রুমে ফিরে দেখি লাজু ধীরেসুস্থে স্বভাবমাফিক যত্নে গোছাচ্ছে দু ছেলের মধ্যে সবেমাত্র একজনের ব্যাগ স্যুটকেস গোছানয় ব্যস্ত। যার মানে, দিল্লি দূর অস্ত! কে জানে কতো রাত পর্যন্ত চলে অবশেষে তার এই গোছগাছজনিত খুটখাট? অবশ্য তাতে কোনো সমস্যা না। এমনিতেই তো জানি নির্ঘুম কাটবে এ রাত, হয় যেমন বরাবর, সকাল সকাল উঠে কোথাও যদি দৌড়ানোর থাকে তাড়া। ঐদিকে বিছানায় অভ্রর চোখ বন্ধ করে নট নড়ন চড়ন হয়ে ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকার ভঙ্গি পরিষ্কার বলছে, রুমে হয়েছে জারী ১৪৪ ধারা! কথা না বাড়িয়ে তাই পড়লাম নিজের ব্যাগ সুটকেস গোছানো নিয়ে।
একটানা মিনিট চল্লিশ কি পঞ্চাশ ধরে ক্ষণে ক্ষণে নানান আদেশ নিষেধ উপদেশ চুপচাপ হজম করতে করতে ব্যাগ সুটকেসেই একাগ্র মনোযোগ ধরে রাখতে পারার ফল হাতে হাতে পেতেই, সন্তুষ্ট মনে ঢুকলাম স্নানঘরে, কুসুমোষ্ণ পানির ধারায় সারাদিনের ক্লান্তি ধুয়ে মুছে কিছুটা ঝরঝরে হবার আশায়।
বেশ দ্রুতই স্নান সমাপন শেষে সোফায় গা এলিয়ে প্রতিদিনের মতো ফোনের মগজে এসে জমা হওয়া অফিসের মেইল চেক করতে গিয়ে, প্রথমেই চোখ গেল সায়মার মেইলে। শুরুতেই সে মনে করিয়ে দিয়েছে যে আগামীকাল সকালেই আমাদের প্লেন ধরতে হবে। মাঝে লিখেছে আমার অনুপস্থিতিতে অফিসের নিয়মিত কাজকর্মে কোনোই সমস্যা হচ্ছে না, বরং দেশে ফেরার তিনদিনের মধ্যে পেশাগত কারণে আমাকে যে যেতে হবে ওমানে, তার সব আঞ্জাম সে করে রেখেছে। চিঠির সবশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ নিশ্চয়তাটি হল, আজ রাতে ঢাকার এয়ারপোর্ট থেকে বেরুলেই থাকবে মওজুদ আমার গাড়ি ও ড্রাইভার। অতএব নো চিন্তা।
এরপর দ্রুত বাকি মেইল গুলোর প্রেরক ও বিষয়বস্তু দেখে, ওগুলোকে তেমন জরুরি কিছু মনে না হওয়ায় ফোনটি চার্জে দিয়ে, অভ্র পাশে শুয়ে ওর গায়ে হাত দিতেই বুঝলাম, ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকতে থাকতে আসলেই ঘুমিয়ে পড়েছে বেচারা! এমতাবস্থায় ওর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটানো একান্তই অনুচিত সাব্যস্ত করে নিজে শবাসন শুয়ে চোখ বন্ধ করে ভেড়া গোনায় মনোযোগ দিলাম।
কিন্তু অচিরেই পেলাম টের, লাজুর গোছগাছের খুটখাটে ভুল হয়ে যাচ্ছে বারবার আমার এই উল্টা গুণতি। কিন্তু তা নিয়ে টু শব্দটি করাও তো মহাপাপ। থাক এখন আর মহপাতক হবার ঝুঁকি নেয়ায় কাজ নেই! তুমুল ধৈর্যে তাই শবাসন বজায় রেখে ঐ ভেড়াশুমারির কেঁচেগণ্ডূষেই থাকা যাক ব্যস্ত তবে!
ব্যাপার কী? বেশ কিছুক্ষণ হল কোনো খুটখাট আসছে না কানে। মানে কী? লাজু কি তাহলে তার গোছাগাছ শেষ করে ফেলেছে? বাজে কয়টা এখন?
এমত ভাবতে না ভাবতেই ঘরের নিঃসীম নিস্তব্ধতা ভেঙে বেজে উঠলো নিজের মোবাইলের এলার্ম! প্রায় একই সাথে বিছানার ওপাশেও বেজে উঠলো লাজুরটাও! তাতে লাজু ধড়ফড় করে উঠে বসতেই, নিশ্চিত হলাম যে ঘুম না হলেও ঘুমের ঘোরেই ছিলাম কিছুক্ষণ। তবে কতক্ষণ ছিলাম তা তো জানি না।
‘এই তুমি যাও বাথরুমে আগে। আমি অভ্রকে তুলি এই ফাঁকে। আর ঐ রুমের ওদেরকেও জাগিয়ে যাও।’
দিনের শুরুতেই নাজিল হওয়া স্ত্রীআজ্ঞা অক্ষরে অক্ষরে মেনে ঐ রুমে ফোন করতেই দীপ্র বলে উঠল ‘নি হাও!’
উত্তরে আমিও নি হাও বলে বললাম বাবা, শোন হেন সহ তুমি ঝটপট তৈরি হয়ে চলে আস নাস্তা করতে।
‘না বাবা আমি নাস্তা করবো না। এই এন অনেক আগে জাগিয়ে দিয়েছে আমাকে। আমার এখনো ঘুম পাচ্ছে’ দীপ্রর এই ঘ্যান ঘ্যান অভিযোগের উত্তরে বললাম, ঠিক আছে গাড়িতে উঠেই না হয় ঘুমিও। এখন আর ঝামেলা করো না। বলেই ফোন কেটে চললাম বাথরুমে।
প্রাতঃক্রিয়াদি শেষে বাথরুম থেকে শেইভিং কিটটি নিয়ে সেটিকে সুটকেটস্থ করতে করতে আড় চোখে দেখলাম আধঘুমে থাকা অভ্রকে নরমগরম চিকিৎসা দিতে দিতে অনেকটা টেনে হিঁচড়ে নিয়েই ঢুকল লাজু, বাথরুমে। মনে পড়লো এসময়, সেই যে প্রথমরাতে সস্তা পেয়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভোমা সাইজের পানির বোতলগুলো কিনেছিলাম সেগুলোর মধ্যে এখনো তো পুরো তিন বোতল রয়ে গেছে!
আচ্ছা ওগুলো হোটেলে রেখে যাবার তো কোন মানে হয় না। তারচেয়ে বরং নিয়েই যাই না কেন এয়ারপোর্টে। সেদিন যেহেতু ওখানে জলকষ্টে ভুগেছি, আজ এগুলো থাকলে একদিকে যেমন আমাদের কাজে লাগবে, তেমনি বাকিটা রেখে যাওয়া যাবে এয়ারপোর্টের কোনো চেয়ারে বা টুলে যাতে জলকষ্টে থাকা অন্য কেউ পায় হাতের কাছেই ভরা বোতল। এই ভেবে পিঠব্যাগে বোতলগুলো ঢোকাচ্ছি যখন, তখনই বেজে উঠলো রুমের ফোন।
ফোনের শব্দেই ধরে নিয়েছিলাম এসে গেছেন নিশ্চয় লি খাঁ। ফোন ধরার পর নিশ্চিত ভাবে তা প্রমাণিত হতেই, গলা উঁচিয়ে লাজুকে সে খবর দিয়ে, ফোন করে জানিয়ে দিলাম তা ঐ রুমেও।
যদিও এতো তাড়াহুড়া করার কোনোই কারণ নেই, তারপরও এরকমটাই কেন জানি হয়, যে কোনো ভ্রমণেই। মানে যতক্ষণ না যেতে পারছি বিশেষত এয়ারপোর্ট বা রেলস্টেশনে, কেমন যেন একটা বাড়তি চাপ পড়ে মনে ও মগজে; ফলে দিতে শুরু করি সহযাত্রীদের তাড়া।
বরাবরের মতোই শেষ মুহূর্তের এই হাঁকডাক সবার মধ্যে কিঞ্চিৎ বিরক্তি উৎপাদন করলেও ঐ রুম থেকে যেমন দীপ্র ও হেলেন হাজির হয়েছে একদম বাইরে বেরুবার জন্য তৈরি হয়ে, এদিকে অভ্রকেও ফিটফাট করে বাথরুম থেকে রুমে ঠেলে দিয়েছে লাজু।
এ ফাঁকে টেবিলের উপর থাকা কেক, বিস্কিট, ফলফলাদিগুলো দেখিয়ে সবাইকে দ্রুত নাস্তা সেরে নিতে বলতেই, একাট্টা জবাব এলো সকলের যে, কেউ এখন খেতে পারবে না কিছুই। প্লেনে উঠে প্লেনেরই নাস্তা করবে সবাই।
অবস্থা যেহেতু অনেকটা একই আমারও, তাই এ নিয়ে উচ্চবাচ্য না করে, চা বানানোর জন্য পানি গরম করতে দিলাম। নিশ্চিত জানি লাজু চা আর দুয়েকটা বিস্কিট খেয়েই বেরুতে চাইবে। এই ফাঁকে দীপ্রকে বললাম সে যেন ফোন করে নিচ থেকে বেলবয়কে ডেকে আনে লটবহর নিয়ে যাবার জন্য।
বাহ! দীপ্রর ফোনের পর এই সাত সকালেও বেশ ঝটপটই চলে এসেছে দেখছি বেলবয়! অতএব দুই রুমের ব্যাগ সুটকেস সব বেলবয়ের হাওলা করে দিয়ে রুমে ফিরতেই দেখি এরই মধ্যে লাজু চা বানিয়ে খাচ্ছে তা বিস্কিট সহযোগে যেমন, তেমনি তৈরি আছে আমার জন্য ধোঁয়া উড়া আরকেটি কাপ।
নিজের কাপটি হাতে নিতে নিতে, বাকীদের ঠায় দাঁড়িয়ে উস্খুশ করতে দেখে ওদের নিচে নেমে যেতে বলতেই হুড়মুড় করে বেরিয়ে গেল সবাই। এতে আবার আমাদের দুজনেরও চা পানের গতি গেল বেড়ে। অতএব অচিরেই দিলাম হাজিরা নিচে।
করিডোরে পৌঁছে সবাইকে গাড়ির দিকে এগুতে বলে এগুলাম নিজে বিল মেটানোর জন্য রিসেপশন কাউন্টারে। এই কাকভোরে রিসেপশনে আমি ভিন্ন চেক ইন বা আউট করার কেউ না থাকায়, দ্রুতই হয়ে গেল সে কর্ম সম্পাদন।
অতপর বাইরে এসে দেখি, দলের সবাই উঠে গেছে এরই মধ্যে লি খাঁর ভ্যানের পেটের ভেতর, আর শূন্য লাগেজ ট্রলি নিয়ে ফিরছে বেল বয়। যদিও জানি, এখানে ব্যাগ হারানোর ভয় নেই, তারপরও সাবধানের মার নেই ভেবে, বেলবয়কে দাঁড়াতে বলে, গাড়ির পেছনের ডালা খোলার ইশারা দিলাম লি খাঁকে।
সে ইশারায় গাড়ির পেছনের ডালা খুলে যেতেই, দ্রুত চোখ জরিপে সবগুলো ব্যাগের উপস্থিতি নিশ্চিত হয়ে, পাশে এসে দাঁড়ানো বেলবয়ের হাতে একটা নোট গুঁজে দিয়ে, আমার নির্ধারিত আসন লি খাঁর পাশের সিটে উঠে পিঠ লাগাতেই, পেছনের দিকে ছুটে এলো প্রশ্ন।
‘এই, বকশিশ দিয়েছ তো?”
উত্তরে জোর গলায় বেলবয়ের প্রাপ্য যে দেয়া হয়েছে তা জানিয়ে, লি খাঁকে হাতের ইশারা আর মুখভঙ্গি মিলিয়ে বললাম চলেন চাচা, হোক শুরু তবে এয়ারপোর্ট যাত্রা। অন্যদিকে মনে মনে আওড়ালাম, মুড়ালো আজ অবশেষে বেইজিঙয়ের সাথে এই চায়না ভ্রমণেরও নটে গাছ।
ইশারার সাথে সাথেই লি চাচা গাড়ি সচল করে দিতেই, গাড়ি হোটেলের আঙিনা ছেড়ে বের হবার আগে পিছু ফেলে যাওয়া আঙিনার দিকে তাকাতেই দেখলাম, খাঁ খাঁ শূন্যতা। নাহ, কেউ নেই ওখানে। ইস থাকতো যদি এখন মিস ইনা ডিউটিতে, তবে নিশ্চয়ই হাত নেড়ে জানাতো বিদায়। আচ্ছা, তাকে ফোন করে বলবো নাকি, বিদায়?
নাহ, চিন্তাটি আসা মাত্রই বাতিল করে দিলাম তা, অসময়ে কোনো পেশাজীবী নারীকে ফোন না করার যে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম বহু আগে, তা মনে করে। সাথে এও মনে হল, আসলে আমরা যেমন মিস ইনার অভিভাবকত্বে ছিলাম তেমনি তো আছেন হোটেলের বকিরাও। এরকম ফোন যদি সবাই করতে থাকে তাকে সময়ে অসময়ে, অবস্থা তো হবে তার ত্রাহি মধুসূদন! যা মোটেও ঠিক নয়।
একদম ফাঁকাই বলা চলে গাঢ় ছাই রঙের ধোঁয়াশার চাদরে ঢাকা এয়ারপোর্টমুখী বেইজিঙয়ের এই সদর রাস্তাটিকে এখন। সেই চাদর ঠেলে মোটামুটি গতিতে এগুচ্ছেন লি খাঁ। অন্যদিকে পেছনে সবাই মনে হচ্ছে আধভাঙা ঘুমের যতোটা পারা যায় তা পুষিয়ে নিতে ব্যস্ত। পাচ্ছে ঘুম আমারও, কিন্তু ড্রাইভিং সিটের পাশে বসে নিজে ঘুমালে তা ড্রাইভারের চোখে সংক্রমিত হবার তো থাকে মহাবিপদ!
অতএব উইন্ডসিল্ডের বাইরে চোখ নিবদ্ধ করে ভাবছি, আমাদের এখনকার গন্তব্য যেহেতু কুনমিং, ইমিগ্রেশনের হুজ্জত নাই এখন। বরং দুপুরের শেষ দিকে কুনমিংয়ে ইমিগ্রেশন সারার পরই পাবো দেশে ফেরার ছাড়পত্র। দেশের কথা মনে পড়তেই গুণ গুণ করে গাইতে শুরু করলাম
‘ফিরে চল, ফিরে চল, ফিরে চল মাটির টানে……’
বাহ, যতোটা লাগবে সময় ভেবেছিলাম, লাগল না তা মনে হচ্ছে। ফাঁকা রাস্তা পেয়ে একটানা গতিতে গাড়ি চালিয়ে লি খাঁ বেশ দ্রুতই নিয়ে এসেছে এখনো ঘুমিয়ে থাকা, বেইজিঙয়ের এই পুরাতন এয়ারপোর্টে। গাড়ি থামিয়েই ঝটপট গাড়ি থেকে নেমে লি খাঁ, মোট তিনটা ট্রলি দ্রুত নিয়ে এসে গাড়ির পাশে তা রেখে পেছনের ডালা খোলার আয়োজন করতেই, তখনও ঘুমে থাকা সবাইকে তাড়া দিয়ে, নেমে গেলাম নিজেও।
লেখক: কলামিস্ট, ভ্রমণ সাহিত্যিক।