প্রকৃতির নির্মম খেলায় বাংলাদেশের প্রায় ১১ টি জেলায় বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। চরম দুর্ভোগের শিকার বাংলাদেশ। প্রকৃতির এমন লীলা খেলায় ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে প্রায় ১৭ লাখ মানুষ বন্যা কবলিত হয়ে পড়ে। ক্ষতিগ্রস্ত বন্যা কবলিত এলাকার ঘরবাড়িসহ রাস্তা–ঘাট, চাষাবাদ, কলকারখানা ইত্যাদি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বন্যায় অনেক মানুষের মৃত্যু হয়। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘটে যায় স্মরণকালের স্মরণীয় বন্যা। ত্রিপুরায় এই বন্যার অন্যতম কারণ হচ্ছে ভারী বৃষ্টিপাত। ত্রিপুরা রাজ্য সরকার বলছে, এই ধরনের ভারী বৃষ্টিপাত বিগত প্রায় দুয়েক যুগের মধ্যে ঘটেনি। ত্রিপুরা টাইমস ও বোরোক টাইমসের প্রতিবেদনের বরাতে দেখা যায়, বিগত একত্রিশ বছর পর ত্রিপুরা কর্তৃপক্ষ ডুম্বুর জলাধারের বাঁধের সুইস গেইট খুলেছে। কিন্তু কেন এইভাবে বাঁধ খুলে দেয়া হল। এখানে কি কোনো ষড়যন্ত্র নিহিত ছিল? এখন এই প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে বাংলাদেশে।
তথ্যানুযায়ী ত্রিপুরা রাজ্যে ভারী বৃষ্টির কারণে গোমতী জেলায় রাজ্যের একমাত্র পানিবিদ্যুৎ প্রকল্পের ডুম্বুর জলাধারে পানি বিপদসীমার ওপরে চলে যায়। এমন অবস্থায় ডুম্বুর সুইস গেইট কর্তৃপক্ষ গেইট খুলে দেয়। ফলে গোমতীজেলাসহ বিভিন্ন এলাকায় বাঁধের পানিতে সয়লাব ঘটে। এতে করে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে ভারতের পানি প্রবেশ করে বন্যায় রূপ নেয়। অবশ্য ভারতের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ত্রিপুরা রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে এবং বাঁধ কর্তৃপক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রয়োজনের তুলনায় বাঁধে বেশি পরিমাণ পানি জমে যায়। যে কোনো সময় বাঁধ ভেঙে বড় বিপর্যয় ঘটতে পারে। ঠিক এই পরিস্থিতিতে স্থানীয় এলাকায় আগাম ঘোষণা দিয়ে জলাধার কর্তৃপক্ষ সুইস গেইট খুলে বাড়তি পানি ছেড়ে দিয়েছে। এর ফলে গোমতী ও সিপাহী জেলার বিস্তীর্ণ এলাকার বাড়িঘর ও কৃষিজমিতে ভয়ানক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যায়।
ত্রিপুরা কর্তৃপক্ষ ডুম্বুর জলাধারের বাঁধের সুইস গেইট খুলে দেয়ার পাশাপাশি ভারী বর্ষণের কারণে উজান থেকে বানের পানি ঢুকতে থাকায় ফেনী জেলায় স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। জেলার উত্তরের তিন উপজেলা ফুলগাজী, পরশুরাম ও ছাগলনাইয়ার রাস্তা–ঘাট ও ঘর–বসতি এখন পানির নিচে চলে যায়। যোগাযোগ ব্যবস্থা পানির নিচে তলিয়ে যায়। মানুষ বাঁচার জন্যে আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে। ফেনী সদর উপজেলা, সোনাগাজীর অনেক গ্রামও প্লাবিত হয়েছে। বন্যায় ফেনী, কুমিল্লাসহ প্রায় ১১ টি জেলায় ৪৫ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পানিতে ভেসে যায় বাংলাদেশের কিছু অঞ্চল।
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে কয়েকদিন ধরে চলে টানা ভারী বৃষ্টিপাত। অবিরাম বর্ষণে সেখানকার বিভিন্ন জনপদ পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় ডুম্বুর জলাধারের বাঁধের সুইস গেইট খুলে দেয় কর্তৃপক্ষ। ফলে উজানের পানি ত্রিপুরা রাজ্যের বিভিন্ন জনপদ ভাসিয়ে দেয়। বাঁধ খুলে দেয়ায় পানি ঢুকে বাংলাদেশে। হঠাৎ বাংলাদেশে ভারতের পানি ঢুকায় সংশ্লিষ্ট অঞ্চল ছাড়াও সারা দেশের মানুষের মধ্যে একটা আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। যেহেতু চলতি আগস্ট মাসের পাঁচ তারিখে আওয়ামী লীগ সরকার পতন হলে প্রধানমন্ত্রী দেশ ছেড়ে সেনাবাহিনীর বিমানে চড়ে ভারতে পালিয়ে আশ্রয় নেয়। ফলে দেশে নতুন সরকার আসে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পছন্দে নোবেল লরিয়েট প্রফেসর ড.মুহাম্মদ ইউনুচের নেতৃত্বে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। আওয়ামী লীগের কিছু নেতা–কর্মী ব্যতীত সকলেই একটা আনন্দ উল্লাসে মেতে ওঠে। বিশেষ করে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ ছাড়াও গণঅধিকার পরিষদ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি, জামাতে ইসলামীসহ বিভিন্ন সংগঠন আনন্দ উল্লাস করছে। কেউ কেউ কারাভোগ থেকে মুক্তি পাচ্ছে। ঠিক এহেন মুহূর্তে ভারতের বাঁধের পানি ছেড়ে দেয়ায় গভীর ভাবনার উদ্রেক করেছে। অনেকে মনে করছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে বসে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ভারত বাংলাদেশকে পানিতে ডুবিয়ে মারতে চাইছে।
সমস্ত কল্পনা–জল্পনার অবসানের ক্ষেত্রে দেখতে পাই, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে কয়েকদিন ধরে ভারী বৃষ্টিপাত হওয়ায় তাদের বাঁধের পানি বিপদসীমার ওপরে চলে যায়। ফলে তারা স্থানীয়দের সতর্কতা বার্তা দিলেও নিচু অঞ্চল বাংলাদেশকে সতর্কবার্তা না দিয়ে বাঁধ খুলে দেয়। বাংলাদেশকে সতর্কবার্তা না দেয়াই সমস্ত বিপদ ঘটেছে। এ দেশের মানুষের মধ্যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। যেহেতু বিগত একত্রিশ বছরের মধ্যে এবারই ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের গোমতী জেলার ডুম্বুর বাঁধ খুলে দেয়া হয়েছে।
আমরা মনে করি, ডুম্বুর বাঁধ কর্তৃপক্ষ একটা চরম ভুল করেছে। তারা স্থানীয়দের যেমন আগাম সতর্কতা জানিয়েছিল তেমনি তারা বাংলাদেশকেও সতর্ক করতে পারতো। কিন্তু তা তারা করেনি। ফলে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে স্মরণকালের স্মরণীয় বন্যা বয়ে যায়। প্রবল বর্ষণও এর অন্যতম কারণ। আমাদের কাপ্তাই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বাঁধ খুলে দেয়ার ক্ষেত্রে দেখা যায়, বাঁধের গেইট খুলে দেয়ার পুর্বে তারা প্রয়োজন অনুসারে বিপদসীমার প্রয়োজনীয় সতর্কতা সময়ে সময়ে প্রচার করে। তারপর বিপদসীমা অতিক্রম করতে চাইলে তারা বাঁধের গেইট খুলে দেয়। এটাই স্বাভাবিকভাবে হয়ে থাকে এবং এটি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিধিবিধান। যেমন প্রত্যেক দেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিধি মোতাবেক তারা আবহাওয়া বার্তা প্রচার করে থাকে। ত্রিপুরা রাজ্যের গোমতী জেলার ডুম্বুর সুইস গেইট খোলার ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। ফলে এখানে দেশীয় আইন, আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। ভারতের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যেমন নির্বোধের মত কাজ করেছে তেমনি দেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরেরও কিছু ভুল রয়েছে। যেহেতু তারা পার্শ্ববর্তী দেশের জলবায়ু নিয়ে সতর্ক করার মত কাজ করতে পারেনি। এই সমস্ত ভুলের কারণে আজ দেশে একটি স্মরণকালের স্মরণীয় বন্যা ঘটে যায়। যার মাসুল দিচ্ছে সংশ্লিষ্ট এলাকা ছাড়াও এ দেশের সাধারণ মানুষ। বাচ্চা শিশুরা তার মাটির ব্যাংকের জমানো টাকা নিয়ে ছুটছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসে, টিএসসিতে, ঢাকা চট্টগ্রামসহ সারা দেশের গণত্রাণ গ্রহণ কেন্দ্রগুলোতে। মানুষ অকাতরে বিলিয়ে দিচ্ছে আর্থিক সাহায্য ও ত্রাণসামগ্রী। ফলে কিছু কিছু ত্রাণকেন্দ্রের দৈনিক আর্থিক অনুদানের পরিমাণ দাঁড়ায় কয়েক কোটি টাকা পর্যন্ত। সাধারণ ছাত্র, সাধারণ মানুষ ছাড়াও আজ উদ্ধার তৎপরতায় জীবন বাজি রেখে ছুটেছে আমাদের সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, আনসার সদস্যরা। সরকার ও প্রশাসনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় চলছে উদ্ধারকর্ম, ত্রাণ তৎপরতা। সাহায্যকারী চিন্তিত জনতার ভিড়ে ঢাকা–চট্টগ্রাম মহা সড়কে উদ্ধারকর্মীদের গাড়িতে বিশাল জ্যাম দেখা যায়। দক্ষ–অদক্ষ, সাহসী–ভীরু অসংখ্য মানুষের দল উদ্ধার কর্মে এগিয়ে আসে। এমনও হয়েছে, এ কারণে উদ্ধার কাজেও সেনাবাহিনীর সময় ক্ষেপণ হয়েছে অনেক জায়গায়। উদ্ধার ও ত্রাণতৎপরতার ক্ষেত্রে ছাত্রদের উদ্যোগ অত্যন্ত প্রশংসনীয়। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলে এগিয়ে আসায় আশা করছি বন্যার্ত এলাকা খুব দ্রুত ঘুরে দাঁড়াবে। বন্যার্ত মানুষের দুর্যোগ কেটে যাবে। বন্যা কবলিত এলাকার মানুষের হাহাকার ঘুচে যাবে। আজ এটি কাম্য।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও মানবাধিকার কর্মী।