কোনো উদ্ভাবন দেখা যায়নি এখান থেকে সামপ্রতিক সময়গুলোতে। সমুদ্র বিজ্ঞান গবেষকদের কিছু উদ্ভাবন, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ডিভাইস এবং প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে নিরাপত্তারক্ষী ডিভাইস ছাড়া তেমন কোন উদ্ভাবন চোখে পড়েনি। অনেক বেশি উদ্ভাবনী গবেষণা হওয়া প্রয়োজন চট্টগ্রাম থেকে।

আমরা বেশ কিছু ক্ষেত্রে এগিয়েছি। ২০১০ সালের তুলনায় তিন চারগুণ বেশি আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় চট্টগ্রাম থেকে। চট্টগ্রাম থেকে অনেক বেশি ছেলেমেয়ে এখন বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে মাস্টার্স ও

পিএইচডি করতে আন্তর্জাতিক বৃত্তি পাচ্ছে। গত বছর তিনশত’র ও বেশি ছাত্রছাত্রী গেছে উচ্চশিক্ষায়। বেশ কিছু বড় বড় গবেষণা প্রকল্পের নেতৃত্ব দিচ্ছে চট্টগ্রামের গবেষকগণ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জিনোম সিকুয়েন্সিং ল্যাব।

কিন্তু আমাদের নিজেদের সমস্যা আমাদেরকেই সমাধান করতে হবে। অনেক বেশি গবেষণাবান্ধব একটি পরিবেশ চাই। অনেক বেশি গবেষণার অর্থায়ন চাই। উন্নত দেশগুলোর মত এখানেও সমাজের বিত্তশালীদের এগিয়ে আসতে হবে। কর্পোরেটদেরকেও গবেষণার গুরত্ব উপলব্ধি করে অর্থায়ন করতে হবে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সম্বন্বিত যৌথ গবেষণা এবং এরকম প্ল্যাটফর্ম খুব প্রয়োজন। আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে?

 

লেখক : অধ্যাপক, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅভ্যন্তরীণ সম্পদের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার
পরবর্তী নিবন্ধবাংলাদেশের অর্থনীতিতে চট্টগ্রাম কি ন্যায্য গুরুত্ব পাচ্ছে?