আমার প্রিয় শিক্ষক মোহাম্মদ আবদুল আলিম

রশীদ এনাম | সোমবার , ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ at ৭:৪৭ পূর্বাহ্ণ

শেখ সাদী বলেছিলেন, “তুমি যদি উচ্চ সম্মান লাভ করতে চাও, তবে কাছের ব্যক্তিকে নিজের মতো করে দেখতে অভ্যাস করো। তাকে সামান্য মনে না করিয়া সম্মান করিবে।”

আমরা আসলে তা কি করছি?

আজ একজন শিক্ষকের কথা বলব, যাঁর হৃদয়ের ক্যানভাস জ্যোতির্ময় প্রজ্ঞায় সৃজনে মননে পাণ্ডিত্যে পরিপূর্ণ। মা মাটি শিকড়ের টানে যাঁর দুটো নাটকের লেখনী ভাষা আন্দোলন ও একাত্তরের স্বাধীনতা নিয়ে যেন বাস্তব জীবনের কথা বলে, সঠিক ইতিহাসের কথা বলে। একজন নিভৃতচারী আপাদমস্তক জ্ঞানতাপস পটিয়ার বাতিঘর খ্যাত শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল আলিম স্যারকে আমি খুব কাছ থেকে উপলব্ধি করেছি। মাঝে মাঝে অজানা বিষয় জানার জন্য স্যারের কাছে আমি ছুটে যেতাম। যাঁর কাছ থেকে পরম স্নেহ, সোহবত, অনুপ্রেরণা ও লেখালেখির পরামর্শ ও বিভিন্ন দিকনির্দেশনা আমি পেয়েছি। শিক্ষাবিদের পাশাপাশি আমি স্যারকে দেখেছি একজন প্রকৃতিপ্রেমী হিসেবে। তাঁর কর্মেলেখায়জীবনাচরণে প্রাধান্য পেয়েছে নানা বিষয়।

অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল আলিম স্যার ১৯৫১ সালে ৪ সেপ্টেম্বর পটিয়া গোবিন্দারখীল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

১৯৬৯ সালে পটিয়া কলেজ থেকে এইচএসসি ও ১৯৭৩ সালে স্নাতক সম্পন্ন করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, ১৯৭৫ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। বাংলায় ছিলেন তুখোড় মেধাবী। ছাত্রজীবনেই লক্ষ্য ছিল শিক্ষকতা করবেন।

১৯৭৬ সালের কথা যে কলেজে অধ্যয়ন করে কৈশোর কাটিয়েছেন সে কলেজে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করলেন। পরবর্তীতে ১৯৯৪ সালে বরিশালের সরকারি সৈয়দ হাতেম আলী কলেজ বরিশালে। পরবর্তীতে ১৯৯৮২০০১ সাল পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে চট্টগ্রাম সরকারি চারুকলা কলেজে, চট্টগ্রাম চারুকলা কলেজ থেকে বদলি হয়ে চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজের বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তীতে অধ্যাপক আবদুল আলীম চন্দনাইশ গাছবাড়িয়া সরকারি কলেজ এবং ২০০৫ সালে চাকরি জীবনের শেষ দিকে চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজ থেকে অবসরে আসেন। কর্মজীবনে সহানুভূতি পেয়েছিলেন জ্ঞানতাপস ডক্টর আহমেদ শরীফের।

আমি ১৯৯৮ সালের কথা এসএসসি পাশ করে পটিয়া সরকারি কলেজে ভর্তি হলাম। আমাদের কলেজের পরিবেশটা ছিল সবুজ শ্যামল ছায়াবেষ্টিত। কলেজের ফটকে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে বর্ষীয়ান কাঠবাদাম, কৃষ্ণচূড়া, কলেজের দক্ষিণ পাশে ছোটো বোটানিক্যাল গার্ডেন, সারি সারি নারকেল বৃক্ষ, উত্তর পাশে পুকুরের চারদিকে সারি সারি নারকেল গাছ। একটার থেকে আরেকটার দূরত্ব বরাবরই সমান। পটিয়া কলেজের সামনে নিজ উদ্যোগে একসময় জানতে পারলাম কলেজের গাছগুলো বেশির ভাগই অধ্যাপক আবদুল আলীম স্যারের হাতে লাগানো। স্যার যখন যে কলেজে ছিলেন প্রত্যেকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিজের হাতে গাছ লাগিয়েছেন। স্যারের বাড়িতে যখনই যাই, দেখি আলীম স্যার নিড়ানি না হয় কোদাল দিয়ে গাছের পরিচর্যায় ব্যস্ত। স্যারকে দেখতাম মাঝে মাঝে গাছের পাতায় হাত দিয়ে স্পর্শ করে বলছেন, “আমি থাকব না তোরা থাকবি যতদিন থাকবি মানুষদের জন্য অক্সিজেন দিবি, ফুলফল দিবি গাছের ফল নানা বিহঙ্গরা খাবে। এটার জন্য মওলার কাছ থেকে আমিও দোয়া পাব।” স্যারের ফুলের মধ্যে গোলাপ প্রিয় ফলের মধ্যে আম খুব পছন্দ। শখের বসে নিজেই বাড়িতে গরু পালন করেন। গরুর শুকনো খড়, সবুজ ঘাসভুসি দেওয়া থেকে শুরু করে সবকিছু স্যার করেন। গরুর শুকনো গোবর টুকরি করে গাছের গোড়ায় দেন। নিজের কাজগুলো করতে করতে স্যারের শরীরে ঘাম ঝরত স্যার গামছা দিয়ে ঘাম মুছে নিতেন। স্যারর বিলু নামে একটা পোষা বিড়াল ছিল বিড়ালটি সারাক্ষণ স্যারকে পাহারা দিত, মিউ মিউ করে স্যারের পিছনে ছুটত। একদিন বিলু বাড়ির ছাদে বাচ্চা প্রসব করে। বিলু কী খুশি। স্যার বিষয়টা জানত না। বিলু হঠাৎ স্যারের পরিধানের কাপড় কামড়ে ধরে ছাদে নিয়ে যাওয়ার জন্য ইশারা করে। স্যার বললেন ব্যাপার কী। স্যার বিলুর সাথে ছাদে যায় গিয়ে দেখে বিড়ালের ফুটফুটে দুইটি বাচ্চা। স্যার খুশিতে কেঁদে ফেললেন। স্যারের বাসায় যখন আড্ডায় বসি, দেখি বিলু স্যারের পায়ের নিচে এসে ঘুরঘুর করছে। স্যার পটেটো বিস্কুট রুটি দিচ্ছেন বিলু পুটুর পাটুর করে খাচ্ছে। একদিন শুনলাম বিলু অসুস্থ হয়ে মারা যায়। আলীম স্যার অঝোরে কাঁদলেন বিলুর জন্য। স্যার বৃষ্টির দিনে বৃষ্টিতে ভিজতে পছন্দ করতেন। ভরাজোছনা রাতে পুকুর পাড়ে না হয় মাঠে গিয়ে জোছনা উপভোগ করতেন।

স্যারের সাথে যতক্ষণ থাকতাম নতুন কিছু শিখতাম। বিশেষ করে লেখালেখি নিয়ে পরামর্শ দিতেন। স্যার খুব বিনয়ী ও মৃদুভাষী, মুচকি হাসি দিয়ে বলতেন, রশীদ এটা এভাবে নয় এভাবে হবে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ভুল বের করে শুদ্ধ করতেন। ‘রসনা জৌলুসে অনন্য চাটগাঁ’ বইয়ের পাণ্ডুলিপি দেখে যত্ন করে ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন। স্যারের যে বিষয়টা আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করে তা হলো তাঁর ধৈর্য। একদিন বলেছিলেন “শিক্ষিত হলে হবে না ভালো মানবিক মানুষ হতে হবে। মানুষ আকার আকৃতিতে বড়ো হলে হবে না প্রকৃতিতেও বড়ো হতে হবে।”

অধ্যাপক আলীম স্যার জীবনে সঞ্চয়ের প্রায় অর্থ ব্যয় করেন মানবিক কাজে, অসহায় দু:স্থ মানুষ এবং গরিব মেধাবী ছাত্রদের যখনই যে আসে নীরবে নিভৃতে এবং গোপনে ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দেন ।

তিনি মাঝে মাঝে সাময়িকী/স্মরণিকা ও পত্রিকায় লিখতেন। তাঁর অনবদ্য দুটি প্রবন্ধ রয়েছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনভিত্তিক একাঙ্কিকা “রক্তাক্ত লাশ”(২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩) একাত্তরের দিনগুলি নিয়ে “রক্তাক্ত বাংলা ”(২৬ মার্চ ১৯৭২) নাটক দুটি পটিয়া ক্লাবে মঞ্চায়িত হয়। পটিয়া ক্লাবের মঞ্চ নাটকের জন্য সবাইকে অনুপ্রাণিত করে গেছেন।

বাড়ির কাছে শাহ আমির উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পেছনে আলীম স্যার ছিলেন উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ৮০ পরবর্তীতে পটিয়ায় প্রথম কিন্ডারগার্টেন চয়নিকা শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠাতা (পটিয়া কলেজের বাঁশের বেড়ার তৈরি কক্ষের মধ্যে জায়গার সংকুলান না হলে মোহছেনা ইশকুলে পরবর্তীতে খলিলুর রহমান ইশকুলে) পটিয়া ঝংকার সংগীত বিদ্যাপীঠ, পটিয়া মহকুমা শিল্পকলা একাডেমি (১৯৮৩৮৫), পটিয়া ক্লাব, মালঞ্চ (১৯৭৮), মোস্তাফিজুর রহমান পাঠাগার, শেখ রাসেল স্মৃতি পাঠাগার, পটিয়া ডায়াবেটিক সমিতিসহ আরো নানা সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত আছেন।

আগামী প্রজন্মের জন্য তাঁর পরামর্শ পড়ালেখার কোনো বিকল্প নেই। তবে জোর করে কাউকে পড়ানো যাবে না। রাতারাতি ডাক্তার, প্রকৌশলী, টাকাপয়সাওয়ালা হতে হবে এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে পিতামাতাকে। একান্নবর্তী পরিবারগুলো ভেঙে যাচ্ছে এটা ধরে রাখতে হবে বড়োদের বিশেষ করে বাবামা শিক্ষক এবং জ্যেষ্ঠদের সম্মান করার জন্য পারিবারিক শিক্ষা দিতে হবে। বাবামাকে কেউ বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর ঘোর বিরোধী তিনি। আত্মকেন্দ্রিকতা পরিহার করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমনকি সামাজিক সংগঠনে কিছু সাংস্কৃতিক ব্যবসায়ী আজকাল ক্রেস্ট সংস্কৃতি চালু করেছে এসব বন্ধ হওয়া উচিত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পুরস্কার হিসেবে ঘটিবাটি ক্রেস্ট না দিয়ে বই তুলে দেওয়ার জন্য আহ্বান করেন অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল আলিম ।

স্যারের ৭৩ তম জন্মদিনে একজন অনুগামী ছাত্র হিসেবে জানাই অকুণ্ঠ ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।

লেখক: সমন্বয় সহকারী ইতহাসের খসড়া

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ-এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধপিলু খান সংগীতে ৪৭ বসন্ত