চলে গেলেন ভাষাবিজ্ঞানী ও গবেষক অধ্যাপক ড. মনিরুজ্জামান। গতকাল মঙ্গলবার বিকাল ৫টা ১৫ মিনিটে ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান (ইন্না লিল্লাহি…রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, একমাত্র পুত্রসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
মরহুমের প্রথম নামাজে জানাজা গতকাল মঙ্গলবার বাদ এশা রাজধানীর ধানমন্ডি তাকওয়া মসজিদ প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয়। আজ মরহুমের গ্রামের বাড়ি নরসিংদীর আদিয়াবাদে দ্বিতীয় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হবে।
অধ্যাপক মনিরুজ্জামানের জন্ম ১৯৪০ সালের ১৫ ফ্রেরুয়ারি, পুলিশ অফিসার বাবার কর্মস্থল ব্রিটিশ ভারতের চব্বিশ পরগনা জেলার ঝিনাইদহে। পৈতৃক নিবাস নরসিংদীর রায়পুরার আদিয়াবাদে। তার বাবার নাম মো. নাদিরুজ্জামান, মা মোসাম্মৎ ফরিদান্নেছা।
তিনি প্রথমে নৈহাটি, পরে বরানগর, এরপর চব্বিশ পরগনা স্কুল ডায়মন্ড হারবারে পড়াশোনা করেন। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় চলে আসেন পৈতৃক গ্রাম আদিয়াবাদে। সেখানে গ্রামের স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যে ভর্তি হয়ে ১৯৬০ সালে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৬১ সালে স্নাতকোত্তর পাস করেন। এরপর ভারতের মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাবিজ্ঞানে পিএইচডি করেন।
ড. মনিরুজ্জামান চট্টগ্রাম কলেজ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। মনিরুজ্জামান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান ছিলেন। এছাড়া বাংলা বিভাগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সভাপতি এবং কলা অনুষদের ডিনের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি নজরুল ইনস্টিটিউটের পরিচালক ছিলেন। রবীন্দ্র একাডেমির সিনিয়র সহসভাপতি, দক্ষিণ ভারতের অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব স্পিচ অ্যান্ড হিয়ারিং মহীশূরের ভিজিটিং লেকচারার ছিলেন।
ভাষা, সাহিত্য ও ফোকলোর বিষয়ে তাঁর ৩৫টির মতো বই ও শতাধিক গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি একুশে পদক, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, চট্টগ্রাম একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন। গ্রামের বাড়ি নরসিংদীর আদিয়াবাদে শান্তিনিকেতনের আদলে ‘আদিয়াবাদ ভাষা ও সাহিত্য কেন্দ্র’ গড়ে তুলেন। সেখানে তার নামে বিগত কয়েক বছর থেকে ‘মনিমেলা’ আয়োজন করে এলাকাবাসী। অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি গবেষণাকর্মে জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়ে দিয়েছেন। কবিতা, লোকসাহিত্য, গান রচনা, গল্প ও উপন্যাসও রচনা করেন।
ড. মনিরুজ্জামানের উল্লেখযোগ্য বইগুলো হচ্ছে ভাষাতাত্ত্বিক ফিল্ডওয়ার্ক ’৮৩, ভাষাতত্ত্ব অনুশীলন, উপভাষা চর্চার ভূমিকা, চট্টগ্রামের উপভাষা, পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ–গোষ্ঠীর ভাষা, বাংলা সাহিত্য : অতীত ও উত্তরকাল, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে চট্টগ্রাম, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য, বাংলাদেশে লোকসংস্কৃতি সন্ধান, রবীন্দ্র–চিন্তা, চট্টগ্রামে নজরুল প্রভৃতি।
তিনি নিভৃতচারী মানুষ ছিলেন। বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর দরদ ছিল অপরিসীম। তাঁর মানবিক কর্মও গোপনে রয়ে গেছে। নবীন লেখকদের উৎসাহ দিতেন। দেশ–বিদেশে ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর অসংখ্য ছাত্রছাত্রী। ড. মনিরুজ্জামানের ইন্তেকালে চট্টগ্রাম একাডেমির পক্ষে মহাপরিচালক আমিনুর রশীদ কাদেরী গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তিনি শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান।