ষাটের দশকে “পর্দা ও মঞ্চ” নামে দৈনিক আজাদীর একটি পাতা বের হতো। পাতাটিতে নাটক ও চলচ্চিত্রের সংবাদ প্রাধান্য পেলেও সাংস্কৃতিক অন্যান্য সংবাদও প্রকাশিত হতো। আজাদীর সাহিত্য পাতার নাম ছিলো “সাহিত্য সাপ্তাহিকী”। আশির দশকে ‘সমাজ ও সংস্কৃতি‘ নামে একটি পাতা বের হতো আজাদীতে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের খবরাদির মতো আদিবাসীসহ বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠী জীবানাচার, সংস্কৃতি, ইতিহাস এই পাতায় স্থান পেত। ১৯৮৬ সালের আগস্টে এই পাতায় মো. মাহবুবউল আলমের একটি লেখা ছাপা হয়। লেখাটির শিরোনাম “আমাদের লোকায়ত সংস্কৃতিতে মাইজভাণ্ডারী সঙ্গীতের প্রভাব”। ১৯৮৯ সালের ৫ অক্টোবর একই পাতায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে শওকত হাফিজ খান রুশ্মির একটি লেখা ছাপা হয়। এছাড়া মহান স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, ভাষা দিবস উপলক্ষেও আজাদী বিশেষ পাতা বের করে। উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে আজাদীর বিশেষ সংখ্যার নাম ছিলো “বাঙলাদেশ”। একই বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত ভাষা দিবসের প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিলো, “মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির মুক্তি সংগ্রামে শহীদদের প্রতি : সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর শ্রদ্ধাঞ্জলি”। আগের বছর ১৯৭১ সালে ভাষাদিবস উপলক্ষে প্রকাশিত বিশেষ সংখ্যার শিরোনাম ছিলো “আ মরি বাংলা ভাষা! তোমার কোলে, তোমার বোলে কতই শান্তি ভালোবাসা! একুশের শহীদদের স্মরণে”। ১৯৭৬ সালেও আজাদীর ২১ ফেব্রুয়ারির প্রধান শিরোনাম ছিলো “বাংলার ভালে টিপ রক্ত–জবাব, একুশ এসেছে নিয়ে দীপ চেতনার”।
বাঙালির সর্বজনীন উৎসব পহেলা বৈশাখ উদযাপনকে বিশেষ জায়গা করে দিয়েছে পত্রিকাটি। বর্ষবরণ–বিদায়ের সচিত্র প্রতিবেদনের মধ্য দিয়ে বাংলা সংস্কৃতিকে যেমন পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়েছে, একইভাবে অসামপ্রদায়িক চেতনার বিকাশকেও আলোকিত করার প্রচেষ্টা রয়েছে। ১৯৭০ সালের ১৫ এপ্রিল প্রকাশিত পহেলা বৈশাখের বিশেষ সংখ্যায় আজাদীর শিরোনাম ছিলো “ওই নতুনের কেতন ওড়ে কাল বোশেখীর ঝড়, তোরা সব জয়ধ্বনি কর”। অসামপ্রদায়িকতা বরাবরই আজাদীর সম্পাদকীয় নীতির অন্তর্ভুক্ত বিষয়। উদহারণ হিসেবে একটি সম্পাদকীয় উল্লেখ করা যায়। ১৯৮৯ সালের ১১ নভেম্বর “সামপ্রদায়িক রাজনীতি” শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় ছাপে আজাদী। লেখাটিতে ভারতের রাজনীতির প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয় “শুধুমাত্র নির্বাচনী সুবিধার স্বার্থে কোন দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল মৌলবাদের হাতের ক্রীড়ণক হয়ে তেমন কাজটি করতে পারেন না, ধর্ম নিরপেক্ষতার আদর্শকে দুর্বল করতে পারেন না। ….ভারতীয় বামপন্থী দলগুলোর এতদসংক্রান্ত ভূমিকা নিঃসন্দেহ সঠিক, সাহসিকতামণ্ডিত ও পূর্বাপর সামঞ্জস্যপূর্ণ। মৌলবাদীদের আস্কারা দেয়া যে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের মূলে কত বড় আঘাত হানতে পারে তারাই সে ব্যাপারে যথার্থ সচেতনতার পরিচয় দান করলো।” একই সম্পাদকীয়কে আরো বলা হয়, “একই কথা সত্য আমাদের জন্যও। আমাদের জনগণ ধর্মীয় সহনশীলতার যে নজির আগাগোড়া রেখে আসছে তা তাদের ধর্ম নিরপেক্ষতার আদর্শের প্রতি আস্থার সুস্পষ্ট ও অকাট্য প্রমাণ। পাকিস্তানী শাসকেরা তেইশ বছরের শাসনকালে বহুবার ইন্ধন যুগিয়েও এদেশের জনগণকে ব্যাপকভাবে সামপ্রদায়িক–ভাবাপন্ন করে তুলতে পারেননি। কোন কোন মহল এখনো সেই পাকিস্তানী রীতিতে এখানে সামপ্রদায়িক রাজনীতি প্রসারে সচেষ্ট। বৃহত্তর জনসমাজ এ রাজনীতি গ্রহণ করেনি। এটা তাদের মন–মানসের সহিত খাপ খায় না। কিন্তু সামপ্রদায়িক রাজনীতি প্রবক্তারা তারপরও সক্রিয়। ভারতের মতো এই রাজনীতি জনসমর্থনের ব্যাপারে অসফলতা বরণ করলেও ভারতের মতোই তা সমাজের পক্ষে অহিতকর হয়ে দাঁড়াতে পারে সামাজিকভাবে। এ ব্যাপারে জাতির সচেতন অংশের সার্বিক সতর্কতা প্রয়োজন। নচেৎ ভারতের মতোই গভীরতর সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে আমাদের।” আজাদীর এ বক্তব্য ও অবস্থান বাংলাদেশের স্বাধীনতার আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের অসামপ্রদায়িক চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। যে পাতায় পত্রিকাটি পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবীর খবর দিয়েছে, সেটির পাশেই ছেপেছে “সাধুবাবা তারাচরণ জন্মোৎসব” শীর্ষক খবর।
চট্টগ্রাম কলেজের শতবর্ষ পূর্তি (১৮৬৯–১৯৬৯) উপলক্ষে ফেরদৌসী জাহানের লেখা “সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও চট্টগ্রাম কলেজের সামপ্রতিক গতিধারা” শীর্ষক একটি উপসম্পাদকীয় ছাপে আজাদী। এই লেখায় চট্টগ্রাম কলেজের সাহিত্য–সংস্কৃতি–রাজনীতির গৌরবময় পথচলা বর্ণিত হয়। আজাদী লেখাটি পরিবেশনের মাধ্যমে একদিকে যেমন চট্টগ্রাম কলেজের ভূমিকাকে তুলে ধরেছে, পাশাপাশি ছাত্রসমাজের শিল্প–সাহিত্য চর্চার একটি ইতিবাচক বার্তাও উপস্থাপন করেছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের খবর সর্বদাই পত্রিকাটি গুরুত্ব দিয়ে পরিবেশন করেছে। এমনকি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায়ও আজাদীর ভূমিকা রয়েছে। এই আন্দোলনে দৈনিক আজাদীর একটি বিশিষ্ট ভূমিকা ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়টির সংস্কৃতি সংসদ, হলভিত্তিক সাংস্কৃতিক আয়োজনসহ বিভিন্ন সংগঠনের অনুষ্ঠানমালার প্রতিবেদন মেলে আজাদীতে। যেমন– প্রফেসর মো. আলী ইমদাদ খানকে উদ্ধৃত করে চবি কলেজের বার্ষিক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার প্রতিবেদনের শিরোনাম করে “সাংস্কৃতিক বিকাশ রুদ্ধ হলে জীবনের বিকাশ সম্ভব নয়” ।
চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, নাট্য–উৎসবের খবর, প্রতিবেদন ও পর্যালোচনা গুরুত্বের সঙ্গে পরিবেশন করে আসছে পত্রিকাটি। যেমন, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের বিনোদনের জন্য গঠিত “চট্টগ্রাম বন্দর রিপাবলিক ক্লাব” “চট্টগ্রাম গ্রাম থিয়েটার সমন্বয় পরিষদ” এর সহযোগিতায় ১৯৮৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ৮ মার্চ পর্যন্ত পক্ষকালব্যাপী “চট্টগ্রাম বন্দর নাট্য উৎসব” উদযাপন করে। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মাহবুব হাসান সেই উৎসবের একটি পর্যালোচনা লিখেন, যা আজাদী গুরুত্বসহ ছাপে। এছাড়া চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কর্মচারী নাট্য সংস্থার খবরও বিশেষ গুরুত্ব পেত। যেমন, ১৯৬৯ সালের ৬ অক্টোবর সংখ্যায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিলো “চ উ ক কর্মচারী নাট্য সংস্থার ‘উল্কা’। এমনকি সিনেমার বিজ্ঞাপনও নিয়মিত ছেপে সংস্কৃতিমুখিনতার পথে হেঁটেছে পত্রিকাটি। এছাড়া চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমি কেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক সংবাদ, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা, মফস্বলের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংস্থার তৎপরতার সংবাদ নিয়মিত প্রচার করে আজাদী। নগরীতে নয়া অপেরা ইনস্টিটিউট গঠিত হলে পত্রিকাটি শিরোনাম করে “সংস্কৃতি বিকাশের ক্ষেত্রে নয়া অপেরা ইনস্টিটিউট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ”।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রতি আজাদীর দৃষ্টি অতি গুরুত্বের। স্বাধীন বাংলাদেশে কবির ৭৩তম জন্মবার্ষিকীতে প্রথম পৃষ্ঠায় আজাদী শিরোনাম করে “হানাদারমুক্ত বাংলাদেশের সর্বত্র : সাড়ম্ভরে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মজয়ন্তী উদযাপিত” (২৭ মে, ১৯৭২)। এর আগে ২৪ মে কবি কলকাতা হতে বাংলাদেশে ফেরেন। ২৫ মে আজাদীর শিরোনাম ছিলো, “বিমানবন্দরে অগণিত ভক্ত জনতার বাঁধভাঙা জোয়ার : স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় ‘অগ্নিবীণা‘র কবি কাজী নজরুলের প্রথম শুভ পদার্পণ” । সেদিনই দেশটির স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কবির সঙ্গে দেখা করেন। আজাদী শিরোনাম করে “কবি সন্দর্শনে বঙ্গবন্ধু” । কবির মৃত্যুর পর চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত শোকসভার খবরটি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে ছাপে পত্রিকাটি। ১৯৭৬ সালের ৪ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিলো “বাংলাদেশ পরিষদের শোকসভায় বিদ্রোহী কবির স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি : নজরুল সাহিত্য সংরক্ষণের জন্য উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান গঠনের আবেদন”। ১৯৬৯ সালে আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদের জন্মশতবার্ষিকীর খবর ফলাও করে ছাপে পত্রিকাটি। “আব্বাস উদ্দীনের প্রথম স্মরণী উৎসব উদযাপন”। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে খবরাখবরও আজাদী গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে। ১৯৮৬ সালের ১ জুন সংখ্যায় আজাদীর একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিলো “সঙ্গীতাসর আয়োজিত অনুষ্ঠানে অনুপম সেন : রবীন্দ্র–নজরুলকে গণমানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার স্বার্থেই শিক্ষিতের হার বাড়াতে হবে” ।
১৯৭১ সালের ২৫ জানুয়ারি আজাদীর একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিলো “সঙ্গীতশিল্পী সমাজের সংবর্ধনা সভায় শেখ মুজিবের আহবান : বাস্তবভিত্তিক বাংলার গণ–সংস্কৃতি গড়িয়া তুলুন”। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর প্রথম চট্টগ্রাম আগমন উপলক্ষে আজাদী বিশেষ পাতা বের করে। ১৯৭২ সালের ৩০ মার্চ প্রকাশিত এ বিশেষ সংখ্যার প্রধান শিরোনাম ছিলো “বঙ্গবন্ধু–স্বাগতম” । পাতাটিতে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে “তোমাকে স্বদেশ ভেবে” শীর্ষক একটি কবিতাও ছাপা হয়।
লেখক : শিক্ষাবিদ; সাবেক উপ–উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।