সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন বাংলাদেশের স্বনামধন্য লেখক, গবেষক, প্রচুর মূল্যবান গ্রন্থের জনক অধ্যাপক ড. মাহবুবুল হক। ড. মাহবুবুল হক একজন ভাষা গবেষক, লোকসাহিত্য গবেষক, পাঠ্যগ্রন্থ রচয়িতা, সকল প্রগতিশীল আন্দোলনের লড়াকু সৈনিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং আরো অনেক মানবিক গুনে গুনান্বিত একজন সঠিক ও পরিপূর্ণ মানুষ।
ড. মাহবুবুল হক এক অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্ব। ছাত্রজীবনে তার সাহিত্য রচনার উন্মেষ। পঠনপাঠন, লেখনী চর্চায়, শিক্ষকতার মাধ্যমে তার সাহিত্য জীবন ঋদ্ধ হয়েছে। পেশাগত জীবনে এসে জাতীয়ভাবে পরিচিতি ও প্রতিষ্ঠা লাভ করার জন্য অন্য অনেকের মত দৌড় ঝাপ করে রাজধানী ঢাকায় তিনি অবস্থান করতে পারতেন। তা না করে ছাত্রজীবনের স্মৃতিময় চট্টগ্রাম শহরে থেকে অবিরাম কর্মপ্রচেষ্টার মাধ্যমে চট্টগ্রামে অবস্থান করেই জাতীয়ভাবে সুখ্যাতি লাভ করতে সক্ষম হয়েছেন ও সফল হয়েছেন। তার লেখা গ্রন্থ একসাথে ঢাকা, কোলকাতা ও সোভিয়েট রাশিয়া থেকে প্রকাশিত হয়েছে। ড. মাহবুবুল হকের গ্রন্থ রচনার আগে বা পরে বাংলাদেশের আর কোনো লেখকের ভাগ্যে এরকম ঘটেছে কিনা জানা যায়নি।
সুখ্যাত লেখক ও বুদ্ধিজীবী এম.আর. আখতার মুকুলের ‘কোলকাতা কেন্দ্রীক বুদ্ধিজীবী’ গ্রন্থটি বাংলাদেশে ব্যাপক সাড়া জাগানোর পর পশ্চিমবঙ্গের কোলকাতা থেকে কোলকাতা কেন্দ্রীক সংস্করণ বের হয়েছে। ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ‘জাতীয়তাবাদ সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তি’ বাংলাদেশে প্রকাশের পর সাড়া পড়ে যাওয়ায় কোলকাতা থেকে কোলকাতা কেন্দ্রিক সংস্করণ বের হয়। বদরুদ্দিন ওমরের ‘পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন এবং তৎকালীন রাজনীতি’ এবং ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ ও বাংলাদেশের কৃষক’ গ্রন্থ দুটি ও কোলকাতা থেকে পরবর্তীতে প্রকাশিত হয়েছিল বলে জানা যায়। ড. মুর্তুজা বশীর তো তার ‘আল্ট্রামেরীন’ উপন্যাস সরাসরি কোলকাতা থেকে প্রকাশ করেছিলেন। এ দেশের সিংহভাগ লেখক, গবেষক, বুদ্ধিজীবী উচ্চস্তরের পাঠক পাঠিকাদের জন্য সাহিত্য রচনা ও প্রকাশ করেন। কিন্ত ড. মাহবুবুল হক উপলদ্ধি করেছিলেন যে এ দেশের নাগরিকদের উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছে শিশু কিশোর। তাদের আদর্শবান ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হলে তাদের মধ্যে সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটানো প্রয়োজন। তাই তিনি গবেষণা গ্রন্থ রচনার পাশাপাশি শিশু কিশোর পাঠোপযোগী গ্রন্থ রচনার প্রয়োজন অনুভব করেছেন। তাই তিনি বেশ কিছু শিশু কিশোর পাঠ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন।
বিদ্যালয়ে পাঠদানের জন্য এ গ্রন্থগুলো নির্ধারিত করা হয়েছে এবং বিদ্যালয়সমূহে পড়ানো হচ্ছে। দেশ ও সমাজের প্রতি কী রূপ দায়বদ্ধতা অনুভব করলে শিশু কিশোরদের জন্য গ্রন্থ রচনা করতে পারেন, এ ক্ষেত্রেই অধ্যাপক ড. মাহবুবুল হকের অনন্যতা ফুটে উঠেছে।
ড. মাহবুবুল হকের জন্ম ফরিদপুরে। এ জেলা প্রচুর কীর্তিমান মানুষের ইতিহাস ঐতিহ্য ধারণ করে আছে। ড. মাহবুবুল হকের কিশোরকাল, যৌবন কাল, পেশাগত জীবন বলতে গেলে পুরোটা জীবন কেটেছে চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামে মৃত্যু বরণ করে চট্টগ্রামে সমাহিত হয়েছেন। এমন চট্টগ্রাম প্রেম চট্টগ্রামীদের মধ্যেও দেখা যায় না। চট্টগ্রামে থেকে চট্টগ্রামে জীবন জগত বা ক্যারিয়ার গড়ে চট্টগ্রামের ইতিহাস গৌরবময় স্থান করে যারা নিয়েছেন তাদের মধ্যে একজন হচ্ছেন রাজনীতিবিদ এম.এ. হান্নান। তার পৈতৃক জেলা যশোর। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে তার অবদান সবার জানা। প্রগতিশীল আলোকিত পাঠক সৃষ্টির ব্রত নিয়ে বরিশাল থেকে চট্টগ্রামে এসে ‘কারেন্ট বুক সেন্টার’ নামে গ্রন্থ বিপণী কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে জ্ঞানের সম্পদ সরবরাহ করার দায়িত্ব পালন করে চট্টগ্রামের জ্ঞানী ও সুধী সমাজে সম্মানের আসন লাভ করেছেন এম.এ আমিন। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে এসে আগ্রাবাদ হোটেল নামে একটি আন্তর্জাতিক হোটেল স্থাপন করে বন্দর নগরী চট্টগ্রামের অবস্থান জাতীয়ভাবে ও আন্তর্জাতিকভাবে উন্নত করেছেন সবদর আলী। তাদের সাথে সগৈারবে যুক্ত হলেন অধ্যাপক ড. মাহবুবুল হক।
ড. মাহবুবুল হকের অনন্যতা চট্টগ্রামের ভাষার প্রতি তার অনুরাগ। এ অনুরাগ চট্টগ্রামে জন্ম বেশিরভাগ শিক্ষিত মানুষের মধ্যে দেখা যায় না। তিনি উচু মানের গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। বাংলা ব্যাকরণ গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। প্রমিত বাংলা ভাষা নিয়ে গবেষণ করেছেন। চট্টগ্রামী ভাষার একটি বিজ্ঞান সম্মত অভিধান প্রকাশ করতে প্রয়াসী হয়েছেন। চট্টগ্রমের কবি লেখকেরা চট্টগ্রামের ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে প্রচুর লেখালেখি করেছেন। কিন্তু তাদের মধ্যে চট্টগ্রামের ভাষা নিয়ে লেখালেখি করার প্রয়োজনীয়তা খুব কমই দেখা গেছে। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ ছাড়া আর কেউ করেছন কিনা জানা যায় নি। ড. মাহবুবুল হক এ প্রয়াসে উদ্যোগী হয়েছেন।
২০২৪ সালের ২০ শে ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের অলিয়াঁস ফ্রসেজে একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সংস্থার পরিচালকের উদ্যোগে এবং শিক্ষক গুরুপদ চক্রবর্তীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এ সভায় আলোচক ছিলেন ড. মাহবুবুল হক, অধ্যাপক মঞ্জুরুল আমিন, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা দপ্তর (চট্টগ্রাম জেলা) এর পরিচালক সহ বেশ কজন গণ্যমান্য ব্যাক্তি। আলোচনায় ড. মাহবুবুল হক পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জাতীয় ভাষার পাশাপাশি আঞ্চলিক ভাষাসমুহের চর্চা হচ্ছে সে বিষয়ে আলোকপাত করেন। তিনি চট্টগ্রামের ভাষা, পাহাড়ী জনপদের আদিবাসী আধিবাসীদের ভাষা চর্চার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত লেখক তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন বাংলাভাষা সিলেট জেলায় এসে আহত হয়েছে, চট্টগ্রাম জেলায় এসে নিহত হয়েছে। এতে আপনার অভিমত কী?” ড. মাহবুবুল হক সুন্দর ও সাবলীলভাবে চট্টগ্রামী ভাষায় কীভাবে স্থানীয় ভাষার মধ্যে মগ, পর্তুগীজ, আরাকানী, আরব, পার্সিয়ান, বৃটিশসহ বিভিন্ন জাতির ভাষায় সংমিশ্রণ ঘটেছে তার উপর আলোকপাত করলেন। তবে তিনি চট্টগ্রামের ভাষা নিয়ে গবেষণা করছেন এবং চট্টগ্রামী ভাষার অভিধান রচনায় হাত দিয়েছেন বলে স্বতস্ফুর্তভাবে জানালেন।
২০০৩–২০০৪ সালের দিকে মানচিত্র নামে একটি শিল্প ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী গুণীজন সংবর্ধনার আয়োজন করে। সংবর্ধিতদের মধ্যে একজন ছিলেন কবি লেখক ওহিদুল আলম। ড. মাহবুবুল এক তার স্কুল শিক্ষক ওহিদুল আলমকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে তার জীবনের বিকাশের শিক্ষক ওহিদুল আলমের ভূমিকার কথা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন।
ড. মাহবুবুল হক তার জীবনকালেই বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদকসহ প্রচুর সম্মাননা লাভ করেছেন। তাই তার জীবন সফল জীবন ও পরিপূর্ণ জীবন। তার প্রতি অসীম শ্রদ্ধা।