সমকালের দর্পণ

মেজর মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম (অব.) | রবিবার , ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ at ৭:৩৮ পূর্বাহ্ণ

বিগত ২৫ আগস্ট ২৪ বাংলাদেশে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দশ লক্ষের ও অধিক মানুষের আশ্রয় গ্রহণের সাত বছর পূর্ণ হয়। আমাদের ইলেট্‌রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়া ইতিপূর্বের বছরগুলোতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়টি সামনে এনে এ প্রসঙ্গে সব সময় সোচ্চার হতে দেখা গেছে। এবছর তার ব্যতিক্রম। ২৫ আগস্ট এবার কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমের ক্ষীণ স্বর ছাড়া তেমন কোন উচ্চবাচ্য পরিলক্ষিত হয়নি। উল্লেখ্য আমাদের মনোযোগ রোহিঙ্গাদের ঘিরে স্তিমিতের পর্যায়ে পৌঁছালেও আমাদের সন্নিহিত অঞ্চল রাখাইন ভূরাজনীতির দোলাচালে ক্রমশ আমাদের জন্য নিরাপত্তার ঝুঁকি তৈরি করে চলেছে। এ ঝুঁকির বিষয়টি পর্যালোচনার পূর্বে রাখাইনের সর্া্বিক উদ্ভূত পরিস্থিতি আলোচনা সমীচীন বলে আমার কাছে প্রতীয়মান।

আরাকান তথা রাখাইন খুব বেশি সময়ের জন্য বার্মার তথা বার্মিজদের শাসনাধীনে ছিল না। যে কিছুদিন ছিল তাও আরাকানিজদের বিদ্রোহে তা ছিল টালমাটাল। এর মাঝে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং ভয়াবহ বিদ্রোহের মশাল প্রজ্জলিত করেন ১৮১১ সালে চিনবাইন। সে বিদ্রোহ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলে আরাকানের মানুষদের উপর নেমে আসে অবর্ণনীয় নির্যাতন আর নিষ্পেষণ।

খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩২৫ থেকে ১৭৮৪ অব্দ পর্যন্ত আরাকান ছিল এক স্বাধীন সত্তা। এই সময় কালে ২৪৩ জন শাসক আরাকান শাসন করেন। বার্মা’রা ১৭৮৪ থেকে ১৮২৪ সাল অর্থাৎ এই ৪০ বছর আরাকান শাসন করার সুযোগ পায়। এই সময়কালে বার্মিজদের হাতে ২ লক্ষ ৩৬ হাজার আরাকানিজ নিহত হয়। উল্লেখ্য বার্মাদের বিরুদ্ধে দ্বন্দ্ব সংঘাতে আরাকানিজরা কখনো বিভক্ত ছিল না। রোহিঙ্গা বা রাখাইন এধরনের বিভক্তি রাখাইনে কখনো মাথাচারা দেয়নি।

রাখাইন বা তৎকালীন আরাকানের কপালে বিভক্তির কলঙ্ক তিলক প্রথম এঁকে দেয় বৃটিশরা। ১৯৪২ সালে বৃটিশরা দ্বিতীয় বিশযুদ্ধকালীন সময়ে রোহিঙ্গাদের জাপানিজদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে। রাখাইনরা পক্ষ নেয় জাপনিজদের। সেই থেকে রাখাইনে দুটি জনগোষ্ঠীর বিভক্তির আর পারস্পরিক সংঘাত সংঘর্ষ হানাহানির জন্ম যা আজ অবধি বিদ্যমান।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়েও বার্মারা রাখাইনে তাদের শাসন নির্বিঘ্ন রাখার জন্য রোহিঙ্গা এবং রাখাইন দ্বন্দ্বকে ইন্ধন দিয়ে এসেছে। যার প্রকৃষ্ট প্রমাণ জেনারেল নে উইন কর্তৃক ১৯৬২ সালে উ নু’র কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করার পর ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৮ রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অপারেশন ‘নাগামিন’। ৩১ জুলাই ৭৮ পর্যন্ত পরিচালিত এ অপারেশনের মৌল উদ্দেশ্য ছিল রাখাইনের লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলিমকে রাখাইনে অবৈধ এবং অনুপ্রেবেশকারী হিসাবে চিহ্নিত করে তাদের পিতৃভূমি থেকে বিতাড়ন। একই উদ্দেশ্যে ক্রমান্বয়ে রোহিঙ্গাদের ভোটাধিকার, নাগরিকত্ব এবং চুড়ান্তভাবে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট অপারেশন ‘ক্লিনজ’ নাম দিয়ে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেই থেকে ১০ লক্ষের উপর রোহিঙ্গাদের আমাদের দেশে অবস্থান।

দুর্ভাগ্য রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে আমরা এ যাবৎ কোন ফলপ্রসূ উদ্যোগ গ্রহণে কেবল ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েই এসেছি।

আমাদের দুর্ভাগ্য রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে আমরা আজ পর্যন্ত সর্বদলীয় একটি সমন্বিত অবস্থান গ্রহণ করতে পারিনি। অথচ ৫ আগস্ট আমাদের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নিলে ভারতীয় ক্ষমতাসীনরা মহূর্ত বিলম্ব না করে শেখ হাসিনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণার্থে সর্বদলীয় বৈঠক আহবান করেন। সে বৈঠকে বিরোধী দলীয় নেতা শ্রী রাহুল গান্ধীসহ ৩০ জন বিভিন্ন দলের নেতা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য উপস্থিত হন। এই বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রী এস জয়শংকর পার্লামেন্টকে পুরা বিষয় অবহিত করে বিবৃতি প্রদান করেন।

লজ্জার এবং পরিতাপের বিষয় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের মত একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বা এ প্রসঙ্গে করণীয় সম্পর্কে আমাদের জাতীয় বা সর্বদলীয় কোনো অবস্থান নেই। আমার মতে প্রত্যেক জাতির জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহের উপর একটি জাতীয় ঐক্যমত্য এবং সমন্বিত প্রয়াস থাকা বাঞ্জনীয়।

রাখাইনের বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে গেলে দেখা যাবে আমাদের জন্য বিশেষ করে ভবিষ্যৎ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়টি কি জটিল রূপ ধারণ করতে যাচ্ছে। বর্তমানে রাখাইন অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা আরাকান আর্মির দখলে। চিন স্টেটের প্লাটোয়াকে তাদের সদর দপ্তর বানিয়ে আরাকান আর্মি ক্রমাগত পশ্চিম মুখি তাদের অভিযান পরিচালনা করে এসেছে। তাদের এ অভিযানে তারা একে একে মিনবু, ম্‌্রাউ, পকতো, বুথিডং তাদের দখলে নিয়েছে। বর্তমানে মায়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে মংডো এবং থানডোয়ে ঘিরে আরাকান আর্মির যুদ্ধ চলমান। দুটি অঞ্চলই উভয় পক্ষের জন্য যথেষ্ট গুরুত্ব বহ। মংডো থেকে পশ্চিমে গেলে বঙ্গোপসাগর। এই সাগর পথ রসদ সরবরাহের জন্য উন্মুক্ত রাখা মায়ানমার সেনাবাহিনীর জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি বন্ধ করতে পারাটাও আরাকান আর্মির জন্য হবে যুদ্ধ জয়ের বড় ধাপ। দক্ষিণের থানডোয়ের ক্ষেত্রে একই বক্তব্য প্রযোজ্য।

অতীতে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধকালীন বৃটিশরা বা পরবর্তীতে জেনারেল নে উইন রা রাখাইনরোহিঙ্গাদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করে স্বীয় স্বার্থ সিদ্ধি করে। ঠিক একই কায়দায় বর্তমানে রাখাইনে মায়ানমার সেনাবাহিনী এবং আরাকান আর্মি’র চলমান যুদ্ধে মায়ানমার সেনাবাহিনী জোরপূর্বক বা প্রলোভনের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের নিজ পক্ষে টেনে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে অস্ত্র সজ্জিত করে মাঠে নামিয়েছে। এ প্রসঙ্গে যে জটিলতা আমাদের মোকাবেলা করতে হবে তা হল রোহিঙ্গা এবং রাখাইনদের বর্তমান যুদ্ধ ক্ষেত্রে মুখামুখি অবস্থানটা ভবিষ্যৎ এ দুপক্ষ পরস্পরকে কীভাবে গ্রহণ করবে। অবশ্য এ প্রশ্ন আসবে আরাকান আর্মি রাখাইন স্টেটে পুরাপুরি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারলে তখন?

তবে এখনও রোহিঙ্গারাখাইন বৈরীতার কিছু আলামত আমাদের সামনে বিদ্যমান। যেমন বুথিডং, পউক্তো অভিযানে আরাকান আর্মি সফল হলে তারা সে অঞ্চলের রোহিঙ্গাদের বাড়ী ঘরে আগুন দেয়। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত মংডো’তে এখন দুপক্ষ যুদ্ধরত। রোহিঙ্গারা মংডোতে আরাকান আর্মির দখল প্রতিষ্ঠিত হতে পারে সে আশংকায় পালাতে থাকলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না। ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ এক প্রেস ব্রিফিংএ অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা জনাব তৌহিদ হোসেন গত কয়দিনে নতুন করে আট হাজার রোহিঙ্গার বাংলাদেশে প্রবেশের কথা উল্লেখ করেছেন। আমার কাছে এটি রোহিঙ্গাদের প্রতি আরাকান আর্মির বৈরিতা প্রসূত ফলশ্রুতি বলেই অনুমিত।

মায়ানমারের ভূরাজনীতি, ভূকৌশল এবং অর্থনীতিতে চীনের ভূমিকা বরাবরই মূখ্য ছিল এখনও তাই আছে। চীন তার বিপুল বিনিয়োগ, বেল্ট রোড ইনিসিয়েটিভ, ভূরাজনীতির স্বার্থ সংরক্ষণে মায়ানমারকে তার সকল বিবেচনায় অগ্রাধিকার দিয়েই কৌশল প্রণয়নে সচেষ্ট থাকবে এটি নিশ্চিত।

কালাদান মাল্টি মোডাল মাল্টি মিলিয়ন ট্রানজিট প্রজেক্ট মায়ানমারকে ঘিরে ভারতের অগ্রাধিকার মূলক একটি প্রকল্প। একই সাথে মায়ানমারকে ঘিরে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য সমূহের নিরাপত্তার বিষয়টিও ভারত নিশ্চিতভাবে বিবেচনায় রাখে। পারস্পরিক বৈরী অবস্থানের কারণে চীনও এ বিষয় সমূহ তার কৌশল প্রণয়নে বিবেচনায় নেয় এটিও নিশ্চিতভাবে বলা যায়। বাংলাদেশ এ দুই বৃহৎ প্রতিবেশীর বৈরিতার তাপ বিশেষ করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে অনূভব করেছে।

মায়ানমারকে ঘিরে বিশেষ করে চীনের অবস্থান বিবেচনায় নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র নীতিও এখানে দারুণভাবে সক্রিয়। তার যর্থাথ প্রমাণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইন পরিষদে গৃহীত ‘বার্মা এ্যাক্ট’ বিল। এ বিলের মাধ্যমে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে মায়ানমার বিষয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপের অবারিত সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

ভূরাজনীতির এ সমস্ত জটিল কূটিল বিষয়কে সামনে রেখে আমাদের পথ চলতে হবে। এ চলায় বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবচনা করলে দেখা যাবে পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের দীর্ঘ দিনের একটি শীতল সম্পর্কের অবসান হতে চলেছে। অন্যদিকে চীনের সাথে পাকিস্তানের রয়েছে উঞ্চ সর্ম্পক। চীন পাকিস্তানের এ সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসতে পারে। তবে এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত কীভাবে বিষয়টিকে দেখছে তা আমরা তলিয়ে দেখতে পারি।

অন্তর্বর্তী সরকার এ মুহূর্তে তাদের নানা অগ্রাধিকারমূলক এজেন্ডার মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়টিকেও জাতীয় নিরাপত্তার নিরিখে সামনে রাখার বিষয় বিবেচনায় রাখতে পারেন। অন্যথায় দিন যেতে রোহিঙ্গা ইস্যু টি জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়েই থাকবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধদূরের দুরবিনে